সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শ্রিংলার সফর টিকা কূটনীতির চেয়েও বেশি

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা ঢাকায় হঠাৎ এবং ঝটিকা সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। প্রতিবেশির দূতকে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ দেওয়ার মাধ্যমে করোনা মহামারিকালে বিদেশি অতিথিদের গণভবনে প্রবেশের নিয়ন্ত্রণ প্রায় প্রায় ছয়মাস পর প্রথমবারের মতো আলগা হওয়ায় সবার কৌতুহল একটু বেড়েছে। সচিব পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় একটি বৈঠকও হয়েছে। দ্বিতীয় বৈঠকটির আলোচ্যবিষয়গুলো নিয়ে উভয় দেশের তরফেই বিবৃতি এবং বক্তব্য দেওয়া হলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে কোনো তরফেই কিছু বলা হয়নি। সুতরাং, সফর ঘিরে কিছুটা রহস্য এবং নানাধরণের জল্পনা ও আলোচনা চলছে।

এমনটি হতে পারে যে বার্তাবাহকের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য বিনিময়ের বাইরে আর কিছুই আলোচনা হয়নি। তবে, সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো কোনো খবরে এই সাক্ষাৎ ঘন্টাখানেক স্থায়ী হওয়ার যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে তাতে ইঙ্গিত মেলে কিছু না কিছু আলোচনা হয়েছে। অতীতেও দেখা গেছে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা খুব একটা খোলাসা করতে চান না এবং দেশীয় সংবাদমাধ্যম কিছুটা স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণের কারণে স্পর্শকাতর বিষয়ের গভীরে প্রবেশ থেকে বিরত থাকে। বিপরীতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের কাছে সেদেশের কূটনীতিকরা যেমন উদার হন, তেমনই তারাও কিছুটা গভীরে ঢোকার চেষ্টা করে। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। ভারতের ১৩২ বছরের পুরোনো পত্রিকা দ্য ট্রিবিউন লিখেছে গোয়েন্দা সহযোগিতা জোরদার, কোভিড এর টিকা ভাগাভাগি এবং ভারতের সহায়তায় নির্মাণাধীন বেশ কিছু প্রকল্প আগামী বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার বিষয় এই সফরে আলোচনা হয়েছে।

গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং সহযোগিতার বিষয়ে পত্রিকাটি লিখেছে রোহিঙ্গা শিবিরে দারিদ্রের কারণে অপরাধ এবং মৌলবাদের বিস্তারের কারণে ভারত বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছে। একইসঙ্গে, পত্রিকাটি বলছে পাকিস্তান এই রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে তাদের নেটওয়ার্ক পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা করছে বিধায় ভারত এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা শিগগিরই বৈঠকে মিলিত হবেন। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মধ্যে দুটো প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার কথা পত্রিকাটি উল্লেখ করেছে  - আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ এবং খুলনার তাপবিদ্যূৎ প্রকল্প। এছাড়া, দুইদেশের মধ্যে অচিরেই বিমান চলাচল শুরু করার বিশেষ ব্যবস্থার বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। কথা হয়েছে নৌপথে মালামাল পরিবহন প্রশ্নে। 

ভারতের আরেকটি সংবাদমাধ্যম জি নিউজ জানিয়েছে কোভিড ১৯ টিকার পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। ভারত সেই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। জি নিউজ বলছে বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় দেশ যারা ভারতের টিকা পরীক্ষার প্রস্তাব করেছে। এর আগে ভুটান এই প্রস্তাব দিয়েছে বলেও তারা জানায়। ভারতে বর্তমানে তিনটি টিকার পরীক্ষা চলছে। এগুলো হচ্ছে সেরাম ইনিস্টিউটে অক্সফোর্ডের টিকার পরীক্ষা, ভারতের বায়োটেক ও ইন্ডিয়ান মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের এবং ভারতীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি যিডাস ক্যাডুলার টিকা । স্ক্রল ইন্ডিয়া অবশ্য বলছে যে বাংলাদেশকে চীনা টিকার পরীক্ষায় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকতে ভারত রাজি করানোর পর ঢাকার তরফে ভারতীয় টিকার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। স্ক্রল ইন্ডিয়া আরও বলছে যে ভারত এখন মানবদেহে তাদের স্বদেশী উদ্ভাবন, কোভ্যাক্সিন এর পরীক্ষা চালাচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনের বক্তব্যেও স্পষ্ট হয়েছে যে বাংলাদেশ ভারতীয় টিকার পরীক্ষাতেই অংশগ্রহণ করতে চেয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের এসব তথ্য সহজে নাকচ করা যায় না। রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু শিবির ঘিরে অপরাধ এবং রাজনীতি দুটোই যে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কক্সবাজারে মাদকবিরোধী অভিযানের পুলিশের বেপরোয়া হয়ে ওঠার পরিণতিতে সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহার বিচারবর্হিভূত হত্যা আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে যে সংকটের জন্ম দিয়েছে, তাতে অন্যদের জড়িত হওয়ার আশংকা থেকেই যায়। পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন অবশ্য বলেছেন আগামী বছরে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্বগ্রহণের পর ভারত যাতে রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশকে সহায়তা করে তাঁরা সেই সহযোগিতা চেয়েছেন। এখানে অবশ্য উল্লেখ করা ভালো যে রোহিঙ্গা প্রশ্নে আজ অবধি ভারত কোনো আর্ন্তজাতিক ফোরামে  বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেয়নি।

একইভাবে, কোভিডের টিকা পরীক্ষার বিষয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি যে প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসছে তা হচ্ছে চীনা টিকার পরীক্ষার বিষয়ে প্রস্তুতি এবং বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলের সম্মতি সত্ত্বেও প্রায় এক মাসেও সরকার কেন তার অনুমোদন দেয়নি? অক্সফোর্ডের টিকার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়টি ভারতের ওপর নির্ভরশীল হবে কেন ? এটি তো ব্রিটেন এবং অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রোজেনকার সঙ্গে অংশীদারিত্বের বিষয় ? ভারতের টিকার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশ আগ্রহ প্রকাশের আগে উদ্ভাবন এবং পরীক্ষায় এগিয়ে থাকা অন্যান্য উদ্যোগগুলোয় শরীক হওয়ার চেষ্টা কি করা হয়েছে ?  

 পররাষ্ট্রসচিব শ্রিংলার সফরের আরেকটি লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল বাংলাদেশের উচ্ছাস। শ্রিংলার বাংলাদেশ সফরকে খুবই খুশির খবর বলে অভিহিত করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একেএ মোমেন। টিকা কূটনীতিতে স্বত:প্রণোদিত হয়ে ভারতকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়াই কি সেই আনন্দের কারণ? নাহলে, প্রধানমন্ত্রীর জন্য বার্তা বহনকারীর সফর ঘিরে এতো উচ্ছাসের কি আছে ? দিল্লির জওয়াহেরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক হ্যাপিমন জ্যাকব কয়েকবছর আগে লিখেছিলেন , নয়াদিল্লির আধুনিককালের রাজতন্ত্রের মত আচরণ করা উচিত নয়, প্রতিবেশি দেশগুলোতে নিযুক্ত ভারতীয় কূটনীতিকদের আধুনিকযুগের ভাইসরয় ভাবা বন্ধ করা উচিত ( লুজিং দ্য নেবারহুড, দ্য হিন্দু, ১৮ মে, ২০১৬)। মি শ্রিংলার সফরে প্রশ্ন উঠতে পারে যে আমরাই উল্টো তা ভাবলাম কিনা?

(২০ আগস্ট ২০২০ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...