১৪ নভেম্বর জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) এক আলোচনায় বলেছেন, সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করবে বলে তাঁদের জানিয়েছে। তাই আগামী নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেবে বলে তাঁর আশা। ইতো নাওকি এটুকু বলে থেমে গেলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যে খুশি হতেন এবং বিরোধী দল বিএনপিকে জাপানি রাষ্ট্রদূতের আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানাতেন, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সাম্প্রতিক ইতিহাস সেরকমই স্বাক্ষ্য দেয়।
চলতি বছরের ৬ এপ্রিল ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে তাঁর আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে সহায়তা করার অনুরোধ জানিয়ে এসেছিলেন। তারও অনেক আগে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জেনারেল এরশাদকে নির্বাচনে অংশ নেওয়াতে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব সুজাতা সিংকে তদবির করার ব্যবস্থা করে দিয়ছিলেন তাঁর পূর্বসুরিদেরই একজন। তিনি বা তাঁর ডেপুটি কিম্বা মন্ত্রণালয়ের অন্য কোনো কর্মকর্তা বিদেশি কূটনীতিকদের ভিয়েনা কনভেনশনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার আগে যদি নিজেদের স্মৃতি ঝালিয়ে নেন, তাহলে তাতে সবারই মঙ্গল।
জাপানি রাষ্ট্রদূত ওই অনুষ্ঠানেই ২০১৮ সালের নির্বাচন সর্ম্পকে এক প্রশ্নের মুখে পড়েন। তখন উত্তর হিসাবে তিনি যা বলেছেন, সেটা সরকারের পছন্দ হয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি শুনেছি, (গত নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি অন্য কোনো দেশে এমন দৃষ্টান্তের কথা শুনিনি। আমি আশা করব, এবার তেমন সুযোগ থাকবে না বা এমন ঘটনা ঘটবে না।’ ইতো নাওকি বলেন, কাজেই এখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দরকার। এটাই তাঁর দৃঢ় প্রত্যাশা। কথাটা সরকারের যেমন পছন্দ হয়নি, তেমনি আঁতে লেগেছে নির্বাচন কমিশন ও পুলিশেরও।
পুলিশের ক্ষোভটা না হয় বোঝা যায়, কেননা তারা বলতে পারে সরকারের হুকুম মানাই তাদের কাজ, যদিও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে দলের পক্ষ নিয়ে দলীয় কর্মীর মতো কাজ করার। ২০১৮ সালে যে আগের রাতে ভোট হয়েছে, সেটা ছিল হুদা কমিশনের আমলে এবং সেটা ওই কমিশনের সবাই বিভিন্ন সময়ে স্বীকারও করে গেছেন। পুলিশ কর্মকর্তাদের সমিতি তখন কোনো বিবৃতি দিয়ে রাতের ভোটের কথা অস্বীকার করেছে বলে মনে পড়ে না। বর্তমান নির্বাচন কমিশনারদের অন্যতম মোহাম্মদ আলমগীর রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে অনাকাঙ্খিত বলে অভিহিত করেছেন। আগবাড়িয়ে তিনি আগের কমিশনের কলঙ্কিত অধ্যায় আড়াল করার চেষ্টা করছেন কেন, সেটা একটা প্রশ্ন। এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হচ্ছে, তিনি তখন ওই কমিশনে শীর্ষ আমলা হিসাবে দায়িত্বে ছিলেন এবং অবচেতনভাবেই তাই তিনি সাফাই দেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন।
ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক (সাবেক একজন মন্ত্রীর পরিবারের মালিকানাধীন) একটি টিভি চ্যানেল সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রচার করেছ, যাতে বিদেশি কূটনীতিকদের ডেকে নিয়ে এসে তাঁদের কাছে সরকারের জন্য বিব্রতকর প্রশ্ন তুলে ধরতে বিরোধী রাজনীতিকদের বিশেষ সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। আবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে মতামত চাওয়ার সংস্কৃতি অবশ্যই বন্ধ করতে হবে বলে সাংবাদিকদের সবক দিয়েছেন। ’আমরা কিন্তু এখন আর পরাধীন দেশ নই, সেটা তাঁদের মনে রাখা উচিত’ বলে তিনি ২১ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে যে বক্তব্য রেখেছেন, সেই কথাটা গত এপ্রিলে ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে বৈঠকের পরের উপলব্ধি কি না, সেকথা অবশ্য তাঁর কাছে কেউ জানতে চায়নি। গত ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামে জন্মাষ্টমীর এক অনুষ্ঠানে তিনি যে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রাখতে ভারতের সাহায্য চাওয়ার কথা বলেছিলেন, তখনও নিশ্চয়ই তাঁর ওই উপলব্ধি হয়নি।
ওই আগস্টেই আরও একটি অভাবিত ঘটনা ঘটেছিল, যা আমাদের সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে গেছে বলেই আমার ধারণা। একমাত্র ইংরেজি পত্রিকা, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড ছাঢ়া আর কোথাও খবরটি আমার চোখে পড়েনি। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তৎকালীন হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেতের প্রশংসা ও সহায়তা পেতে উন্মুখ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা তাঁর জন্য ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে একটি নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন ১৭ আগস্ট। সেখানে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা ভালো করছে তার সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবিদের আমন্ত্রণ জানানো হয় ও তাঁরা বক্তব্য দেন। অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামীও, যিনি বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতে দেখতে হবে। ভারত ও বাংলাদেশ একইধরণের অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে দোরাইস্বামী বলেন, কিছু কিছু মানবাধিকার সংগঠন সরকারবিরোধীদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে ( গর্ভনমেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ, এমিনেন্ট সিটিজেন্স ব্রিফ ইউএন রাইটস চিফ অন বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস সিচুয়েশন, ১৮ আগস্ট, ২০২২) । জাতিসংঘ প্রতিনিধিকে বোঝানোার জন্য দেশের মাটিতে একজন বিদেশি কূটনীতিকের সাফাই নেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেবেন?
সরকার, ক্ষমতাসীন দল ও তাঁদের সমর্থক বুদ্ধিজীবিরা অভিযোগ করে থাকেন যে বিরোধী দলই বিদেশীদের দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলানোর সুযোগ করে দেন। কথাটা যে সর্বাংশে সত্য নয়, উপরের দৃষ্টান্তগুলো অন্তত সেটাই বলে। কোন দেশে কোন দল বা কোন নেতা সরকার পরিচালনা করবে, সে বিষয়ে বিদেশিরা সাধারণত প্রকাশ্যে কোনো পক্ষ নেন না, যদিও আমাদের উপমহাদেশে প্রায়ই ব্যতিক্রম লক্ষ্যণীয়। কিন্তু মানবাধিকার এবং ভোট সুষ্ঠূ হয়েছে কি না, অর্থাৎ মানুষ ঠিকমত ভোট দিতে পারলো কি না, সেটা সব দেশের প্রতিনিধিরা ( কূটনীতিক অথবা পর্যবেক্ষক) দেখে থাকেন এবং তাঁদের মূল্যায়নও প্রকাশ করে থাকেন। এটি তাঁদের স্বাভাবিক কাজের অংশ।
যেসব দেশের ভোটে অনিয়ম হয়, সেসব দেশের বিষয়ে তাঁরা সরকারিভাবেই বিবৃতি দিয়ে তাঁদের মূল্যায়ন জানিয়ে থাকেন। নতুন বা পুর্ননির্বাচিত সরকারকে অভিনন্দন জানানো বা না জানানোর সিদ্ধান্ত ওই মূল্যায়নের ওপরই নির্ভরশীল। জাপানের রাষ্ট্রদূত তাই যথারথই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে তাঁর সরকার কোনো দেশের নির্বাচনের বিষয়ে সাধারণত মন্তব্য না করলেও ২০১৮ সালে ব্যতিক্রম ঘটিয়েছিলেন। তাঁরা একটি দেশে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য উৎসাহিত করবেন অথবা সাহায্য দেবেন, অথচ দেশটির মানবাধিকার (ভোটাধিকার যার অংশ) লঙ্ঘন হলে মুখ ও চোখ বন্ধ রাখবেন – এমন প্রত্যাশা একেবারেই সেকেলে ও অচল।
বিশ্বায়নের কালে আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিষয়ে কিছু বিশেষজ্ঞের কথায় এধরনের সেকেলে ধারণা দেখে অবাক হতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যেসহ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়ে বিদেশিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মতপ্রকাশকে যে আর মোটেও অনধিকার চর্চা বলে গণ্য করা হয় না, সেটা লক্ষ্য করতে বা বুঝতে তাঁরা হয় অক্ষম, নয়তো রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতার কারণে তাঁরা তা এড়িয়ে চলেন। কয়েকটা উদাহরণ দেই। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পুর্ননির্বাচনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান নাগরিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ’আব কি বার (আরও একবার) ট্রাম্প সরকার’। সে কথা কি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়া উচিত? সেজন্য কি ওয়াশিংটনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র দপ্তর তলব করেছিল? প্রতিবাদ জানিয়েছিল? ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস আন্দোলনে বিশ্বের কত দেশের রাজনীতিক ও প্রতিনিধিরা সংহতি জানিয়েছেন, তার হিসাব রাখাও মুশকিল। চলতি বিশ্বকাপেও বর্ণবাদ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ইংল্যান্ডর ফুটবলাররা হাঁটু গেড়ে নীরবতা পালন করেছেন, যা ফিফাকে মেনে নিতে হয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে লিজ ট্রাসের ছোট বাজেট নিয়ে অর্থবাজারে যে তোলপাড় দেখা দিল,তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর পরিকল্পনাকে যে ’ভুল’ আখ্যা দিয়ে সরাসরি সমালোচনা করলেন, সেটা কি নজর এড়ানোর মতো ঘটনা? তিনি ওই নীতি সমর্থন করেন না জানিয়ে একথাও বলেন যে সিদ্ধান্তটি অবশ্য বৃটিশদের। এর দুদিন পরই মিস ট্রাস পদত্যাগ করেন।
যুক্তরাষ্ট্রে নানা কারণে নিখোঁজ হওয়া লোকজনের পরিসংখ্যানকে আমাদের মন্ত্রীরা যে গুমের শিকার বলে চালিয়ে দেন, সে জন্য কি ওয়াশিংটনে আমাদের রাষ্ট্রদূতকে দেশটির সরকার কিছু বলেছে? মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের রীতিনীতিগুলো ঠিকমত মেনে চললে বিদেশিরা নিশ্চয়ই আর সবক দেওয়ার সুযোগ পাবে না। না হলে লবিংয়ে অর্থ খরচ করেও তাদের সার্টিফিকেট পাওয়া সহজ হবে না।
(২৪ নভেম্বর, ২০২২–’র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত। )
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন