কান্ডারিহীন বিএনপি এবার প্যারোল রাজনীতির ফাঁদে পা দিয়েছে বলে মনে
হচ্ছে। কেননা, প্যারোল অনুমোদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে কোনো আইন নেই এবং তা স্বরাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছাধীন ও পরিবর্তনশীল নীতিমালায় অনুশীলন করা হয়। অতএব, একজন সত্তুরোর্ধ
ও অসুস্থ রাজনীতিকের প্যারোল নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরাও মনের মাধুরী মিশিয়ে
নানাধরণের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এমনকি, বারো বছর একটানা ক্ষমতা ধরে রাখার সুবাদে অভ্যাসসূচক
ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে চলেছেন। অবস্থাদৃষ্টে তাই প্রশ্ন উঠছে, আন্দোলন ও নির্বাচনের মতই
প্যারোলের রাজনীতিতেও কি বিএনপি বিভ্রান্তির কবলে পড়তে চলেছে?
প্যারোল কথাটা রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশে অতীতে দুটো কারণে
প্যারোলের কথা শোনা গেছে। একটি হচ্ছে মানবিক এবং অপরটি রাজনৈতিক। মানবিক কারণে প্যারোল
বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া এর আগেও পেয়েছেন। ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক
সরকারের আমলে যে বছরখানেক সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি একইভবনে একইধরণের কারাজীবন
পার করছিলেন, সেসময়ে তাঁর মায়ের মৃত্যুতে তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়েছিলেন। আর, রাজনৈতিক
কারণে যাঁরা প্যারোলে মুক্তি পেয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং
খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির
অংশগ্রহণের অনুকূল পরিবেশ তৈরির শর্ত পূরণে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার এঁদের প্যারোলের
ব্যবস্থা করে। রাজনীতির অন্দরমহলের খবর যাঁরা রাখেন, তাঁরা জানেন যে এসব প্যারোলের
জন্য কাউকে মাঠে বক্তৃতা দিতে হয়নি এবং রাজনৈতিক
চাপ অনুভূব করার কারণেই তখন সরকার এগিয়ে এসে তার ব্যবস্থা করেছিল। স্বাধীনতার আগের
ইতিহাসে না গেলেও পরের ইতিহাসে সুপরিচিত রাজনীতিকদের চিকিৎসার প্রয়োজনে প্যারোলের দৃষ্টান্ত
আছে। যেমন, জাসদ নেতা আসম রবের জার্মানিতে চিকিৎসার কথা এখানে স্মরণ করা যায়।
পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, পুত্র চিকিৎসাজনিত প্যারোল পেয়েছিলেন যত সহজে,
মায়ের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় প্যারোল ততটাই কঠিন হয়ে দেখা দিয়েছে। পুত্রের প্যারোলের
বিষয়ে তখন সরকার চাপ অনুভব করেছিলো, আর এখন সরকার একেবারেই চাপমুক্ত। তখন প্যারোলের
ফয়সালা হয়েছিল নেপথ্যে, আর এখন প্রকাশ্য দেন-দরবারেও সাড়া মেলার কোনো লক্ষণ নেই। তবে,
যতটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে তাতে রাজনীতিক হিসাবে খালেদা জিয়া কারাজীবনে মৃত্যুর সম্ভাবনা
নিয়ে ততটা চিন্তিত নন। তবে, তাঁর দলের অন্যদের মধ্যে অস্থিরতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে
যে তাঁরা রাজনীতিতে ক্রমশই তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন।
ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যখন বলেন অপরাধ স্বীকার করেই প্যারোলের আবেদন
করতে হবে, তখন বোঝা যায় বিষয়টি মানবিক নাকি
রাজনৈতিক। প্রশ্ন হচ্ছে, প্যারোল সম্পর্কে আইনের বিধান কী? প্যারোলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের
ক্ষমতা কার? সরকারের না আদালতের? বিস্ময়কর হলেও সত্য, এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন
নেই, যার আলোকে প্যারোল সম্পর্কে সরকার বা বিরোধীদল বিএনপির পরস্পরবিরোধী দাবির নিষ্পত্তি
হতে পারে। অবশ্য প্যারোলের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায় ২০১০ সালে তৈরি বাংলাদেশ বর্ডার
গার্ডস আইন এবং ২০১৬‘র কোস্ট গার্ড
আইনে – যা শুধুমাত্র
ওই দুই বাহিনীর সদস্যদের জন্য প্রযোজ্য। প্যারোলের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন না থাকায়
বিষয়টির প্রয়োগের সম্ভাব্য ব্যাখ্যা মেলে অন্য দুটো আইনে – যার একটি
হচ্ছে , দ্য প্রোবেশন অফ অফেন্ডারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ এবং অন্যটি হচ্ছে দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, ১৮৯৪। তবে,
সরকারের যে হালনাগাদকৃত প্যারোল নীতিমালার সন্ধান মেলে সেটি জারি হয়েছিল ২০১৬ সালের
১ জুন। হালনাগাদ নীতিমালায় অতীতের যেগুলোর উল্লেখ (রেফারেন্স) পাওয়া যায় তার একটি হচ্ছে
২০১০ সালের ৩ মার্চের এবং অন্য আরেকটি ২০০৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের। তবে, নীতিমালা কোন
আইনের অধীনে তৈরি হয়েছে তার কোনো উল্লেখ এতে নেই।
সরকারের সর্বসাম্প্রতিক প্যারোল নীতিতে বলা হয়েছে বন্দীদের নিকটাত্মীয়দের কেউ
মারা গেলে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্যারোলে মুক্তি দেওয়া যাবে। জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট প্যারোল
মঞ্জুরকারি কর্তৃপক্ষ হিসাবে বিবেচিত হবেন। তবে, এই নির্দেশনায় আরও বলা আছে ‘নিকটাত্মীয়ের মৃত্যুর কারণ ছাড়াও কোনো আদালতের আদেশ বা সরকারের বিশেষ
সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্যারোলে মুক্তির প্রয়োজন
দেখা দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্দীকে প্যারোলে
মুক্তি দেওয়া যাবে‘। এতে নিরাপত্তা
ও দূরত্ব বিবেচনায় এই সময় বেঁধে দেওয়ার এবং বন্দীকে সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশ প্রহরাধীন
থাকতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে । নীতিমালার অরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই সময়সীমা
কোনো অবস্থাতেই ১২ ঘন্টার বেশি হবে না বলার পরই তাতে লেখা হয়েছে, তবে ‘বিশেষ ক্ষেত্রে
সরকার মুক্তির সময়সীমা হ্রাস/বৃদ্ধি করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করবে‘। এই নীতিমালায়
প্যারোলের মেয়াদ নির্ধারণের এখতিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হলেও বন্দীর দোষ স্বীকারের
কোনো শর্ত নেই। সুতরাং, মন্ত্রীদের মধ্যে
যাঁরা অপরাধ স্বীকার করে প্যারোলের আবেদন করতে হবে বলে দাবি করছেন, তাঁদের বক্তব্যে
যদি কেউ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় করার উদ্দেশ্য খুঁজে পান তা নাকচ করা সহজ নয়।
প্রোবেশন অর্ডিন্যান্স অনুসরণ করা হলে দন্ডিত ব্যাক্তির শর্তাধীন
মুক্তির আদেশ দেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আদালতের, সরকারের নয়। এই আইনে মামলার রায় ঘোষণার
সময়ে বিচারিক আদালত অথবা আপিল দায়েরের সময়ে উচ্চ আদালত দন্ডিত ব্যাক্তিকে শর্তাধীন
মুক্তি দিতে পারেন। মুক্ত থাকার সময়ে তাঁকে ওইসব শর্ত পালন করতে হয় এবং সেগুলো দেখার জন্য প্রোবেশন কর্মকর্তা থাকেন। একমাত্র মৃত্যুদন্ডে
দন্ডিত না হলে যেকোনো নারী এই আইনে শর্তাধীন মুক্তিলাভের অধিকার রাখেন। মামলার রাজনৈতিক
চরিত্রের কারণে বিচারিক আদালতে তেমনটি যে সম্ভব ছিল না, তা মোটামুটি সবারই জানা। তবে,
উচ্চ আদালতে আপিলের পর্যায়ে খালেদা জিয়ার সেই আবেদনের সুযোগ এখনও থাকার কথা। প্রোবেশনের
সিদ্ধান্তটি একান্তই বিচারকদের, সরকারের নয়। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বিএনপি বিভিন্নসময়ে
যেসব অভিযোগ করে এসেছে, বিশেষ করে তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ হওয়ার পটভূমিতে, তাতে অবশ্য
আদালতের প্রতি আস্থার প্রশ্নে তাঁদের মধ্যে সংশয় থাকা অস্বাভাবিক নয়।
তাছাড়া, একথাও সত্য যে, বাংলাদেশে আইনপ্রয়োগের ক্ষেত্রে আদালতে প্রোবেশন
আইন প্রয়োগের প্রবণতা নেই বললেই চলে। বিষয়টিতে সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ইমান আলীর একটি ব্যাখ্যা
পাওয়া যায় বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড ট্রাস্ট ( ব্লাস্ট) ও পেনাল রিফর্ম ইন্টারন্যাশনাল ( পিআরআই) প্রকাশনা ‘ডেভলপমেন্ট
অ্যান্ড ইউজ অব দ্য প্রোবেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ‘ এ। বিচারপতি
ইমান আলীর কথায় ‘সম্ভবত বিজ্ঞ
বিচারকদের শান্তিপ্রদানমূলক মনোভাবের কারণে আমাদের বিচারিক আদালত প্রবেশনের ব্যবহার
অত্যন্ত বিরল এবং এই অবস্থা দেশের সর্বত্র বিরাজ করছে‘।
অন্য আইন, যেটি সোয়াশ বছরের পুরোনো দ্য প্রিজন্স অ্যাক্ট, তাতে অন্তত
তিনটি ধারায় সরকারকে বন্দীদের সাজা কমানো ও আগাম মুক্তির বিষয়ে বিধিপ্রণয়নের ক্ষমতা
দেওয়া হয়েছে। ধারণা করা অযৌক্তিক হবে না যে মন্ত্রীদের কেউ কেউ হয়তো এই আইনের আলোকে
বিভিন্নধরণের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। ক্ষমতাটি সরকারের হাতে থাকলে এরকম হওয়া মোটেও অস্বাভাবিক নয়। এবং তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার
করাটাও অপ্রত্যাশিত নয়। প্রিজন্স অ্যাক্টের ৫৯ ধারার ৫, ৭ এবং ৯ উপধারায় বন্দীদের আচরণের
ভিত্তিতে মূল্যায়ন এবং সাজা কমানো, বন্দীর মৃত্যু ঝুঁকি বিবেচনায় মুক্তিদান এবং দন্ডের
সময় এবং শ্রেণী নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বিধিপ্রণয়নের ক্ষমতা পুরোপুরি সরকারের। এই ক্ষমতা
প্রয়োগ করেই যে বিকাশের মত দুর্ধষ অপরাধীরা সাজার মেয়াদ শেষ করার আগেই সরকারের কৃপায়
মুক্তি পেয়েছেন, সন্দেহ নেই।
সরকারের এখতিয়ার এবং কর্তৃত্ব বিবেচনায় প্যারোল প্রশ্নে রাজনৈতিক
প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষমতাসীন দল সহানুভূতিশীল হবে বিএনপির মধ্যে যাঁরা এমনটি ভাবছেন
তাঁদের ভাবনার ভিত্তি কী তাও স্পষ্ট নয়। সরকারবিরোধী আন্দোলনের নামে হঠকারিতার ফাঁদে
পা দিয়ে দলটির যে দূর্গতির শুরু তা আরও প্রকট হয়েছে নির্বাচন প্রশ্নে অসংলগ্ন অস্থিরতায়।
যে কারণে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কখন অর্থর্পূণ আর কখন নয়, সেই ভেদবোধও তাঁদের লোপ পাওয়ার
আলামত দৃশ্যমান। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করা যখন ক্ষমতাসীনদের জন্য জরুরি ছিল তখন
কোনোধরণের ছাড় আদায় করতে না পারলেও উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনকে বৈধতা
দিতে দলটির উৎসাহে কোনো ঘাটতি নেই। এখন প্যারোলের রাজনীতিতেও দলটির ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা
ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছে।
(১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২০‘র প্রথম আলোয়
প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন