সদ্য প্রয়াত লতিফুর
রহমানের প্রধান পরিচয়, তিনি একজন সফল উদ্যোক্তা ও শিল্পপতি। ব্যবসায়ে উঁচুমানের
নৈতিকতার নজির স্থাপনের জন্য অন্য আর সব ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের থেকেও তিনি একেবারেই
আলাদা। তাঁর অনেক মানবিক গুণাবলী ছিল, যা এখনকার দিনে সফল ব্যাক্তিদের ক্ষেত্রে – বিশেষত ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিরল। সুতরাং,
শিল্প-বাণিজ্যের জগতে তাঁর অনুপস্থিতি আগামী দিনগুলোতে যে অনুভূত হবে, তা
নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তবে সংবাদপত্র শিল্প এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর
অভাব বাংলাদেশে সম্ভবত কোনোদিনই পূরণ হবে না।
উদ্যোক্তা
হিসাবে তিনি যে প্রকল্পেই হাত দিয়েছেন, তা ঈর্ষণীয় সাফল্য পেয়েছে। তাঁর সৃষ্ট ১৬টি
প্রতিষ্ঠানে ১৭ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তিনি বছরের পর বছর সেরা
করদাতার স্বীকৃতি পেয়েছেন – এগুলো সবই তাঁর
গুরুত্বপূর্ণ অবদান। তবে, আমার বিবেচনায় তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান – স্বাধীন
সাংবাদিকতার পৃষ্ঠপোষকতা এবং তার সুরক্ষায় অনড় থাকা।
বাংলাদেশের
ইতিহাস বলে অতীতে যাঁরা সংবাদপত্র প্রকাশ করেছেন, তাঁদের অধিকাংশেরই উদ্দেশ্য ছিল
দুটো – রাজনীতি অথবা
বাণিজ্যিক স্বার্থ। মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিষ্ট পার্টি, জাসদ – সবারই নিজস্ব পত্রিকা ছিল। ইত্তেফাক,
সংবাদ, আজাদ, মিল্লাত, জনপদ, গণকন্ঠ – এগুলো সবই ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সংবাদপত্র। পাশাপাশি
ছিল সরকারি পত্রিকা। এরপর, ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে সংবাদপত্র প্রকাশের পথে এগিয়ে
আসেন। তাঁদের অনেকেরই উদ্দেশ্য ছিল পত্রিকার প্রভাবের সিঁড়ি বেয়ে মন্ত্রী হওয়া,
নয়তো ব্যবসা-বাণিজ্যে বাড়তি সুবিধা আদায়। সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনের ক্ষেত্রে সেই
ধারা এখনও অব্যাহত আছে। লতিফুর রহমান আবির্ভূত হলেন ব্যাতিক্রম হিসাবে। সংবাদপত্রে
বিনিয়োগ করেছেন, কিন্তু প্রকাশক অথবা সম্পাদক হিসাবে নিজের বা তাঁর পরিবারের কারো
নাম ছাপা হয়নি – এরকম আর কোনো
পত্রিকার কথা আমি এখনো মনে করতে পারি না। কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে নেপথ্যে থেকেছেন
এবং সাংবাদিকতার বিষয়টিতে পেশাদার সাংবাদিকদের দিয়েছেন পূর্ণ স্বাধীনতা।
প্রথম আলো এবং
ডেইলি স্টার উভয় পত্রিকাই বস্তুনিষ্ঠতার সঙ্গে দলনিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়ার কারণে সব
সরকারের বিরাগভাজন হয়েছে। বিস্ময়করভাবে দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারও এক্ষেত্রে
কোনো ব্যাতিক্রম ছিলো না। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে প্রথম
আলো। কেননা, কাগজটি বাংলায় এবং সেকারণে তা পৌঁছায় সর্বাধিক মানুষের কাছে – দেশের বাকী সব সংবাদপত্র থেকে যা অনেক
অনেক বেশি এগিয়ে। যে পত্রিকাগুলোর কারণে তিনি বারবার রাষ্ট্র এবং সরকারের কাছে চরম
হেনস্থার শিকার হয়েছেন, সেই অন্যায় চাপের মুখেও তিনি তাঁর পত্রিকাগুলোর স্বাধীন
সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপ করেন নি।
পারিবারিক
জীবনে কন্যা এবং নাতিকে হারানোর মত ট্রাজেডিতে ক্ষত-বিক্ষত যে মানুষটির দৃঢ়চেতা
মনোবল অটুট থেকেছে, তাঁকে বোঝা সহজ নয়। দলনির্বিশেষে ক্ষমতাসীনদের ভয়ভীতি তাঁকে
একটুও বিচলিত করেনি। গতবছরেও সম্পদের হিসাব দেওয়ার জন্য তলব করা হলে ডাক্তার সঙ্গে
নিয়ে তাঁকে দূর্নীতি দমন কমিশনে যেতে হয়েছিল। গত এক দশকে সংসদে তাঁর বিরুদ্ধে কম
বিষোদগার হয়নি। কথিত এক- এগারোর সরকারের সময়েও তাঁর ট্রান্সকমের দপ্তর থেকে গাড়িতে
করে নথিপত্র নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বছরখানেক ধরে নানাধরণের নিরীক্ষার নামে তাঁকে
ফাঁসানোর চেষ্টা হয়েছিল। প্রতিদ্বন্দী না হলেও ঈর্ষাকাতর বাণিজ্যিক গোষ্ঠী তাঁর
বিরুদ্ধে রাজনৈতিক চাপ বাড়তে থাকার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টায় সংগঠিতভাবে অপপ্রচারও
চালিয়েছে। কিন্তু, তিনি আপোষের কথা ভাবেন নি। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার কোনো
পত্রিকাতেই সংবাদ কিম্বা মতামত প্রকাশের বিষয়ে তাঁর কোনো হস্তক্ষেপ ঘটেনি। স্বাধীন
সাংবাদিকতার প্রতি তাঁর এই যে বিশ্বাস এবং সুদৃঢ় সমর্থন, সাংবাদিক হিসাবে আমাদের
কাছে এটিই তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। তাঁর উত্তরসুরিরা এই একই নীতি অনুসরণ করলে
বাংলাদেশ যেমন লাভবান হবে, তেমনই তাঁর কৃতিত্বও দীর্ঘস্থায়ী হবে।
বাংলাদেশে এখন
অনেক ব্যবসাসফল ব্যাক্তি আছেন। কিন্তু, লতিফুর রহমানের স্বকীয়তা চোখে পড়ার মতন। তার
কেন্দ্রে আছে তাঁর অনবদ্য দেশপ্রেম । বহুবার তিনি গর্বের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন, ‘আমরা
বাংলাদেশের মানুষ, এ দেশের প্রতি আমার আস্থা আছে। আমরা কখনো অন্য দেশের
নাগরিকত্বের আবেদন করিনি‘। স্বাধীনতার পর যাঁদের বিত্ত-বৈভব গড়ে উঠেছে
তাঁদের অধিকাংশেরই পাশ্চাত্যে, নাহলে মধ্যপ্রাচ্য বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয়
নিবাস রয়েছে। তিনি সেপথে পা বাড়ান নি। স্বাধীন সংবাদপত্রের প্রতি তাঁর অঙ্গীকারের
ভিত্তিও সম্ভবত এই দেশপ্রেম। কেননা, স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ছাড়া কোনো দেশই পরিপূর্ণতা
পায় না।
তাঁর সঙ্গে
আমার পরিচয়ের সূত্রও সাংবাদিকতা। বিবিসি রেডিওর হয়ে বহুবার তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি টেলিফোনে। তবে,
মুখোমুখি প্রথম দেখা হয়েছে ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ে ২০১৩ সালে। ঢাকায় থাকার সময়ে
পরের কয়েকবছরেও বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। তবে, এগুলোর মধ্যে দুটি সাক্ষাৎ বিশেষভাবে
উল্লেখ করার মত। ২০১৩‘র নভেম্বরে
প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বহু খ্যাতিমান বিদেশি অতিথির সমাগম
ঘটেছিল। এঁদের মধ্যে ছিলেন ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার, ঢাকায় ভারতের
সাবেক হাইকমিশনার দেব মূখার্জি, প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ, মিশরের
আল আহরাম পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামাল আলী গাবাল্লা, ভারতের টাইমস অব
ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রবীন্দ্র ধারিওয়াল, আনন্দবাজার পত্রিকার বার্তা
সম্পাদক হীরক বন্দোপাধ্যায়, নেপালের কাঠমান্ডু পোস্টের বার্তা সম্পাদক মুকুল
হুমাগিন, প্রথম আলোর দিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দোপাধ্যায়সহ আরও দু‘তিনজন ভারতীয় সাংবাদিক। সম্পাদক মতিউর
রহমান তখন আমাকেও লন্ডন থেকে আসতে বলেন। ঢাকায় প্রথম আলোতে যোগ দিতে উৎসাহিত করাই ছিল
সম্ভবত তাঁর উদ্দেশ্য। সেবারই এসব অতিথির সঙ্গে লতিফুর রহমানের বাড়িতে নৈশভোজের
আমন্ত্রণ। প্রত্যেক অতিথির প্রতি তাঁর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক
আতিথেয়তা ভোলার নয়।
এরপর অনেকবারই
নানা উপলক্ষ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে এবং প্রতিবারই তিনি এগিয়ে এসে খোঁজ-খবর
নিয়েছেন। একবার সিএ ভবনে প্রথম আলোর বোর্ডরুমে নানা প্রসঙ্গ আলোচনার মধ্যে সাংবাদিকতার
চ্যালেঞ্জ এবং বিভিন্ন দেশে সংবাদপত্র শিল্পের সংকটের বিষয়েও কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ানের মত পত্রিকাগুলোর কথা ওঠে। সাংবাদিকতার প্রয়োজন যে
ফুরায় নি, বিশেষত মানসম্পন্ন সাংবাদিকতা – তিনি সেকথাও বললেন। জীবদ্দশায় তাঁর লক্ষ্য ছিল প্রথম আলো এবং ডেইলি
স্টারের আরও প্রসার, আরও সমৃদ্ধি। কিন্তু, সেটা যতটা না নিজের বিনিয়োগ সুরক্ষায়,
তার চেয়ে বেশি ছিল স্বাধীন সাংবাদিকতার টেকসই বিকাশের লক্ষ্যে।
ব্যাক্তিগত স্মৃতির
চেয়েও গুরুত্বর্পূণ হলো তাঁর কীর্তি ও মূল্যবোধকে স্মরণ করা এবং সেগুলো ধারণ ও সংরক্ষণ
করা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিশ্চয়ই সেগুলোর চর্চা হবে।
কিন্তু, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তাঁর যে অবদান তার গুরুত্ব একেবারেই
আলাদা। এটি বিশেষভাবে সত্য আমাদের দেশের পটভূমিতে। সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের
স্বাতন্ত্র্যকে যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে তিনি দুটো ভাষায় দেশের সবচেয়ে সফল দুটো
পত্রিকা প্রতিষ্ঠা করেছেন ও সংবাদপত্র শিল্পের একটি নতুন মান নির্ধারণে
পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। আর, এই পত্রিকা দুটির কারণে ব্যাক্তিগতভাবে নানাধরণের চাপ ও
হয়রানির মুখেও আপোষহীনতায় অনমনীয় থেকেছেন। এই দুই অনন্য কৃতিত্বের জন্য বাংলাদেশের
সংবাদপত্রের ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
(৬ জুলাই, ২০২০‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন