মিয়ানমারে রেহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়ণ-নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার তিনবছর পূর্তির সময়ে রোহিঙ্গাদের বাসভূমিতে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আহ্বান আমরা আবারও নতুন করে শুনতে পেলাম। গত ২৫ আগস্ট একটি আর্ন্তজাতিক ই-আলোচনায় আমাদের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সফল করতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাপনায় বেসামরিক তদারকিতে রাখাইনে একটি নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দিয়েছেন। এ জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মিয়ানমারের ওপর চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। স্মরণ করা যেতে পারে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বার্ষিক অধিবেশনেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে এধরণের একটি নিরাপত্তা অঞ্চল প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে গত
তিনবছরে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই নিরাপদ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবটি নিয়ে
ঠিক কী কী কাজ করেছেন ? জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে আহ্বান জানানো ছাড়া বিষয়টি নিয়ে
তেমন কোনো কাজ আ্দৌ কি হয়েছে ? নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত ছাড়া এধরণের কোনো
পদক্ষেপ কখনোই বাস্তবায়িত হবে না, সেটা মোটামুটিভাবে আমরা সবাই জানি। ভেটো ক্ষমতার
অধিকারী নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়াকে রাজি করাতে না পারলে
নিরাপত্তা পরিষদে এধরণের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রায় অসম্ভব। তবে, চীন ও রাশিয়া
সম্মত না হলেও এধরণের প্রস্তাবে তাদের ভেটো দেওয়া থেকে নিরস্ত রাখা একেবারে অসম্ভব
নয়।
বর্তমান রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে ২০১৭
সালের ৬ নভেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির বিবৃতিটি সেভাবেই এসেছিল। নিরাপত্তা
পরিষদের পক্ষ থেকে কূটনীতিকদের একটি দল পরের বছর বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারে সরেজমিন
পরিস্থিতি পরিদর্শনও করেছেন এবং ২০১৮‘র ৯ মে তাঁদের সফরের পর একটি বিবৃতিও দিয়েছেন। কিন্তু, এসব বিবৃতিতে
মানবিক সহায়তার বিষয়গুলো যতটা প্রাধান্য পেয়েছে, রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি ততটা
নয়। বরং, রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়
আলোচনার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন শুরু ও ত্বরান্বিত করাকেই উৎসাহিত করা হয়েছিল। দ্বিপক্ষীয়
সমাধানে উৎসাহ যোগানোয় অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই। কেননা, বাংলাদেশ ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবরেই
দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্য প্রক্রিয়া নির্ধারণে একটি সমঝোতা
স্মারকও সই করে ফেলে।
রোহিঙ্গাদের জন্য মিয়ানমারে নিরাপদ
অঞ্চল বা সেফ জোন প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা ও বাস্তবতা নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে
বাংলাদেশ যে স্পষ্ট এবং জোরালো অবস্থান তুলে ধরতে পারেনি, তার জন্য চীন এবং
রাশিয়ার অবস্থানকে হয়তো কিছুটা দায়ী করা যায়। কিন্তু, সাধারণ পরিষদের প্রস্তাবে
বিষয়টি কেন অর্ন্তভুক্ত করা গেল না? সাধারণ
পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা তৈরি না হলেও তার আলাদা একটা রাজনৈতিক
মূল্য আছে। সাধারণ পরিষদে গতবছরের ২৯ ডিসেম্বর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার
লংঘনের নিন্দা জানিয়ে যে প্রস্তাব পাশ হয় তার পক্ষে ভোট পড়েছিল ১৩৪ এবং বিপক্ষে ৯।
ভোটদানে বিরত ছিল ২৮টি দেশ। সেই ভোটের বিশ্লেষণেও আমাদের কূটনীতির যে চিত্র উঠে
এসেছে তাকে হতাশাজনক বলা বোধহয় অন্যায় হবে না। কেননা, রোহিঙ্গা নিপীড়ণ বন্ধ,
সহিংসতার নিন্দা এবং নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের প্রস্তাবেও আমরা আমাদের
ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী ভারতের সমর্থন পাইনি।
এ ছাড়া জাপান এবং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার (আঞ্চলিক জোট আসিয়ানভুক্ত) দেশগুলোর মধ্যে বিশেষত বৌদ্ধপ্রধান
দেশগুলোও প্রস্তাবটিতে সমর্থন দেয়নি। বিরোধীদের দমন-পীড়ন ও বিতর্কিত নির্বাচনের মত
বিষয়গুলোর কারণে পাশ্চাত্যে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা ফিরে পাওয়ার চেষ্টায়ই আমাদের
কূটনীতকদের বেশিরভাগ সময় কেটেছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে। আর্ন্তজাতিক
অভিবাসন সংস্থার ডেপুটি পদে নির্বাচনের জন্য আমাদের কূটনীতিকরা যতটা সময় ও সম্পদ
ব্যয় করেছেন, মিয়ানমারে সেফ জোনের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য সে রকম তৎপরতা দেখা গেলে ফলাফল হয়তো ভিন্ন হতো।
প্রশ্ন হচ্ছে এখন আবার যে নিরাপদ অঞ্চল
প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হচ্ছে, সেই বিষয়ে গত তিন বছরে আমাদের কূটনীতিকরা কী
করলেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের সময়ে
আমাদের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন যে আগামী বছরে নিরাপত্তা পরিষদে ভারত অস্থায়ী সদস্য
হিসাবে দায়িত্বভাব গ্রহণ করলে মিয়ানমার প্রসঙ্গে জাতিসংঘের ওই সর্ব্বোচ্চ ফোরামে বাংলাদেশ
তার সাহায্য পেতে পারে। তাঁর এই আশাবাদের ভিত্তি কী, আমাদের জানা নেই। বরং, আমরা
মনে করতে পারি, আর্ন্তজাতিক ফোরামগুলোর সব কটিতে ভারত মিয়ানমারের নিন্দা করা থেকে
বিরত থেকেছে। এমন কি জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধানী দল মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও
সামরিকবাহিনীর শীর্ষ জেনারেলদের বিচারের মুখোমুখি করার সুপারিশ করার পরও ভারত সেই
সেনাপতিকে লালগালিচা বিছিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে।
গত তিন বছরে রোহিঙ্গা সংকটে
উল্লেখযোগ্য যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো হচ্ছে : ১. আর্ন্তজাতিক বিচার আদালত আইসিজে
গাম্বিয়ার আবেদনের শুনানি করে গণহত্যা সনদের বিধানের আলোকে মিয়ানমারে এথনও যেসব
রোহিঙ্গা রয়ে গেছেন তাঁদেরকে সম্ভাব্য গণহত্যা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার একটি অর্ন্তবর্তী
আদেশ জারি করেছেন। সেই আদেশ বাস্তবায়নে দেশটি কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে তার ওপর প্রথম
প্রতিবেদনটিও গত মে মাসে আদালতের কাছে জমা পড়েছে। ২. রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে
উদ্বাস্তুদের ঢল নামার দু‘মাস না
পেরুতেই প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশ যে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা
স্মারক সই করেছিলো, তা পুরোপুরি অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। একজন উদ্বাস্তুরও প্রত্যাবাসন
হয়নি। ৩. বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় ও মানবিক জীবনযাপনের জন্য যে
পরিমাণ অর্থের সংস্থান প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে। বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর
সহায়তা ক্রমশই কমছে। ৪. আশ্রয়শিবিরে অবরুদ্ধ অবস্থান দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে একদিকে
যেমন মানবিক সংকট তৈরি হচ্ছে, তেমনই মানবপাচার ও মাদক কারবারের মতো অপরাধমূলক কাজকর্মের
ঝুঁকি বাড়ছে। ৫. রাজনৈতিক উগ্রপন্থার তৈরি ও বিস্তারের আশংকা দেখা দিচ্ছে। ৬. জাতিসংঘ নিয়োজিত স্বাধীন তদন্তকারীরা
মিয়ানমারের অসহযোগিতা সত্ত্বেও জাতিগত নির্মূল অভিযান ও মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাথমিক
তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করে নথিবদ্ধ করেছে এবং ৭. গণহত্যার মত মানবতাবিরোধী অপরাধের
বিষয়ে আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত, আইসিসি একটি স্বতন্ত্র তদন্ত পরিচালনা করছে।
আশার কথা, আইসিজের রায় বাংলাদেশের জন্য কিছুটা
সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কেননা, আইসিজের অর্ন্তবর্তী আদেশে সুস্পষ্ট পর্যবেক্ষণ রয়েছে
যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তুদের ফিরিয়ে
নেওয়ার জন্য মিয়ানমার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ
হয়েছে। আইসিজের আদেশ যে দেশটির ওপর কিছুটা হলেও চাপ তৈরি করেছে, তা বোঝা যায় আইসিজের শুনানিতে
গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার এবং অর্ন্তবর্তী আদেশ জারির মত কোনো পরিস্থিতি নেই বলে দাবি
করা সত্ত্বেও তারা আদালতের নির্দেশমতো নির্ধারিত সময়েই প্রতিবেদন পেশ করেছে।
আইসিজেতে প্রতিবেদন দেওয়ার ঠিক মাস দেড়েক আগে গত ৮ এপ্রিল জাতিসংঘের গণহত্যা সনদ মেনে চলা এবং রাখাইন রাজ্যে
সংঘটিত সব সহিংসতার সাক্ষ্যপ্রমাণ সংরক্ষণের জন্যও
দেশটির প্রেসিডেন্ট এক নির্দেশনা জারি করেন। নির্দেশনায় মানবাধিকার লংঘনের সাক্ষ্যপ্রমাণ
ধ্বংস করা হলে দায়ী ব্যাক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়। তবে,
বাস্তবে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রাখাইন রাজ্যে এখনও নিরাপত্তাবাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়ণের
অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আসন্ন নির্বাচনেও রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণের অধিকার দেওয়া হয়নি।
অথচ, আইসিজের অর্ন্তবর্তী আদেশে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর অভিযোগ যে লোক দেখানো কিছু পদক্ষেপের ঘোষণা আসলে আর্ন্তজাতিক
সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।
আইসিজের আদেশ বাস্তবায়নের
বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব প্রধানত নিরাপত্তা পরিষদের। আদালত তার কাজের রীতি অনুযায়ী জাতিসংঘ
মহাসচিবের কাছে তার নির্দেশনার কপি পাঠিয়ে দিয়েছেন এবং তা প্রতিপালনের বিষয়ে
মিয়ানমারের রিপোর্টগুলোও একইভাবে মহাসচিবের মাধ্যমে নিরাপত্তা পরিষদের কাছে যাবে। নিরাপত্তা
পরিষদের সদস্যসহ সব দেশকেই তাই আদালতের আদেশ অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের
স্বীকৃতি আদায়ে সহযোগিতার কথা বলা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের জাতিগত সুরক্ষার বিষয়টি কখনোই
দ্বিপক্ষীয় বিরোধের বিষয় ছিল না। বিছিন্নভাবে প্রত্যাবাসনের লক্ষ্য অর্জনের কৌশল যে
বিভ্রান্তিকর তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। আইসিজের সিদ্ধান্তে প্রমাণিত হয়েছে এর সমাধান
হতে হবে আর্ন্তজাতিক আইনে এবং ব্যবস্থায়। আইসিজের অর্ন্তবর্তী আদেশ বাস্তবায়ন ও গণহত্যার
বিচার এবং আইসিসিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অনুষ্ঠান – এই দুই পদক্ষেপই
মিয়ানমারকে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথে ফেরাতে পারে।
(২৮ অগাস্ট, ২০২০‘র প্রথম আলোয়
সামান্য সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন