ঔপনিবেশিক অতীতের কুৎসিত চেহারাটার প্রতিবিম্ব দেখতে প্রস্তুত না থাকলেও
আটলান্টিক পেরিয়ে আসা বর্ণবাদবিরোধী
আন্দোলনের ঢেউ ইংল্যান্ডের তীরে আছড়ে পড়ায় ব্রিটেন আজ এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি
হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিসে পুলিশী নির্যাতনে নিহত জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার
প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠা ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের ছোঁয়ায় ব্রিটেনও আলোড়িত
হচ্ছে।
ঔপনিবেশিক শাসনে বাংলায় (বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বিহারের অংশবিশেষ) তেতাল্লিশের
( বাংলা ১৩৫০ সন) মন্বন্তরে ত্রিশ লাখ
মানুষের মৃত্যুর জন্য যাঁকে দায়ী করা হয় সেই উইনস্টন চার্চিল এর ভাস্কর্যকে দুদিন
ধরে লোহার পাত দিয়ে তৈরি আবরণে ঢেকে রাখা হয়েছে। বিক্ষোভকারীদের একাংশ এর আগে ওই
ভাস্কর্যের গায়ে ‘বর্ণবাদি ছিলেন ( ওয়াজ রেসিস্ট)‘ লিখে দিয়েছিলো। ঔপনিবেশিক নৃশংসতার এই কালো অধ্যায় আরও যাদেরকে তাড়া করে
ফিরছে, তাঁদের মধ্যে আছেন সপ্তদশ শতকের নিষ্ঠুর সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের ভাস্কর্যও।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজোদ্দৌলার পতন হয়েছিল ইস্ট
ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সৈনিকের কাছেই।
ওই সপ্তদশ শতকেই রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানির হয়ে দাস ব্যবসায় কুখ্যাতি অর্জন
করেছিলেন যে এডোওয়ার্ড কুল্স্টন গত ৭ জুন ব্রিস্টল শহরে বিক্ষোভকারীরা তার ১২৫
বছরের পুরোনো ভাস্কর্য তুলে নিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। এরপর থেকেই শুরু হয়েছে ইতিহাসের
দিকে ফিরে দেখা এবং ব্রিটেনে এতোদিন নানাভাবে সমাদৃত ও পূজিত রাজনীতিক ও সৈনিকদের
বিতর্কিত নানা অধ্যায় নিয়ে বিতর্ক । ব্রিস্টলের অশেতাঙ্গ মেয়র কুলস্টনের ভাস্কর্য
অপসারণকে ‘ঐতিহাসিক কবিতা‘ রচনার মতো বলে বর্ণনা করেছেন। যদিও তিনি বিক্ষোভে
অংশ নেন নি এবং যাঁরা এটি টেনে নামিয়ে পদদলিত করে রাজপথ হিঁচড়াতে হিঁচড়াতে নদীতে
ফেলেছেন তাঁদেরকে তিনি চেনেন না বলেন জানিয়েছেন।
বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কুলস্টনের ভাস্কর্য্ অপসারণের ঘটনাকে দুর্বৃত্তপনা
বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতী প্যাটেলও একই কথার
প্রতিধ্বনি করেছেন। প্রীতী প্যাটেল অবশ্য ভাস্কর্যগুলো রক্ষায় যথেষ্ট ভূমিকা না
নেওয়ার অভিযোগ করেছেন লন্ডন মেয়র সাদিক খানের বিরুদ্ধে। গেল সপ্তাহে লন্ডনের
টাওয়ার হ্যামলেটসে পৌর কর্তৃপক্ষের
ব্যবস্থানায় আরেকজন দাসব্যবসায়ী রাবর্ট মিলিগানের ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের ভাস্কর্য নিয়ে এখন এই বিতর্ক
নতুন মাত্রা পেয়েছে। কেননা, ব্রিটেনে গত কয়েক যুগ ধরে সবকটি জনমত জরিপে সর্বকালের
সেরা ব্রিটিশের অবস্থানটি দখল করে আছেন চার্চিল। ব্রিটেনের রক্ষণশীল জনগোষ্ঠী এবং
রাজনৈতিক দল টোরি পার্টি ও ডানপন্থী গোষ্ঠীগুলোর কাছে এটি একেবারেই অকল্পনীয়।
বিক্ষোভকারীদের ক্রোধ থেকে রক্ষার জন্য চার্চিলের ভাস্কর্যকে ইস্পাতের পাত দিয়ে
ঘিরে আড়াল করার এই দৃশ্যে ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন একে অদ্ভূত এবং
লজ্জাস্কর বলে অভিহিত করেছেন।ডানপন্থী পত্রিকাগুলোর প্রচ্ছদে উঠে এসেছে এবং তাদের
শিরোনামগুলোয় আছে ব্স্মিয় এবং ক্ষোভ। ডেইলি মেইল বলেছে ‘আমাদের শ্রেষ্ঠ নায়ককে মুক্ত করে দাও‘। ‘সমাধিস্থ: চার্চিল, যিনি ব্রিটেনকে বাঁচিয়েছিলেন‘ শিরোনাম দিয়েছে ডেইলি এক্সপ্রেস। টেলিগ্রাফের প্রথম পাতায় চার্চিলের পৌত্র
স্যার নিকোলাস সোমস এর লেখার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘আমরা আমাদের নৈতিক
নির্দেশক হারিয়েছি‘। আর গার্ডিয়ান লিখেছে ‘প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে বরিস ভীতি ও বিভাজন উসকে দিচ্ছেন‘।
ঔপনিবেশিক অতীত নিয়ে এই বিভাজন ও বিতর্ক বাড়তে থাকার পটভূমিতে পুলিশ বাড়তি
সতর্কতা গ্রহণ করেছে। ডানপন্থী কয়েকটি গোষ্ঠী ইতোমধ্যে পাল্টা প্রতিবাদ ডেকেছে এবং
পার্লামেন্ট স্কোয়ারে নেলসন ম্যান্ডেলা ও মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্যগুলোও একইভাবে
ইস্পাতের বেড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য, মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্য গতসপ্তাহেই
ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনকারীদের একাংশের রোষের শিকার হয়। দক্ষিণ আফ্রিকায়
তাঁর ভূমিকা বর্ণবাদী ছিল এমন অভিযোগই এর কারণ।
ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক অতীতের বর্ণবাদী চরিত্রই এই চলমান আন্দোলনে প্রধান বিষয়
হয়ে উঠছে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও লেখক ( দ্য অ্যানার্কি: দ্য রিলেন্টলেস রাইজ অব দ্র
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বইয়ের লেখক) উইলিয়াম ডারিমপিল গার্ডিয়ান পত্রিকায় লিখেছেন
লন্ডনের সরকারের প্রাণকেন্দ্র হোয়াইট হলে তষ্কর ও বর্ণবাদী রবার্ট ক্লাইভের কোনো স্থান
হতে পারে না। তার আমলেই বাংলার সম্পদ লুন্ঠন হয়েছে। তাঁর মতে হোয়াইট হল থেকে
ক্লাইভের ভাস্কর্য অপসারণের মাধ্যমে ঔপনিবেশিক আমলের বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণ এবং
প্রায়শ্চিত্ত শুরু হতে পারে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে
ঐতিহাসিক ডারিমপিল বলেছেন যে রবার্ট ক্লাইভ বর্ণবাদী ছিলেন , কারণ তিনি ভারতীয়দের
বিশেষ করে মুসলমানদের নীচু জাতের ভাবতেন। কোম্পানির পরিচালকদের কাছে লেখা ১৯৫৮
সালের এক চিঠিতে মুসলমানদের সম্পর্কে তাঁর এই মনোভাবের যে প্রমাণ মিলেছে তিনি তাও
উল্লেখ করেছেন। ক্লাইভের আরো একটি ভাস্কর্য আছে, তাঁর জন্মস্থান শ্রুসবেরিতে এবং
সেখানেও এটি অপসারণের দাবিতে প্রচার চলছে।
বর্ণবাদ, দাসব্যবসা এবং বিতর্কিত রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে রাজনীতিক ও
সেনাপতিদের এসব ভাস্কর্য এখন সরিয়ে নিয়ে জাদুঘরে স্থানান্তরের প্রস্তাবও আলোচনায়
উঠেছে। জনপরিসরে এগুলো মানুষের কাছে ভুল বার্তা দেয় এবং তাঁরা ইতিহাসবর্জিত
শ্রদ্ধা বা সমীহ লাভ করেন। কিন্তু, জাদুঘরে ইতিহাস শিক্ষার অংশ হিসাবে এগুলো স্থান
পেলে ইতিহাসের দায় কিছুটা হলেও পূরণ হতে
পারে বলে অভিমত ক্রমশই জোরালো হচ্ছে। লন্ডন এবং ব্রিস্টলের মেয়ররা একই মতামত
দিয়েছেন। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠন ইমরান আয়টনও এগুলো জাদুঘরে
পাঠানোর কথা বলেছেন।
চার্চিলের এক পৌত্রী এমা সোমস বলেছেন যে বিক্ষোভ এভাবে চলতে থাকলে ভাস্কর্যটিকে
জাদুঘরে পাঠানো প্রয়োজন হতে পারে। ভাস্কর্যটি ইস্পাতের আবরণে মুড়িয়ে রাখায় ক্ষোভ ও
বিস্ময় প্রকাশ করলেও তিনি স্বীকার করেন যে তাঁর দাদু যে ভাবনা পোষণ করতেন তা হয়তো
আজকের বাস্তবতায় অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু, তখন সেরকম ছিল না। চার্চিলের বিরুদ্ধে বর্ণবাদের
যে অভিযোগ তার কেন্দ্রেও আছে বাংলা এবং তেতাল্লিশের মন্বন্তর। বাংলায় দুর্ভিক্ষ
সত্ত্বেও তিনি খাদ্যের চালান বাংলায় যেতে না দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের জন্য
পাঠিয়েছিলেন। উপরন্তু খাদ্য সংকটের জন্য তিনি ভারতীয়দের ‘খরগোশের মত বংশবৃদ্ধি‘কে দায়ী করেছিলেন।
ভাস্কর্য বিতর্কে আরও যাঁদের নাম এসেছে তাঁদের মধ্যে আছেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে
থাকা দাস ব্যবসায়ী লর্ড সেসিল এবং বিশ্বে স্কাউটিং আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা লর্ড ব্যাডেন
পাওয়েল। ব্যাডেন পাওয়েলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ফ্যাসিবাদকে সমর্থনের এবং ব্রিটেনের পুল
শহরে তাঁর ভাস্কর্য্যটিও অপসারণের দাবি এখন জোরদার হচ্ছে। তবে, এই আন্দোলন
ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক ইতিহাস পাঠে বাধ্য করায় কতটা সফল হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
কারণ, বিষয়টি রাজনৈতিক বিভাজনকে প্রসারিত করলে তার পরিণতি সুখকর নাও হতে পারে।
(১৩ জুন, ২০২০ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন