সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

অক্সফোর্ডের টিকায় বিনিয়োগ ও কিছু প্রশ্ন

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির উদ্ভাবিত টিকা বাংলাদেশ পাবে, খবরটি অনেককেই উৎফুল্ল করবে, সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, বেক্সিমকো ২৮ অগাস্ট ঘোষণা করেছে, অক্সফোর্ড এর টিকার উৎপাদনকারী কোম্পানি অ্যাস্ট্রোজেনকা ভারতে যে উৎপাদন সহযোগী নিয়োগ করেছে সেই সেরাম ইনিস্টিটিউটের সঙ্গে এবিষয়ে একটি চুক্তি হয়েছে। চুক্তিটি বিনিয়োগ চুক্তি বলেও বেক্সিমকো উল্লেখ করেছে এবং বলেছে এর ফলে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। বেক্সিমকো আরও বলেছে আগাম বিনিয়োগ করার কারণে কম খরচে টিকা পাওয়া যাবে।

বাংলাদেশে সরকার চীনের উদ্ভাবিত সিনোভ্যাক টিকার তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার একদিন পরই বেক্সিমকোর এই ঘোষণা পাওয়া গেলো। স্মরণ করা যেতে পারে, মানবদেহে চীনা টিকার পরীক্ষার অনুমতির বিষয়টি প্রায় এক মাস ঝুলে ছিল। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল সিনোভ্যাকের প্রস্তাবের সব খুঁটিনাটি পর্যালোচনার পর গত ২০ জুলাই তাদের সম্মতির কথা জানায়। চীন গত জুলাই মাসেই জানিয়েছিল তারা বাংলাদেশকে টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেবে। এরপর ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় চীনা টিকার পরীক্ষায় অংশগ্রহণ থেকে বাংলাদেশকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে বলা হয় যে বাংলাদেশ যাতে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায় ভারত তাতে সহায়তা করবে।

দুই দেশের মধ্যে যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ থাকলেও বিশেষ ব্যবস্থায় গত ১৮ অগাস্ট ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা। এরপর উভয় সরকারের তরফ থেকে বলা হয় যে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে টিকা পেতে ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা করবে। আর, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জানান যে, বাংলাদেশ ভারতে যেসব টিকার কাজ চলছে, তার পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে এবং ভারত তাতে রাজি হয়েছে।  

টিকা নিয়ে গত কয়েকদিনে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে, ভারত বাংলাদেশকে টিকা পেতে যে সহায়তা দেওয়ার কথা বলেছে, সেটি কি সরকারি পর্যায়ের সহায়তা নয় ? ভারত তাহলে বাংলাদেশকে কোন টিকা পেতে সহায়তা করবে ? ভারতের নিজস্ব উদ্ভাবন যে টিকা , কোভ্যাক্সিন , সেটির তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা তো এখনও শুরু হয় নি। সিরাম ইনিস্টিটিউট যে টিকা উৎপাদন করবে, সেটি কেনার জন্য ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক উদ্যোগ অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাক্সিন, গাভি ইতোমধ্যেই একটি চুক্তি করেছে। গাভি যেসব দেশের জন্য টিকা সংগ্রহ করছে সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

সেরাম ইনিস্টিউটে বেক্সিমকোর বিনিয়োগের ঘোষণায় বোঝা যায় যে তারা যেসব টিকা সংগ্রহ করবে, তা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যেই করা হবে। সেটি হতে পারে সরকারকে যোগান দেওয়া, অথবা খোলা বাজারে বিক্রি করা। আবার, এই দুটোর মিশ্রণও হতে পারে। বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান সোহেল রহমান করোনার লকডাউনের মধ্যেই বিশেষ বিমানে লন্ডনে এসেছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। সুতরাং, বেক্সিমকো বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনে আগ্রহী হলে অক্সফোর্ডের উদ্ভাবক দল এবং অ্যাস্ট্রেজেনকার সঙ্গে সরাসরি অংশীদারিত্বের আলোচনা ও সমঝোতা অসম্ভব ছিল না। তবে, বেক্সিমকো ওষুধ উৎপাদনে সুখ্যাত হলেও কোনোধরণের টিকা উৎপাদন করে না। ফলে, নতুন করে টিকা উৎপাদনের ল্যাবরেটরি ও কারখানা গড়ে তোলা অথবা বিদ্যমান ওষুধ কারখানার কোনো অংশের রুপান্তরের মত উদ্যোগের কথা হয়তো তাঁরা ভাবেন নি। বরং, ব্যবসায়িক বিবেচনায় নিকটতম উৎপাদনকেন্দ্র ভারত থেকে তা সংগ্রহের চুক্তি করেছেন।

বেক্সিমকোর বাণিজ্যিক উদ্যোগের সমালোচনা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। আমার প্রশ্ন গাভির মাধ্যমে বাংলাদেশ যতটা টিকা আগে পাওয়ার আশা করছিলো, সেটা এখন আগে আসবে তো ? নাকি, বিনিয়োগের সুবাদে বেক্সিমকোর বাণিজ্যিক সরবরাহ বাজারে আগে আসবে ?

বাংলাদেশে বিভিন্নধরণের টিকা উৎপাদনে যুক্ত আছে ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন এবং পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড জানিয়েছে গত ২৫ অগাস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় বাংলাদেশের বাণিজ্যসচিব যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত মডার্না ও ফাইজারের টিকা উৎপাদনে বাংলাদেশের টিকা উৎপাদক কারখানাগুলোকে কাজে লাগানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। মডার্না ও ফাইজারের টিকা উৎপাদনে বাংলাদেশের ইনসেপ্টা কিম্বা পপুলার অংশগ্রহণের সুযোগ পেলে তা অবশ্য প্রতিযোগিতামূলক হবে কিনা বলা মুশকিল। কেননা, যুক্তরাষ্ট্রের এই টিকা কিনতে ট্রাম্প প্রশাসন যে আগাম চুক্তি করেছে তাতে ইঙ্গিত মেলে যে এগুলোর দাম কিছুটা বেশিই হবে।

এই টিকা কূটনীতি বাংলাদেশের কর্তাব্যাক্তিরা যদি আরো আগে শুরু করতেন, তাহলে সম্ভবত টিকা সংগ্রহের প্রশ্নে এতো জটিল সমীকরণের প্রয়োজন হতো না। তাতে করে যেমন ভারত এবং চীনের রাজনৈতিক বিরোধের প্রভাবমুক্ত থাকা সম্ভব হতো, তেমনই জনকল্যাণে সরকারের দায়িত্ব পালনের পথে সম্ভাব্য বাণিজ্যিক বাধাও এড়ানো যেতো।   

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...