আমাদের দেশে শিশুকাল থেকেই পড়ানো হয়, বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। অন্য কথায়, বাংলাদেশ হচ্ছে নদীর দেশ। নদীর দেশে নৌপথে যাত্রার ভরসা নানা ধরনের নৌযান এবং নানা ধরনের নৌযানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চিনি আমরা নৌকা নামের আদি অযান্ত্রিক দাঁড়টানা বাহনটিকে। নদী আছে, নৌকাও আছে; অথচ দেশে কোনো নৌকাচক্র ( ক্লাবের বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে চক্র প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব অবশ্যই আবাহনীর) থাকবে না, এটা কেমন কথা। নদীর দেশে রাজধানী ঢাকারও চারিদিকে নদী – বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু। তো সেই ঢাকাতেও কোনো নৌকাচক্র ছিল না। অন্তত, গতসপ্তাহের আগে অবধি সাধারণ মানুষের জানা ছিল না।
যাঁরা এ-জাতীয় ঘাটতি পূরণের মহান দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়ে
ঢাকায় একটি বোট ক্লাবের জন্ম দিয়েছেন, তাঁদের তাই জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্য। অবশ্য,
এবিষয়ে পথিকৃত হলো চট্টগ্রাম। দেশের প্রথম নৌকাচক্র বাণিজ্য নগরীতেই চালু হয়েছে প্রায়
তিন দশক আগে এবং তার অবস্থান সমুদ্রবন্দরের পাশে। বিমানবন্দরটিও অবশ্য একেবারে
লাগোয়া। নৌকাচক্র প্রতিষ্ঠার জাতীয় পুরস্কার চট্টগ্রামের প্রাপ্য হলেও রাজধানীর আলাদা
গুরুত্ব বিবেচনায় ঢাকা নৌকাচক্রের প্রতিষ্ঠাতাদেরও কিছু একটা স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।
চক্রটি তাঁদের প্রমোদতরী কিম্বা বাইচের
জন্য হলেও ঢাকার নদীগুলো কিছুটা হলেও বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারে বলে কারও
কারও মনে আশাবাদ তৈরি করতে পারে।
অবশ্য ঢাকার এই নৌকাচক্র যাঁরা প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁদের সঙ্গে
নৌকার যোগসূত্রটা কী, সেটা একেবারেই স্পষ্ট নয়। নৌকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত
হচ্ছেন দুইধরণের মানুষ – মালিক আর মাঝি। প্রতিষ্ঠাতারা যে
মাঝি নন, সেটা নিশ্চিত। তবে, মালিক হলেও কোনধরণের নৌকার মালিক, তা-ও জানা যায় না।
লঞ্চ কিম্বা পণ্য পরিবহনের কার্গো বোটের মালিক কেউ আছেন বলেও জানা যায় না।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা অবশ্য বলতে পারেন যে প্রতীক হিসাবে নৌকার প্রভাব রাজনীতিতে
যেভাবে অনুভূত হয়, তাতে ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্যের চেয়ে নৌকার সঙ্গে আর কোনো
সম্পর্কের গুরুত্ব মূল্যবান হতে পারে না।
ঢাকা নৌকাচক্রটা যেহেতু বিনোদনমূলক সংঘ, সেহেতু এর সদস্যদের
প্রমোদতরির মালিক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আর সেই প্রমোদতরি যে ঢাকাতেই থাকতে হবে,
এমন কোনো কথা নেই। দুবাই বা সিঙ্গাপুরেও হলেও কোনো ক্ষতি নেই। অন্তত ঢাকা নৌকাচক্রের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে এমন কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম
রয়েছে যাঁদের পক্ষে বিশ্বের যে কোনো হ্রদ, নদী এবং সাগরে প্রমোদতরি অবকাশ কাটানো
মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তবে বাংলাদেশে প্রমোদতরির উপযোগী পরিবেশ যে খুব একটা আছে,
সেটা নিশ্চয়ই কেউ দাবি করবেন না।
নৌকাচক্রটা মাঝিদের হলে হয়তো তা নিয়ে খুব একটা আলোচনার অবকাশ থাকত
না। মাঝিরা ঘাট পেলেই নৌকা বেঁধে বিশ্রাম-বিরতি-পানাহার করেন ঠিকই; কিন্তু একই ঘাটে
তো আর তাঁদের বারবার আসা হয় না , আর আসতে পারলেও পরের খ্যাপের চাপে বিনোদনের সুযোগ
থাকেনা।
হিংসুটে না হলেও নিন্দুকেরা অবশ্য অভিযোগ করেছেন ঢাকা নৌকাচক্রের
প্রতিষ্ঠাতারা নিজেরাই নাকি তুরাগের কিছুটা দখলে নিয়ে ফেলেছেন এবং তার ওপরে স্থায়ী
স্থাপনাও তৈরি হয়ে গেছে। নদী রক্ষা কমিশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান নাকি দেশের
নদীগুলোকে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব
দখলমুক্ত করার আইনি কাজে আবার আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা লাগে। নাহলে
দখলদারদের লোকজনের ধাওয়ায় নদী উদ্ধারকারীদের হাওয়া হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে। ঢাকার
নৌকাচক্রের অবৈধ দখলের অভিযোগের নিষ্পত্তির হাল কী হবে, তা নিশ্চয়ই আর বলে দেওয়ার
দরকার নেই।
ঢাকার নৌকাচক্রের কথা যে খবরসূত্রে জানা গেল, তা ছিল একটি গুরুতর অপরাধের
অভিযোগ, যার সংঘটনস্থল ওই চক্রের পানশালা। সেখানকার পানশালার অনুমোদন আছে কি না,
মজুতের হিসাব মেলে কি না , এসব বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান নেই। তদন্তকারীদের অনুসরণকারী
ক্যামেরাগুলো যাচ্ছে উত্তরা, গুলশান ও বনানীর নানা ঠিকানায়।
জাতীয় সংসদের অধিবেশনে পরপর দুদিন এই ঘটনা নিয়ে তুমুল আলোচনাও হয়ে
গেছে। অভিযোগ উঠেছে ‘তুরাগ পাড়
দখল করে এই ক্লাব করা হয়েছে। পুলিশের আইজি এটার সভাপতি।‘ সংসদে সরকারের পক্ষ থেকে এই বক্তব্য কেউ খন্ডন করেননি। সরকারি কর্মকর্তারা
চাকরি বিধি অনুযায়ী কেউ এধরণের প্রতিষ্ঠানের কোনো পদ গ্রহণ করতে পারেন কি না, তাঁর
মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি।
আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি চালু হচ্ছে খেয়ানৌকা। এগুলোর আবার কোনোটি
গলুইওয়ালা, কোনোটি গলুইছাড়া একেবারে খোলা। অঞ্চলভেদে নৌকার ধরনেও ফারাক আছে। যেমন
গয়নার নৌকা, সাম্পান, ডিঙ্গি, ডোঙ্গা, কোষা, বজরা, পানসি ইত্যাদি। আগে গুনটানা
নৌকা ছিল, নদীর পাড়গুলো সব দখল হয়ে যাওয়ার পর পাড় দিয়ে হাঁটার পথ না থাকায় তা এখন আর
খুব একটা নেই। আরও দু:খের বিষয় হচ্ছে এখন প্রায় সব নৌকারই ‘উন্নয়ন‘ ঘটায় সেগুলো
শ্যালো বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রুপান্তরিত হয়েছে। ঢাকার নৌকা চক্রের দাপট আর
বাণিজ্যিক সাফল্য দেখে এখন ডিঙ্গি ক্লাব, পানসি ক্লাব জাতীয় নতুন কোনো ক্লাব
তৈরিতেও এখন অনেকে উৎসাহিত হতে পারেন।
(১৮
জুন, ২০২১-‘র প্রথম আলো
পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন