মহামারির
কালে খবরের জন্য মানুষের মধ্যে বাড়তি আগ্রহ থাকায় ক্রান্তিকালীন শোনা, দেখা ও পড়া (ক্রাইসিস
লিসেনিং, ভিউয়িং এবং রিডিং) বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং, সরাসরি সম্প্রচারের
যুগে সম্ভবত সংবাদ সম্মেলনগুলোর দর্শকসংখ্যাও বেশি। জনপ্রিয় ধারাবাহিক কিম্বা টি
টোয়েন্টি ক্রিকেট দেখার জন্য টিভির সামনে যেরকম ভিড় থাকে, এখন টিভি বা মোবাইল
স্ক্রিনের সামনেও প্রায় ততটাই চোখ নিবদ্ধ থাকে।
বাংলাদেশে
৮ মার্চ প্রথম করোনারোগী ধরা পড়ার কাছাকাছি সময় থেকেই সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের
দায়িত্বে থাকা আইইডিসিআর দৈনিক সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে করোনাভাইরাস
বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য এবং নির্দেশনা দেওয়া শুরু করে। আইইডিসিআর এর পরিচালক মীরজাদী
সাবরিনা ফ্লোরা রীতিমত দেশের সর্বাধিক উচ্চারিত নামে রুপান্তরিত হন। এরপর সংবাদ
সম্মেলনে মাঝেমধ্যে যুক্ত হতে শুরু করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল
কালাম আজাদ এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। দেশে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা
জারির পর ডিজিটাল বাংলাদেশের সংবাদ সম্মেলনও ডিজিটাল মাধ্যমে স্থানান্তরিত হয়।
তবে, ডিজিটাল সংবাদ সম্মেলনের বদলে তা রুপ নিয়েছে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠের অনুষ্ঠানে।
অনেকে অবশ্য একে স্বাস্থ্যবিভাগের বুলেটিন হিসাবে অভিহিত করছেন। এরকম দ্বিতীয়
আরেকটি বুলেটিন পাঠের ভিডিও অনুষ্ঠান শুরু হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে। সর্বসাম্প্রতিক
খবর হচ্ছে শনাক্তকরণ কিটের মজুত এবং কেন্দ্রভিত্তিক পরীক্ষার হিসাব বুলেটিন থেকে
ছেঁটে দেওয়া (সাংবাদিকের জানার সুযোগ কমাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রথম আলো, ৩০
এপ্রিল, ২০২০)।
ডিজিটাল
প্রযুক্তিতে বিশ্ব জুড়েই এখন নি:খরচায় সভা-সেমিনার-সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
ইন্টারনেট সংযোগের খরচটাই হচ্ছে একমাত্র খরচ। মেসেঞ্জার, স্কাইপ এবং হোয়াটসঅ্যাপের
মত অ্যাপের মাধ্যমে সাংবাদিকরা সহজেই এধরণের আয়োজনে যুক্ত হতে পারেন। সংখ্যার
সীমাবদ্ধতা কাটাতে বিকল্প হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে জুম – যাতে পঞ্চাশজন পর্যন্ত যুক্ত হতে
পারেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানের সংবাদ সম্মেলন
এখন এভাবেই হচ্ছে। ব্রিটেনে ডাউনিং স্ট্রিটের দৈনিক সংবাদ সম্মেলনও তাই। কিন্তু,
আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং অধিদপ্তর প্রাক-অ্যানালগ যুগে ফরে গেছেন। অনেকটা
ঔপনিবেশিক যুগের মত, যখন প্রশ্ন করার চল ছিলো না।
মহামারির
মত সংকট মোকাবেলায় জনসাধারণকে তথ্য দেওয়ার জন্য সরকারের এরকম উদ্যোগে শুরুতে
কিছুটা চমৎকৃত হয়েছিলাম। মন্ত্রী-এমপিদের অব্যাহত বাগাড়ম্বরের বিপরীতে অন্তত
কিছুটা প্রয়োজনীয় তথ্য এখান থেকে মিলবে সেরকম একটা আশাবাদ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু,
বাস্তবে এখন আক্রান্ত এবং মৃত্যুর পরিসংখ্যান ছাড়া তেমন কোনো তথ্য মিলছে না। যেসব
পরিসংখ্যান দেওয়া হচ্ছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া নানা
সংশয়-সন্দেহের কথা বাদ দিলেও মহামারি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নীতি-কৌশলের বিষয়ে যে অসংখ্য
প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে সেগুলোর কোনো উত্তর মিলছে না। এসব কথা জিজ্ঞাসা করার সুযোগই
যদি না থাকে তাহলে এধরণের আয়োজনের অর্থ কী? সামরিক শাসনামলের সরকারি এলান জারির সঙ্গে
টিভি পর্দায় হাজির হয়ে বুলেটিন পাঠে একটা অদ্ভূত মিল পাওয়া যায়। আর, তাহোল: ১. প্রজাতন্ত্রের
কর্তারা প্রজাদের শুধু নির্দেশনার কথা
জানিয়ে দেবেন; এবং ২. তাঁদের জবাবদিহি করার কোনো দায় নেই। এধরণের আয়োজনে সম্পদের
অপচয়ের বদলে বুলেটিনটা বরং ইমেইলে গণমাধ্যমে পাঠিয়ে দিলেই হয়। এতে করে মন্ত্রী এবং
কর্মকর্তারা তাঁদের সময়টা অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
প্রথম আলোয় খবর ছাপা হোল কোভিড নাইন্টিনের চিকিৎসায় সবচেয়ে
জরুরি যে জিনিসটি চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালগুলোতে সেই অক্সিজেনের ঘাটতি
উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল শাখা)
আমিনুল হাসানের উদ্ধৃতিও আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘অল্প সময়ে
কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাই জেলা
কমিটিগুলোকে বলা হয়েছে আশপাশে বন্ধ থাকা বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে
অক্সিজেন সিলিন্ডার সংগ্রহ করতে। আর পারলে সিলিন্ডার কিনে নিতেও বলা হয়েছে।’ কিন্তু, সেদিনের ডিজিটাল ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা
সুলতানা গৎবাঁধা ভাষ্য দিলেন : দেশে অক্সিজেন সরবরাহের কোন ঘাটতি নেই। সাংবাদিকরা সেখানে
চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ পেলে তাঁর উত্তর কী হোত সেটা জানার অধিকার দেশবাসীর রয়েছে।
অথচ, সঠিক তথ্য না দিয়ে ঢালাও সাফাই এবং কৃতিত্ব দাবির অনুশীলন চলছে।
স্বাস্থ্যসেবীদের সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য্য পিপিই পর্যাপ্ত
পরিমাণে সরবরাহে ব্যর্থতা কিম্বা হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার অব্যবস্থা নিয়ে
প্রতিদিনই যেসব চিত্র উঠে আসছে, সেগুলোরও কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা নেই। সারাদেশে কত
লাখ পিপিই বিতরণ করা হয়েছে, সেই সংখ্যাটা প্রায়ই বুলেটিনে উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু,
এসব পিপিইর কতগুলো মানসম্পন্ন এবং এগুলোতেও ডাক্তার-নার্সদের সংক্রমণ থেকে রক্ষা
করা যাচ্ছে না কেন – তার হিসাব
কোনোভাবেই মেলানো যাচ্ছে না। মানসম্মত পিপিই চোরাইপথে খোলাবাজারে চলে যাওয়া অথবা
মানহীন পিপিই হাসপাতালগুলোতে ঢুকেছে কিনা, এমন প্রশ্ন চিকিৎসাসেবী, রোগী এবং
তাঁদের পরিবারগুলোর।
গত প্রায় আট সপ্তাহ ধরে সারাদেশে মানুষের যেকোনো ধরণের অসুস্থতাই
একটি ভয়াবহ অপরাধের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে। সাধারণ বা বিশেষায়িত হাসপাতাল
কোথাও চিকিৎসা মেলে না। ডাক্তাররা কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকির কারণে চেম্বারে বসেন না।
যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন গুরুতর বা ক্রনিক রোগে ভুগছেন, তাঁদের চিকিৎসা পাওয়ার
পথগুলো রুদ্ধ হয়ে গেছে। করোনায় আক্রান্ত না হলে উপসর্গ থাকলেই ( যেগুলো অন্য বহু রোগের উপসর্গ) সব হাসপাতাল
করোনামুক্ত হওয়ার প্রমাণ ছাড়া রোগীকে ফিরিয়ে দেয়; আবার, করোনা আক্রান্ত কিনা সেই
পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা আর হয়রানির যেন শেষ নেই। করোনার পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত
সন্দেহ আছে এমন রোগীদের জন্য কোথাও চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা কেন নেই – এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবেন? চিকিৎসা না পেয়ে এভাবে
যাঁদের মৃত্যু হচ্ছে, তাঁদের অসহায়ত্বের করুণ পরিণতি বন্ধে স্বাস্থ্যবিভাগ কী
ব্যবস্থা নিয়েছে, তা জিজ্ঞাসা করার অধিকার নিশ্চয়ই সাংবাদিকদের রয়েছে? নাকি, করোনায় মৃত্যুর সরকারি পরিসংখ্যানে এসব
মৃত্যুর স্থান না পাওয়ায় তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না ?
গত ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এক
ঘোষণায় সারা দেশকে ঝুঁকির্পূণ ঘোষণা করে সবাইকে আইন অনুযায়ী সরকারি নির্দেশনাগুলো
মেনে চলার কথা বলেছেন। অথচ, দু‘সপ্তাহ
না পেরোতেই পোশাক কারখানা খুলে দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত
নেওয়া হয়েছে কিনা এবং তাঁরা কি মতামত দিয়েছেন সে সব প্রশ্নের উত্তর কোথায় মিলবে? বিশ্ব
স্বাস্থ্য সংস্থা এবং দেশীয় বিশেষজ্ঞরা সংক্রমণ
নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব
বজায় রাখার নীতি অব্যাহত রাখার কথা খোলাখুলিভাবেই বলেছেন। কিন্তু, রপ্তানি আদেশের
অজুহাতে পোশাক কারখানা খুলতে দেওয়ার ক্ষেত্রে এসব শর্তপালনের বাধ্যবাধকতা
নিশ্চিতের ব্যবস্থা কতটা নেওয়া হয়েছে? শ্রমিকরা কেউই কারখানার ব্যবস্থাপনায়
স্থানীয় আবাসনের সুবিধা পায় না। দূর-দূরান্ত থেকে নিরাপদে তাঁদের আসার জন্য
পরিবহনের ব্যবস্থা করা নিশ্চয়ই অসম্ভব ছিল না ? এখন যে ঝুঁকি তৈরি হলো তার
ব্যাখ্যা কী ?
সরকারের বিপরীতমুখী নানা পদক্ষেপের কারণে মানুষের মধ্যে
যদি বিভ্রান্তি তৈরি হয় এবং সরকারি নির্দেশনা কেউ উপেক্ষা করে তাহলে তার দায় কার ?
করোনায় আক্রান্ত হয়ে অথবা আক্রান্ত না হয়েও পরোক্ষ প্রভাবে যাঁদের মৃত্যু ঘটেছে
এবং ঘটছে তাঁদের প্রত্যেকেরই পরিবার আছে, স্বজনরা আছেন। শুধু সংখ্যা প্রকাশের
বুলেটিনে ওইসব পরিবার ও স্বজনের জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর মেলে না। সামর্থ্যহীনতা কিম্বা
সীমাবদ্ধতাগুলোর কথা আমাদের সবারই জানা প্রয়োজন। কিন্তু, গলদগুলো থেকে যাচ্ছে
আড়ালে। করোনা যে একবারে নির্মূল হবেনা সেটা মোটামুটি বৈশ্বিকভাবেই স্বীকৃত। সুতরাং,
ভবিষ্যতের শিক্ষার জন্য হলেও এসব তথ্য জানা দরকার।
(১
মে, ২০২০‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন