সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

করোনা মোকাবিলায় বন্দী মুক্তির তালিকা বাড়ান


করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে দেশের কারাগারগুলো থেকে লঘু অপরাধে দন্ডিত আসামীদের মুক্তির নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। গত সোমবার মন্ত্রীসভার বৈঠকে এই নির্দেশ দেন বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এই নির্দেশের আলোকে লঘু অপরাধে দন্ডিত ৩৭০০ জনের একটি তালিকাও তৈরি হয়েছে (৩৭০০ আসামির মুক্তির প্রস্তাব, প্রথম আলো, ৮ এপ্রিল, ২০২০)। তবে, এখনও কেউ মুক্তি পাননি। আমাদের কারাগারগুলোতে বন্দী রয়েছেন ধারণক্ষমতার দ্বিগুণেরও বেশি। করোনার কালে আদালতগুলোর কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নতুন করে কেউ জামিন পাননি। কিন্তু, অপরাধ তো থেমে থাকেনি এবং বন্দীসংখ্যা বেড়েই চলেছে। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং গ্রেপ্তার দুটোই চলছে।
করোনার কোনো ওষুধ নেই এবং এই অদৃশ্য কিন্তু অতিছোঁয়াচে রোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে শারীরিক অন্তত দুই মিটার দূরত্ব বজায় রাখা। সাধারণত ফাঁসির আসামীরা নি:সঙ্গ বা সলিটারি অবস্থায় বন্দী থাকেন। আর, ভিআইপি মর্যাদার অধিকারীরাও কিছটা নিসঙ্গতার সুযোগ নিতে পারেন।  কিন্তু, প্রায় ৮৯ হাজার বন্দীর প্রায় কারোরই শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার সুযোগ নেই। সুতরাং, সাধারণ বন্দীরা যে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সর্ব্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।  বন্দীদের প্রতি মানুষ সাধারণভাবে খুব একটা সহানুভূতিশীল হন না। কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য হচ্ছে বন্দীদের সবাই দন্ডপ্রাপ্ত নন।
গতবছরে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একটি কমিটিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আমাদের কারাগারগুলোতে যত বন্দী আছেন তার ৮১ শতাংশ বিচারাধীন। অর্থাৎ, তাঁদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ থাকলেও তাঁরা দন্ডিত আসামী নন। আদালতে অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া  পর্যন্ত তাঁরা কারাগারের বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা অন্য সবার মতই নিরপরাধ। আমাদের বিচারব্যবস্থার দূর্বলতা এবং পুলিশ ও তদন্ত সংস্থার অদক্ষতা ও দূর্নীতির কারণে বিচারপ্রক্রিয়া যেহেতু দীর্ঘায়িত হয়, সেহেতু কথা উঠতে পারে, ভয়ংকর অপরাধের আসামীদের কারাগারে আটক রাখাই শ্রেয় এবং যৌক্তিক। কিন্তু, আইনমন্ত্রীর জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অভিযুক্তদের মধ্যে দন্ডিত হওয়ার হার হচ্ছে প্রতি একশোজনে মাত্র তিনজন।
লঘু দন্ডের সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের আগাম মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই একটি সমর্থনযোগ্য পদক্ষেপ। হত্যা-ধর্ষণ-নারী ও শিশু নির্যাতন এবং গুরুতর অর্থনৈতিক অপরাধের আসামীরা সমাজের জন্য বিপজ্জনক বলে তাদেরকে মুক্তি না দেওয়ার সিদ্ধান্তও যথাযথ। কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে করোনাঝুঁকির কারণে জামিনযোগ্য মামলায় বিচারাধীন ব্যাক্তিরা কেন মুক্তিলাভের জন্য বিবেচ্য হবেন না? হয়রানিমূলক মামলা বিশেষত ক্ষমতাসীন রাজনীতিকদের সমালোচনা বা ব্যঙ্গ করার মত অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত বহুলসমালোচিত আইনে আটক বন্দীদের মুক্তি দানকে কেন অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না, তা আমাদের কাছে মোটেও বোধগম্য নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির যথেচ্ছ অপপ্রয়োগের কথা কারোই অজানা নয়। এই আইনে কথিত ভুক্তভোগী মামলা করেন কমই। তাঁদের ভক্তকুল অথবা প্রশাসনিক ইঙ্গিতে পুলিশ মামলা করে, তাও একটি নয় একসঙ্গে একাধিক জেলায়। স্পষ্টতই: একহাত দেখে নেওয়ার একটা মানসিকতা এখানে কাজ করে। এই আইনে মামলা, অভিযুক্ত এবং বন্দীর সংখ্যা কত সেবিষয়ে সরকারিভাবে কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। তবে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গত ১৮ই মার্চ মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী এবং নিখোঁজ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার বিষয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে তারা একটা হিসাব দিয়েছে। ওই হিসাবে ২০১৮ সালে আইনটি হওয়ার পর থেকে এপর্যন্ত এই আইনে মামলা হয়েছে এক হাজারের বেশি। অভিযুক্তের সংখ্যা নি:সন্দেহে আরও বেশি হবে, কেননা অনেক মামলাতেই একাধিক ব্যাক্তি আসামী। আবার, এই আইনে জামিনের বিষয়ে এতোই কঠোরতা অনুসরণ করা হয় যে ধরে নেওয়া অন্যায় হবে না অভিযুক্তদের অধিকাংশই কারাগারে আছেন। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ক আর্ন্তজাতিক সনদের ব্যাখ্যায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রায় সব মামলাই রাজনৈতিক মামলা হিসাবে গণ্য হতে বাধ্য।
করোনাঝুঁকির কারণে কারাবন্দীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার দিকে বিশেষভাবে নজর দেওয়ার জন্য কয়েকসপ্তাহ ধরেই সরকারগুলোর নজর কাড়ার চেষ্টা করছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট। তাঁর কথায় রাজনৈতিক বন্দী কিম্বা ভিন্নমত প্রকাশের জন্য আটক ব্যাক্তিসহ যাদের আটক রাখার জন্য পর্যাপ্ত আইনগত ভিত্তি নেই এমন সব বন্দীর মুক্তি দেওয়া অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সরকারগুলোর জন্য এখন বেশি প্রয়োজন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বড় আকারে বন্দীমুক্তির পদক্ষেপও নিয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের হিসাবে গত ৩ এপ্রিল পর্যন্ত  ইরান প্রায় লাখখানেক বন্দীকে মুক্তি দিয়েছে যা দেশটির পুরো বন্দীসংখ্যার চল্লিশ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়া মুক্তি দিয়েছে প্রায় ত্রিশ হাজার বন্দীকে। আর্ন্তজাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে জানা যায় যে ইরান এমনকি কিছু বন্দীকে মহামারির পর ফিরে কারাগারে আসার শর্তেও সাময়িক মুক্তি দিয়েছে। ইরানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক নাসরিন জাগারি সেরকম শর্তাধীন মুক্তিপ্রাপ্তদের একজন।
বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বন্দী মুক্তির সংখ্যা এগুলোর তুলনায় একেবারেই নগণ্য। এতো অল্প সংখ্যক বন্দীর মুক্তি কারাগারগুলোর জনঘনত্ব কমানোয় যেমন কোনো কাজে আসবে না, তেমনি স্বাস্থ্যঝুঁকিও লাঘব করবে না। সুতরাং, মহামারি মোকাবিলার অংশ হিসাবে কারাগারে সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়াতে বন্দীমুক্তির পরিধি দ্রুত সম্প্রসারণ প্রয়োজন। রাজবন্দী হিসাবে স্বীকার করুন আর না-ই করুন  ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সব অভিযুক্তকে অবিলম্বে মুক্তি দিন। এছাড়া জামিনযোগ্য মামলায় যারা এখনও অপরাধী হিসাবে দন্ডিত নন তাঁদেরকেও মুক্তির পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। এবিষয়ে আর কালক্ষেপণের সময় নেই।
( ১০ এপ্রিল, ২০২০ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...