বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯-এর কারণে বড়ধরণের সব সামাজিক আয়োজন প্রায় বছর দেড়েক বন্ধ থাকার পর শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি ৭-এর শীর্ষ বৈঠক হয়ে গেল, তাকে কেন্দ্র করে আমরা চমকপ্রদ কিছু প্রতিবাদের ছবিও দেখলাম। বিভিন্ন ধরণের স্বার্থ ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বিশ্বনেতাদের বৈঠকগুলোর সময় এধরণের প্রতিবাদ অনেকদিন ধরেই করে আসছে। কখনও কখনও তা সহিংসও হয়ে ওঠে, বিশেষ করে নৈরাজ্যবাদীদের জন্য। তবে এবারের প্রতিবাদের আকার ছিল ছোট এবং কোনো সহিংসতা ঘটেনি। বৈচিত্র এবং সৃজনশীলতায় অবশ্য কোনো ঘাটতি ছিল না।
শীর্ষ বৈঠকের আয়োজনগুলো ছিল লন্ডন থেকে প্রায় তিনশো মাইল দূরে
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় কর্ণওয়ালের সমুদ্রতটের অবকাশকেন্দ্র সেন্ট আইভসে। ওই
অবকাশকেন্দ্র ঘিরে অত্যন্ত সুরক্ষিত একটি এলাকা তৈরি করে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর
রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতাধর নেতাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। আর প্রতিবাদকারীদের
জন্য নির্ধারিত ছিল কিছুটা দূরবর্তী সমুদ্রতট এবং শহর। স্বাস্থ্য অধিকার,
পরিবেশবাদী, পরমাণু নিরস্ত্রীকরণপন্থী, যুদ্ধবিরোধী, মানবাধিকারকর্মী, এনজিওকর্মী,
ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য, ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের সমর্থকদের আলাদা আলাদা অনেকগুলো
প্রতিবাদ-বিক্ষোভ আয়োজিত হয়।
সাগরের পানিতে সাঁতার কেটে, নৌকা নিয়ে, সৈকতে বালুর মধ্যে
নেতাদের প্রতিকৃতি এঁকে, নেতাদের নানারকম ক্যারিকেচার বা ব্যঙ্গ চরিত্র তুলে ধরা
বেলুন বানিয়ে প্রতিবাদগুলো অনেকটাই বর্ণাঢ্য হয়ে ওঠে। তবে এর মধ্যেও বহুজাতিক
কোম্পানি ম্যাকডোনাল্ডে অবস্থানগ্রহণ, জীবাশ্ম-জ্বালানিখাতে বিনিয়োগের প্রতিবাদে
এইচএসবিসি ও বার্কলেস ব্যাংকের দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকার মত কাজও হয়েছে, যেগুলো আইনত
অপরাধ হিসাবে গণ্য হতে পারে।
সম্মেলনের চূড়ান্ত ইশতেহার প্রকাশের পর সেই অবকাশকেন্দ্র থেকে
বেরুনোর একমাত্র পথটির মুখেও বাদ্য বাজিয়ে অবস্থান নেয় পরিবেশবাদী গোষ্ঠী এক্সটিংশন
রেবেলিয়ন। কিন্তু এদের অপসারণের জন্য কোথাও পুলিশ শক্তিপ্রয়োগ করেনি। এর একদিন
আগে, ফিলিস্তিনীদের সমর্থনে এবং ইজরায়েলী নিষ্ঠুরতা ও দখলদারির প্রতিবাদ এবং
দেশটিকে জি-৭ এর দেশগুলোর অব্যাহত সামরিক ও কূটনৈতিক সহায়তা বেন্ধের দাবিতে ডাউনিং
স্ট্রিটের সামনেও বড়ধরণের প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও পুলিশ বাধা দেয়নি।
এসব বিক্ষোভ জমায়েতের দুটো বিষয় খুবই লক্ষ্যণীয়। একটি হচ্ছে
আয়োজনগুলো ছিল অনেকটা উৎসবের মতো এবং দ্বিতীয়ত: রাজনীতিকদের জন্য ব্যাঙ্গাত্মক।
পুলিশের কৌশলের কথাও না বললেই নয়। তাদের কৌশলের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা নিবর্তনমূলক
ছিল না। নাশকতা এড়ানোর জন্য তাদের জোর ছিল গোয়েন্দা তৎপরতায়। অন্যান্য
প্রতিবাদগুলোর মতই ধারণা করি আইনলংঘনের জন্য কাউকে বিচারের প্রয়োজন হলে তারা সন্দেহভাজনদের
পরে গ্রেপ্তার করবে, যেমনটি অধিকাংশ সময়েই করে থাকে।
২. আমাদের দেশেও
মহামারির মধ্যে সরকারি আয়োজনে বড় জাঁকজমকর্পূণ উৎসব হয়েছে গত মার্চে। স্বাধীনতার
সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সমাপনী উপলক্ষ্যে
সপ্তাহব্যাপী আয়োজন। বিদেশি অতিথি, বিশেষ করে প্রতিবেশি দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের
অংশগ্রহণ নিরাপদ করতে ঢাকা প্রায় অবরুদ্ধ এক নগরীতে পরিণত হয়। পুলিশপ্রধান আগাম
ঘোষণা দিয়ে দেন ওই সময়ে কেউ যেন ঘরের বাইরে না বেরোয়। সবধরণের বিক্ষোভ-সমাবেশ, যা
বহুদিন ধরে এমনিতেই হয় না, নিষিদ্ধ করা হয়। বলা চলে বিদেশি অতিথি ও সরকারি আয়োজনের
নিরাপত্তার জন্য সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে দমনমূলক কৌশল বেছে নেওয়া হয়। সরকারি
আয়োজনগুলোর থেকে নিরাপদ দূরত্বে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভের অনুমতি দিলে
সেগুলোতে শান্তিভঙ্গের আশংকা যে খুব একটা ছিল, তা মনে হয় না।
নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর দেখা গেল তা উল্টো ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। মতপ্রকাশের
অধিকার এবং সভা-সমাবেশের অধিকার যেহেতু আমাদের সংবিধানে নিশ্চিত করা আছে, সেহেতু
এধরণের নিবর্তনমূলক অধিকার হরণকে বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়া সব গণতন্ত্রমনা নাগরিকের
জন্য স্বাভাবিক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাই ছাত্রদের একটি অংশ প্রতিবাদ করেছে।
প্রায় এক দশকের হামলা-মামলায় বিপর্যস্ত প্রধান বিরোধীদল নিষ্ক্রিয় থাকলেও ছোটখাটো
দু-একটি দল সাধ্যমত প্রতিবাদ জানিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিল ক্ষমতাসীন
আওয়ামী লীগের আর্শীবাদপুষ্ট কথিত অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। ছাত্রদের
প্রতিবাদে পুলিশ লাঠিপেটা করলেও পত্রপত্রিকায় পাল্টা সহিংসতার খবর তেমন একটা খবর
আসেনি।
সহিংসতা বড় আকারে যা হয়েছে, তা প্রধানত হেফাজতে ইসলামীর সমর্থক, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এবং আইন-শৃংখলা
রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে। এসব সহিংসতায় প্রাণ হারালেন অন্তত ১৫জন এবং আহতের সংখ্যা
এর কয়েকগুণ। সহিংসতার আইনানুগ তদন্ত এবং বিচার অবশ্যই হওয়া দরকার। কিন্তু সবকিছু
কি আইন মেনে হচ্ছে? সারাদেশে হেফাজতের নেতাকর্মীদের যে ধরপাকড় হয়েছে, তার সবাই কি
মামলার আসামী? নাকি গ্রেপ্তারের পর আসামীর তালিকায় নাম ঢোকানো হচ্ছে? আইনের সীমা
লংঘন কারও ক্ষেত্রেই সমর্থনযোগ্য নয়। হেফাজতের নেতৃত্ব নিয়ে সংগঠনটির অর্ন্তদ্বন্দ্বে
সরকারের যে পক্ষপাত রয়েছে, তার কারণে কেউ যদি অযথা হয়রানির শিকার হন, সেটা হবে
অন্যায়।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো কোনোধরণের সহিংসতায় জড়িত না হয়েও যেসব
ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তাঁদের প্রতি অবিচার। ৫০ জনের বেশি ছাত্র যাঁরা আটক
আছেন এবং যাঁদের জামিনের জন্য প্রধান বিচারপতির দপ্তরে কয়েকজন সুপরিচিত নাগরিক যে
অনন্যোপায় হয়ে ধরণা দিতে গেছেন, সেটা মোটেও প্রত্যাশিত নয়। বিদেশি অতিথি, তা সে
সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁর বিরুদ্ধে শান্তির্পূণ প্রতিবাদ
জানানো কোনোভাবেই অজামিনযোগ্য অপরাধ নয় যে তার জন্য তিনমাসেও জামিন মিলবে না।
ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার তরুণরা যদি জীবনের শুরুতেই আদালতের কাছেও রাষ্ট্রীয় হয়রানির
প্রতিকার না পান, তাহলে রাষ্ট্রের কোন প্রতিষ্ঠানের ওপর তাঁরা আস্থা রাখবেন?
৩. প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংবিধানসম্মত অধিকার। মতপ্রকাশের এই অধিকার
ভোগ করার প্রক্রিয়াও সৃজনশীলতায় সমৃদ্ধ হতে পারে, উপভোগ্য হতে পারে। সামরিক
স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনে তার প্রতিফলন আমরা দেখেছি, সাংস্কৃতিক
মঞ্চে, কবির কবিতায়, শিল্পীর তুলিতে। বিশ্ব বেহায়ার কার্টুনটি স্বৈরশাসনের
বেহায়াপনার ঐতিহাসিক প্রতীক হিসাবে ইতিহাসে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু দূর্ভাগ্যজনক
বাস্তবতা হচ্ছে অসামরিক শাসনকালেই দেশে কার্টুন আঁকার জন্য কার্টুনিস্ট আহমেদ
কিশোরকে জেল খাটতে হয়েছে, শারীরিক নির্যাতনের ক্ষত ও যন্ত্রণা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে
এবং তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ আনা
হয়েছে ‘রাষ্ট্রবিরোধী পোস্ট, মহামারি করোনা, সরকারদলীয় বিভিন্ন নেতার
কার্টুন দিয়ে গুজব ছড়িয়ে’ জনগণের
মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও অপপ্রচারের। মামলায় রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন
করারও অভিযোগ এনেছে পুলিশ।
রাষ্ট্রের
ভাবমূর্তি যে আইনে সংজ্ঞায়িত নেই সেকথা আগেও আমরা বলেছি। আর আদালত যদি কার্টুনের
কারণে রাষ্ট্রের সেই কাল্পনিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের দায়ে কিশোরকে দন্ড দেন, তাহলে
বিশ্বে সেই হবে প্রথম কার্টুনিস্ট যাকে রাষ্ট্র তার মান রক্ষার জন্য জেলে
পাঠাচ্ছে। যাঁরা রাজনীতি করেন, তাঁরা যদি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সইতে না পারেন, তাহলে
বলতে হবে তাঁরা ভুল পেশায় আছেন। একইভাবে মানতে হবে যে আমরাও সম্ভবত সৃজনশীলতা পুরোপুরি
হারিয়ে ফেলেছি। সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির অন্যায়-অবিচার, বৈষম্য, অনিয়ম, অপরাধকে
বিদ্রুপ করা ভুলে গেছি বা সেই মেধা ও সাহস তিরোহিত হয়েছে। কিছুদিন আগে দেশের শীর্ষস্থানীয়
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ পত্রপত্রিকায় কার্টুনের অনুপস্থিতির
বিষয়ে ফেসবুকে আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন।
কিশোরকে
আমি চিনেছি আইন-শৃংখলাবাহিনী তাকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার খবর পড়ার পর। ফেসবুকের বাইরে তার
সঙ্গে কখনো পরিচয়ও হয়নি। এরকম আরও কিছু প্রতিভাধর আঁকিয়ে আছেন। সাংবাদিক রোজিনাকে কারাগারের
গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ছবির আদলে মেহেদি যে কার্টুন এঁকেছেন এবং নিউ এজ পত্রিকা তা
ছেপেছে, তাতে কিছুটা হলেও আশা ফিরে পাই। এখন অপেক্ষায় আছি দেশে একদিন রাজনৈতিক
ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের উৎসব দেখব বলে। অন্যায়-অবিচার- প্রতিবাদের এরকম উৎসব খুবই জরুরি।
এটা সহিংসতার ঝুঁকিও দূর করে।
(১৫
জুন, ২০২১-‘র প্রথম আলো
পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন