করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবিলায় বাংলাদেশে যা হচ্ছে তাকে অন্ধকারে ঢিল
ছোড়ার মতো বলে বর্ণনা করেছেন চীনা বিশেষজ্ঞদলের নেতা ডা. লি ওয়েন ঝিও। বাংলাদেশে
নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দেওয়ার জন্য এই বিশেষজ্ঞদল গত প্রায়
সপ্তাহ দুয়েক ধরে অবস্থান করছে এবং বিভিন্ন হাসপাতালের পরিস্থিতি, রোগ শনাক্তকরণ
পদ্ধতি সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। তাঁরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের
সঙ্গেও মতবিনিময় করেছেন। এসপ্তাহেই তাঁরা দেশে ফিরে যাবেন। ডা. লির কাছে যুগান্তর
পত্রিকা জানতে চেয়েছিল বর্তমানে বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ কোন মাত্রায় আছে
এবং ভবিষ্যতে এর চেয়েও ভয়াবহ হবে কিনা? যাতে না হয় সেক্ষেত্রে চীনের পরামর্শ কী
হবে? এছাড়া যদি হয় তাহলে চীন কিভাবে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে পারে?
প্রশ্নগুলো আমাদের সবার। তবে, এরকম নিষ্ঠুর সত্য উচ্চারণ করা এখন যে
ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে তার আলামত মেলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তারের হিড়িক
দেখে। ফেসবুকে সমালোচনামূলক মন্তব্যের কারণে আওয়ামী লীগে সক্রিয় রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের পরিণতির কথা মোটামুটিভাবে বেশ আলোচিত হয়েছে। প্রতিদিনই
এরকম অনেকে গ্রেপ্তার হচ্ছেন, যাঁদের কথা আলোচনায় নেই এবং আমরা অনেকেই তাঁদের কথা
জানি না। তবে, সে প্রসঙ্গ থাক। চীনা বিশেষজ্ঞ লির বক্তব্য কী ছিল সেটা আগে জেনে
নেওয়া যাক। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রায় ১৫ সপ্তাহ পর একটা নির্মোহ ও
বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন পাওয়া যায় এই সাক্ষাৎকারে (বাংলাদেশে অন্ধকারে ঢিল
ছোড়ার মতো কাজ হচ্ছে, দৈনিক যুগান্তর, ২০ জুন, ২০২০)।
ডা. লি বলেছেন ‘চীন ও
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। চীনে যেটা হয়েছে যে, শত্রু কোথায় অর্থাৎ করোনাভাইরাস
কোথায় আছে সেটা আমরা জানি। ফলে শত্রু দমনে আমরা সুরক্ষা মেনে যথাযথভাবে কাজ করতে
পেরেছি। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি আলাদা। এখানে সমস্যা হল- করোনাভাইরাস কোথায়
আছে সেটাই জানা দুষ্কর। বলা যায়, জানা যাচ্ছে না। এখানে কাজ হচ্ছে অনেকটা অন্ধকারে
ঢিল ছোড়ার মতো। এভাবে ভাইরাস মোকাবেলা করা সত্যি দুষ্কর। আমরা মনে করি, যদি
কার্যকর লকডাউন, দ্রুত পরীক্ষা, কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং ও চিকিৎসার পরিধি বাড়ানো যায়
তবে উত্তরণ সম্ভব। তাছাড়া চীনের আর্থসামাজিক কাঠামো বাংলাদেশের চেয়ে ভিন্ন। চীনে
লকডাউন মানে শতভাগ লকডাউন। করোনা উপদ্রুত এলাকাগুলোকে উচ্চ ঝুঁকি, মাঝারি ঝুঁকি ও
স্বল্প ঝুঁকি এলাকায় ভাগ করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। চীন কন্ট্রাক্ট
ট্রেসিং প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ভালো ফল পেয়েছে। যাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন
করা হয় তাদের সার্বক্ষণিক পরিস্থিতি মনিটর করা হয়। ফলে, উপসর্গ অনুযায়ী তাদের
দ্রুত চিকিৎসার আওতায় আনা সহজ হয়েছে।‘
করোনা প্রতিরোধে বাংলাদেশের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা সম্পর্কে অন্য এক
প্রশ্নের উত্তরে ডা. লি ভাইরাস মোকাবেলায় যেসব ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে
জানিয়েছেন সেগুলো অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞদের
পরামর্শের মতই। তিনি পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানোর বিষয়ে তা ইউনিয়ন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার
কথা বলেছেন। আর বলেছেন দক্ষতা বাড়ানোর কথা। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিতের
জন্য পিপিই পরা থেকে শুরু করে সুরক্ষার জন্য যত বিষয় আছে সব বিষয়ে আরও প্রশিক্ষণের
কথা বলেছেন।
বাংলাদেশে ভাইরাসের সংক্রমণ চিহ্নিত হওয়ার প্রায় চার মাস বা পনেরো
সপ্তাহ পর পরিস্থিতি অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার মত। এরকম দুরবস্থা অন্য দু-চারটে দেশে যে
হয়নি, তা নয়। তবে, সেজন্যে সেসব দেশে অনেককে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। জিম্বাবুয়েতে
চিকিৎসকদের ব্যাক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) কেনায় দূর্নীতির জন্য
স্বাস্থ্যমন্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। মহামারির গোড়ার দিকে গত মার্চেই যথাযথ
ব্যবস্থা নিতে না পারার দায়ে কসোভোয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদে আস্থা ভোটে হেরে
গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগও করতে হয়েছে। আমাদের কথা অবশ্য আলাদা। মহামারি শুরুর
পর থেকে রাজনীতিকরা কার্যত নিষ্ক্রিয় – মন্ত্রীসভার চারভাগের এক মন্ত্রীও গণছুটির সময়ে সক্রিয় ছিলেন কিনা তা
বোঝা যায়নি। সংকটমুক্তির জাতীয় উদ্ধার কার্যক্রমে চালকের আসনে আছেন আমলারা।
কিন্তু, পরিকল্পনাহীনতা, প্রস্তুতিশূণ্য বাগাড়ম্বর ও
নানাধরণের দূর্নীতির অভিযোগের পরিণতি হয়েছে পদোন্নতি আর বদলি।
করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা কিম্বা যেকোনোধরণের
চিকিৎসার জন্য সাধারণ মানুষের হয়রানি এবং দূর্ভোগের যেসব ছবি গণমাধ্যমে উঠে আসছে
তাতে অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার লক্ষণগুলো অবশ্য বুঝতে কষ্ট হয় না। সমালোচক আর ভিন্নমত
প্রকাশকারীদের দমনের বাড়াবাড়ি পুলিশী ব্যবস্থাও তার অন্যতম লক্ষণ। বাস্তবতা যে
ছবির চেয়েও কঠিন, তা কেবল তাঁরাই বুঝতে পারছেন, যাঁরা করোনা অথবা করোনা নয়, কিন্তু
গুরুতর অসুস্থতার শিকার হচ্ছেন। ভিআইপিদের সিএমএইচে স্থান সংকুলান হবে এমন ধারণাও
যখন ভুল প্রমাণিত হয়েছে, তখন তিনমাস বসিয়ে রাখা শেখ রাষের গ্যাস্ট্রোলিভার
হাসপাতাল তাঁদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বিত্তবানদের চিকিৎসার প্রয়োজন মেটাতে এখন
পালাক্রমে শহরের তারকাওয়ালা হাসপাতালগুলোয় করোনা চিকিৎসার ব্যবস্থা হচ্ছে।
প্রভাবশালী পেশাগুলোর সদস্যদের জন্যও আলাদা আলাদা কিছু করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু,
সীমিতসংখ্যক সরকারি হাসপাতালগুলোয় সাধারণ মানুষের উপচে পড়া ভিড় সামলানোর প্রশ্ন
আসলে সব তৎপরতা যেন থমকে যাচ্ছে।
নতুন স্থায়ী/অস্থায়ী হাসপাতাল বানানো, আইসিইউ
প্রতিষ্ঠা, ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করার প্রকল্প হচ্ছে বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন
ব্যাংকের মতো বিদেশি দাতাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতির দিকে তাকিয়ে। অথচ, এসব কাজ
ছমাস আগে জানুয়ারিতে শুরু করার কথা না ভাবতে পারলেও, মার্চ-এপ্রিলে উদ্যোগ নেওয়া
হলে এতোদিনে সেগুলো সচল হয়ে যেতো। ‘আগে খরচ, পরে আয়ের
চিন্তা‘ এমন অঙ্গীকার প্রবৃদ্ধির স্বপ্ন পূরণের জন্য ঘোষিত হতে পারলে মহামারি থেকে
মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য কেন উচ্চারিত হয়নি, সেই প্রশ্ন নিশ্চয়ই উপেক্ষণীয় নয়।
সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা
করায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে গেছে বলে একটি ভাষ্য প্রতিষ্ঠারও চেষ্টা চলছে। কিন্তু,
যাঁরা একথা বলছেন তাঁরা এই সত্যটি আড়াল করছেন যে বিভ্রান্তিকর এবং পরস্পরবিরোধী তথ্য
ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার কারণেই সাধারণ মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছিল। সবচেয়ে বড়
যে সত্যটি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে তাহোল দায়িত্বশীলদের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতা। নিজেদের সামর্থ্যের
ঘাটতি কাটানোর জন্য প্রশাসন এবং দলের বাইরে আরও যাঁদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা রয়েছে তাঁদেরকে
সংগঠিত করার কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। গত তিন থেকে পাঁচ বছরে যেসব সরকারি ডাক্তার ও
নার্স অবসরে গেছেন তাঁদেরকে জাতীয় প্রয়োজনে কাজে ফিরিয়ে আনার মত ন্যূনতম উদ্যোগও নেওয়া
হয়নি।
দলীয় সংর্কীণতার উর্ধ্বে উঠতে পারলে
যে মানবিক দায়িত্ব পালন কতটা অর্থবহ হতে পারে তার নজির দেখা গেছে নারায়ণগঞ্জে বিএনপির
একজন কাউন্সিলর এবং অন্য একজন নেতার স্বেচ্ছায় করোনায় মৃতদের দাফন-সৎকারের কাজে। স্বেচ্ছাসেবায়
সারা দেশে এগিয়ে এসেছেন অসংখ্য প্রতিষ্ঠান এবং মানুষ। সংকট মোকাবেলায় একটা জাতীয় ঐক্যের
একটি রাজনৈতিক উদ্যোগ এক্ষেত্রে আরও অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারতো। অথচ, সেই দাবি
উপেক্ষিত হয়েছে। উপরন্তু, সরকারের ভূল-ভ্রান্তি তুলে ধরার পরিণতি হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা
আইনের অপপ্রয়োগ আর বিরোধীদের নিন্দা।
সমালোচনা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সারা
বিশ্বেই রাজনীতিচর্চার একটি স্বীকৃত বিষয়। এমনকি, রাজনীতিকরা মৃত্যুর পরেও সমালোচনার
স্বীকার হয়ে থাকেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট হিটলারের বিরুদ্ধে বিজয়ী নেতাদের মধ্যে উইনস্টন চার্চিলকে ঘিরে এখন
কীধরণের বিতর্ক হচ্ছে তা নিশ্চয়ই কারো দৃষ্টি এড়ায়নি। আরেক নেতা জোসেফ স্তালিনকে এখন
রাশিয়াতেও অনেকে নিষ্ঠুর কসাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। সুতরাং, মহামারির কালে সমালোচক
কিম্বা সাংবাদিকদের জেলে ভরে সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য
নয়।
(২২ জুন, ২০২০‘র
প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন