করোনাভাইরাসের মহামারি মোকাবিলায়
সমন্বয়হীনতার অভিযোগ গত কয়েকসপ্তাহ ধরেই আলোচিত হচ্ছে। অভিযোগগুলো যে একেবারে
ভিত্তিহীন নয়, তার সর্বসাম্প্রতিক প্রমাণ হচ্ছে ৬৪ জেলার ‘ত্রাণ কাজের সুসমন্বয়ের‘ দায়িত্ব সচিবদের ওপর অর্পণ। প্রশ্ন
উঠেছে স্মরণকালের নজিরবিহীন একটি জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলায় সমন্বয়হীনতা মানুষের
ভোগান্তিকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এবং
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ – এই দুই আইনের
কোনোটিই যথাযথভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না।
২০ এপ্রিল জারি করা সরকারি আদেশে জেলা
পর্যায়ে সচিবদের শুধু এই একটি কাজ তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এবং তা হচ্ছে ত্রাণ
কার্যক্রম। করোনাভাইরাসের কারণে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে দেশে সরকারি ছুটি
ঘোষণার প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পর কর্মহীন হয়ে পড়া অভুক্ত মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে
দেওয়ার কাজটি সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় স্থান পেল। তবে, এই পদক্ষেপে অবস্থা
কতটা বদলাবে তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কেননা, ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ের
জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনে সচিবদের জন্য খুব একটা সহজ হওয়ার কথা
নয়। আর, এই কাজটির জন্য যদি তাঁদের জেলা প্রশাসক বা জেলা ত্রাণ কর্মকর্তাদের ওপর
নির্ভরশীল হতে হয়, তা পুরো প্রক্রিয়ায় একটা অতিরিক্ত স্তর তৈরি করে দীর্ঘসূত্রিতার
কারণ হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী ২৫ মার্চ যে ২৯ দফা নির্দেশনা জারি করেন স্বাস্থ্য
অধিদপ্তরের করোনা বিষয়ক ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করা হয়েছে। মহামারিকে জাতীয় দূর্যোগ
ঘোষণা করা না হয়নি ঠিকই, কিন্তু ওই তালিকায় ২৪ নম্বর নির্দেশনায় ‘দুর্যোগবিষয়ক স্থায়ী
আদেশাবলি (এসওডি) যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সব সরকারি কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবী
সংগঠনের প্রতি আহ্বান‘ জানানো হয়েছে। দুর্যোগবিষয়ক
স্থায়ী আদেশাবলি (এসওডি–২০১৯) অনুসরণ
করা হলে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল ও দুর্যোগবিষয়ক
উপদেষ্টা কমিটির তৎপরতা দৃশ্যমান হোত। সেরকম ক্ষেত্রে সচিবদের ওপর জেলা পর্যায়ের
ত্রাণ কর্মকর্তাদের দায়িত্বভার অর্পণের প্রশ্ন উঠতো না।
সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ আইনের কার্যকারিতা
যে প্রশ্নসাপেক্ষ এবং বৈশ্বিক মহামারির পটভূমিতে সৃষ্ট চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার
জন্য খুব একটা উপযুক্ত নয় সেই আলোচনা এর আগেও করেছি (করোনা মোকাবিলা: নাগরিক
সুরক্ষা ও মহামারি আইন, প্রথম আলো, ১ এপ্রিল, ২০২০)। আইনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের
মহাপরিচালককে (সচিবের পরের স্তরের কর্মকর্তা) সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণের সব কার্যক্রমের
দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যা বাস্তবতাবর্জিত। ফলে, কখনও সচিব, কখনও মন্ত্রী, কখনও তাঁর
অধীনস্থ আইইডিসিআর এর পরিচালক এরকম এক সর্বগ্রাসী সংকটের বিষয়ে নানামুখী ও বিচিত্র
সিদ্ধান্ত বিক্ষিপ্তভাবে গ্রহণ করেছেন। কার্যত প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপের
আগে এমনটিই দেখা গেছে। অবশ্য, এঁরা সবাই ‘দিকনির্দেশনা অনুযায়ী‘ কাজ করার কথাই বলেছেন।
মহামারি
ঠেকানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাবগুলো এতোটাই
ব্যপক যে তার রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। এরকম পটভূমিতে জনস্বাস্থ্যগত সংকটের হুমকির
প্রকৃতি এবং ব্যাপকতা সময়মত উপলব্ধি করতে পারা এবং তা মোকাবিলার সম্ভাব্য উপায়গুলো
তুলে ধরা ও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিগ্রহণের প্রক্রিয়ায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কার্যক্রম
অনেকগুলো প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এগুলোর সবকটির ব্যাখ্যা হয়তো এখনই মিলবে না।
কিন্তু, সংকটের গভীরতা বুঝতে এগুলোর আলোচনা জরুরি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রেকর্ড অনুযায়ী জানুয়ারির ৩০ তারিখে সংস্থা
আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। এরপর ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখে ঢাকায়
সংস্থার প্রতিনিধি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজিসহ সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায়
বসে সম্ভাব্য পরিস্থিতি কী হতে পারে তা তুলে ধরেন। ওই সভাতেই তিনি পিপিই, এন ৯৫ মাস্ক
এবং বিশেষজ্ঞ সহায়তা দেওয়ার প্রস্তাব করেন। প্রশ্ন হচ্ছে সরকার ডাব্লুএইচও‘র কাছ থেকে
কি কোনো সহায়তা নিয়েছে, নাকি সহায়তা চাইলেও কিছু পাওয়া যায় নি? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার
ওয়েবসাইটে তারা কোন দেশে কীধরণের সহায়তা দিয়েছে সেগুলোর বিবরণ নিয়মিতই প্রকাশ করে থাকে।
সেখানে ইতালি, সউদি আরব, মিশরের মত দেশগুলোতেও বিশেষজ্ঞদল পাঠানো কিম্বা আফ্রিকায় চিকিৎসাসামগ্রী
পাঠানোর বিবরণ পাওয়া যায়। কিন্তু, বাংলাদেশকে কোভিড নাইন্টিন মোকাবিলার বিষয়ে সাহায্য
করার কোনো তথ্য সেখানে নেই। এর কারণ কী?
ফেব্রুয়ারির ৩ তারিখ থেকে ছুটি ঘোষণার আগে পর্যন্ত যে সাত সপ্তাহেরও
বেশি সময় পাওয়া গেল, সেই সময়ে সরকারিভাবে পিপিই এবং অন্যান্য সরঞ্জাম সংগ্রহে কী কী
ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? চীন এবং আলিবাবার পাঠানো পিপিইর বাইরে সরকার কতটা সংগ্রহের চেষ্টা
করেছে। যুক্তরাষ্ট্র থ্রিএম কোম্পানির মাস্ক সরবরাহ বন্ধ করেছে এপ্রিলের গোড়ায়। তার
আগে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। একই মানসম্পন্ন মাস্ক আরও কিছু দেশে তৈরি হয়। অথচ, এরকম
অত্যাবশকীয় একটি সুরক্ষা সামগ্রী সংগ্রহের বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব পেয়েছিল সেরকম প্রমাণ
মেলে না। বিএমএ‘র মহাসচিব ১৮ এপ্রিল বলেছেন যে পিপিই পরিধানের
প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি বলে অনেকের সমস্যা হচ্ছে। এখন পিপিইর বৈশ্বিক সংকটের কথা বলা
হচ্ছে। অথচ, আমাদের পোশাকশিল্পের কারখানা খোলার চাপের অন্যতম কারণ হচ্ছে বিদেশে পিপিই
রপ্তানির অঙ্গীকার পূরণ। এই সক্ষমতাকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের কাজে লাগানোর উদ্যোগ
কি নেওয়া হয়েছিল?
প্রধানমন্ত্রীর
২৯ দফা নির্দেশনার ৩ নম্বরে বলা হচ্ছে : চিকিৎসা-সংশ্লিষ্ট
সবার জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এই রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সব
চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা
অবলম্বন করতে হবে। আর ৪ নম্বরে আছে : কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সব চিকিৎসক,
নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অ্যাম্বুলেন্সচালকসহ সংশ্লিষ্ট সবার
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং অন্যান্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্তরা যদি এই নির্দেশনা
দুটি অনুসরণ করতেন তাহলে করোনা সংক্রমণের শিকার স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যা নিশ্চয়ই
৪৩০ জনে পৌছাতো না। এই হিসাবটি অন্য কারো নয়, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন, বিএমএ‘র। এঁদের মধ্যে চিকিৎসকের সংখ্যাই ১৮২জন।
সংক্রমণের আশংকা বা সন্দেহে কতজন কোয়ারেন্টাইন বা সেলফ কোয়ারেন্টাইনে আছেন তা ধারণা
করা কঠিন নয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক একটি ন্যাশনাল প্রিপারেশন এন্ড রেসপন্স
প্লান চূড়ান্ত করেছেন ৬ মার্চ, যাতে সংক্রমণের সম্ভাব্য চারটি স্তরের কথা বলা হয়েছিল।
কিন্তু, এই পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় নি। কেন এটি প্রকাশ করা হয় নি, তার একটা সম্ভাব্য
ব্যাখ্যা মেলে সরকারের প্রস্তুতিহীনতায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন সংক্রমণের সম্ভাব্য
স্তরগুলোতে কতজন আক্রান্ত হতে পারেন, কতজনের হাসপাতালে চিকিৎসা প্রয়োজন হবে, কতজনের
নিবিড় পরিচর্যা বা আইসিইউ প্রয়োজন হবে সেগুলোর একটা চাহিদা নিরুপণ করে প্রস্তুতি নিয়েছে,
সেখানে আমাদের সম্ভাব্য হিসাবগুলোর কথা আমরা কেউই জানি না। বেসরকারি গবেষকদের কয়েকজন
লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের মডেল অনুসরণ করে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ছবিটা কেমন হতে পারে
সেই হিসাব করায় পেশাগত জীবনে নানাধরণের হয়রানির শিকার হয়েছেন। অথচ, এরকম হিসাবকে ভিত্তি
করে প্রস্তুতি নিলে চিকিৎসা সামগ্রী ও সুরক্ষা সরঞ্জাম সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আরেকটি গুরুত্বর্পূণ প্রকাশনা হচ্ছে চিকিৎসাসেবীদের
জন্য নির্দেশনা ন্যশনাল গাইডলাইন ফর কেস ম্যানেজমেন্ট। এটি প্রথম কবে প্রকাশ করা হয়েছে
তার কোনো উল্লেখ অবশ্য এতে পাওয়া যায় না। কিন্তু, ৯ এপ্রিল তা পঞ্চমবারের মত হালনাগাদ
করা হয়েছে বলে উল্লেখ আছে। দেশে প্রথম করোনা রোগের সন্ধান মেলে ৮ মার্চ। তার আগেই এটি
প্রকাশিত হয়ে থাকলে ভালো। তবে, এই নির্দেশনাও যে যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না তা নিঃসংশয়েই
বলা যায়। প্রকাশিত নির্দেশনায় বলা আছে: সব সন্দেহজনক, নিশ্চিত এবং সম্ভাব্য কোভিড নাইন্টিন
রোগীর ব্যবস্থাপনা হবে নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে। অন্যান্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোকে
করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী থেকে মুক্ত রাখতে হবে যাতে সেখানে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা
ব্যহত না হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, সন্দেহজনক রোগীদের শুরু থেকেই পরীক্ষার বাইরে রাখা হয়েছে।
পরীক্ষার বিষয়ে একটি অস্পষ্ট এবং অগ্রহণযোগ্য কৌশল অনুসরণের কারণে অন্যান্য হাসপাতালগুলোকে
সংক্রমণমুক্ত রাখা যায় নি। ফলে, অন্যান্য প্রাণঘাতি রোগের চিকিৎসাও বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন ৭২ হাজার টেস্টিং কিট আছে। বর্তমানে
দিনে মাত্র হাজার তিনেক টেস্ট হচ্ছে, যা খুবই কম। স্বাস্থ্যকর্মীদের টেস্ট করার কোনো
পরিকল্পনা আছে কি? অন্যান্য জরুরি সেবায় নিয়োজিতদের কী হবে ? তাছাড়া, টেস্টিংয়ের মাধ্যমে
পুরো দেশের সংক্রমণমুক্তি নিশ্চিত না হলে লকডাউন তোলা যাবে না বলে পরামর্শ দিচ্ছে বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থা। না হলে দ্বিতীয় দফায় আরও ভয়াবহ সংক্রমণ অবশ্যম্ভবী।
(২৫ এপ্রিল, ২০২০‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন