৭১ টিভিকে আর যা-ই বলা হোক, কেউ তাকে বিএনপি বা সরকারবিরোধীদের মুখপাত্র বলবে না। সেই টিভিতে প্রচারিত সাক্ষাৎকারে যে সরকারকে বিব্রত করার কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, এমন সন্দেহেরও কোনো অবকাশ নেই। তো সেই ৭১ টিভিতে নির্বাচিত ঘোষিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তাঁর মনোনয়ন লাভের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা রাষ্ট্র পরিচালনা ও ক্ষমতাকাঠামোর এক গুরুত্বপূর্ণ দিক উন্মোচন করেছে। এত দিন সবাই যা ধারণা করে এসেছে, একে তারই এক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বলা যেতে পারে।
তাঁর দেওয়া বিবরণ হুবহু উদ্ধৃত করতে গেলে এ নিবন্ধে তার স্থান সংকুলান হবে না। তবে মূল কথাগুলো এখানে তুলে ধরা যায়। মো. সাহাবুদ্দিন কখন, কীভাবে জানলেন তিনি এ দায়িত্ব পেতে চলেছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, রোববার সকালে তাঁকে গণভবনে যাওয়ার জন্য আগের রাতে ফোন করা হয়েছিল, যেমন ফোন তিনি এর আগেও বহুবার পেয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য এবং প্রচার ও প্রকাশনা কমিটির সভাপতি হিসাবে বিভিন্নসময়ে গণভবনে বিভিন্ন সভার জন্য তাঁকে সেখানে যেতে হয়েছে। তিনি সে রকম কোনো কাজের জন্যই ডাক পড়েছে ধারণা নিয়ে রোববার সকালে গণভবনে গেছেন। সেখানে যাওয়ার পরও তাঁর সঙ্গে আলাদা করে কেউ কোনো কথা বলে নি।
তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী, সেখানে গিয়ে তিনি আওয়ামী লীগের পদস্থ ও জ্যেষ্ঠ্য নেতাদের অনেককে দেখতে পান। এরপর দেখেন যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাষ্ট্রপতি পদের মনোনয়নপত্রে প্রস্তাবক হিসাবে এবং তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ সমর্থক হিসাবে সই করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেখানে উপস্থিত দলীয় নেতাদের বলেন, ’দলের পক্ষ থেকে, বঙ্গবন্ধু পরিবারের পক্ষ থেকে’ তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে দলের প্রার্থী হবেন মো. সাহাবুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর সিদ্ধান্তের কারণও তুলে ধরেন এবং বলেন, বঙ্গবন্ধু পরিবারের সিদ্ধান্ত তাঁকে প্রার্থী করা। উপস্থিত সব নেতাই তখন প্রস্তাবে সমর্থন দেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী মনোনয়নপত্রে সাহাবুদ্দিনকে সই করতে বলেন। তাঁর ভাষায়, তিনি তখন কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর এই প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য বিস্ময়ের কিছু নেই; বরং সেটাই স্বাভাবিক।
এই ভাষ্য থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে মো. সাহাবুদ্দিন এরকম অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিতে রাজি কি না, সে কথা তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলো না কেন? তিনি এরকম গুরুদায়িত্বের জন্য প্রস্তুত কি না, অর্থাৎ কতটা আত্মবিশ্বাসী, সে প্রশ্নও উপেক্ষণীয় নয়। সোজাকথায় বললে, তাঁকে ডেকে নিয়ে দায়িত্বটা তাঁর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাঁর সুদীর্ঘ নিবিড় সম্পর্কের কথা কারোরই অজানা নয়। এমনকি দূর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার হিসাবে তিনি তাঁর মেয়াদপূরণের পর দলের কার্যক্রমে যেভাবে সক্রিয় হয়েছেন, তা এর আগে অন্য কোনো কমিশনারের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। ফলে দলীয় নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্যের কারণেই তাঁর পক্ষে এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক।
এসব প্রশ্নের কারণ মোটেও এ কথা বলা নয় যে তিনি এমনিতেই এ প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করতেন না। প্রশ্নটি হচ্ছে, পদ্ধতিটি যথাযথ কি না? বরং, তাঁর ভাষ্য থেকে শাসনকাঠামোয় কর্তৃত্বের বিষয়টি প্রকাশ পায়। সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাষ্ট্রপতির যেহেতু তেমন কিছুই স্বাধীনভাবে করার ক্ষমতা নেই, সেহেতু এরকম নিয়োগপ্রক্রিয়ার বার্তা সুখকর কতটা, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।
কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন যে তাঁর মনোনয়ন বিশেষ কোনো কাজের পুরষ্কার কি না? দেশ টিভিতে গত বছরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি পদ্মা সেতুর দূর্নীতির অভিযোগ তদন্তে তাঁর ভূমিকার কথা বিশদে তুলে ধরেছেন। তিনি যে মেয়াদে কমিশনে কাজ করেছেন, সে সময়কালে একইধরনের অভিযোগের অনেক দূর্নীতির মামলায় তদন্তে আওয়ামী লীগের নেতাদের অব্যাহতি দেওয়া হলেও বিএনপি নেতাদের ক্ষেত্র ঘটেছে তার উল্টো। বস্তুত দুদকের বিরুদ্ধে সবসময়েই রাজনৈতিক প্রভাবে প্রভাবিত হওয়ার অভিযোগ আছে। সুতরাং নেতিবাচক ধারনা (পারসেপশন) নাকচ করা সহজ নয়।
শুরুতে উল্লিখিত ৭১ টিভির আলোচিত সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, দলের জ্যেষ্ঠ্য নেতারা মনোনয়নপত্র স্বাক্ষরের সময়েই সিদ্ধান্তটি জেনেছেন। আর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, মন্ত্রীদেরও কেউ কেউ তাঁর মনোনয়নের খবর জেনেছেন কমিশনে মনোনয়নপত্র জমা হওয়ার পর। দলের মধ্যে সিদ্ধান্তগ্রহণের এটিই প্রতিষ্ঠিত প্রক্রিয়া, যাকে দলটি গণতান্ত্রিক বলেই দাবি করে থাকে। আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়ার কারণে সেকথা তাঁরা বলতেই পারেন। এখন প্রশ্ন তোলা যায় যে আওয়ামী লীগ যে মহাজোট কিংবা ১৪ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে, সেই জোটের শরীকদের কি মতামত দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল? কিংবা জাতীয় পার্টিকে? আসলে তারও তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। হলে সেটা শুধু আনুষ্ঠানিকতাই হতো।
সাক্ষাৎকারটির আরেকটি অংশে মো. সাহাবুদ্দিন সংকটকালে ও নির্বাচনের সময়ে রাষ্ট্রপতির ভূমিকার গুরুত্বের ওপরও আলোকপাত করেছেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ পদটিকে ’কবর জেয়ারতের রাষ্ট্রপতি’ অভিহিত করলেও নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক বিবাদের জেরে সংকট ভিন্নতর মাত্রা পেলে রাষ্ট্রপতি কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারেন, তার অভিজ্ঞতা আমাদের কম হয়নি। আব্দুর রহমান বিশ্বাস, ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে স্মরণীয়।
দলীয় আনুগত্যের বিষয়টি যে কোনোভাবেই অস্বীকার করা চলে না, তার স্বীকৃতি মেলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের কথায়। তিনি বলেছেন, ’আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ইয়েস উদ্দীনকে মনোনয়ন দেয়নি। এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যার গোটা জীবনটাই বর্ণাঢ্য।’ এই বক্তব্যের সমস্যা হলো, বর্ণাঢ্য জীবনের ব্যক্তিরা যে দলের প্রতি অনুগত থাকেন না, এমনটি মোটেও ঠিক নয়। আবার স্টারের ওপর যেমন সুপারস্টার হয়, তেমনি ইয়েস উদ্দীনেরও ’সুপার ইয়েস উদ্দীন’ হতে পারে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এমনিতেই সাধারণ মানুষের মত দেওয়ার কোনো সুযোগ আইনে নেই। সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে জনমতের প্রতিফলন ঘটানোর ধারণায় গলদ যে কতটা গুরুতর, তা সংসদের প্রায় একদলীয় চরিত্রের কারণে প্রকটভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সংবিধান যখন একটি দলের ইচ্ছাতেই আবর্তিত হয়, তখন সাংবিধানিকতার যুক্তিকে অজুহাত ছাড়া আর কিছু ভাবার অবকাশ কই? রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে তাই সংবিধানের সংস্কারের প্রশ্ন আর উপেক্ষা করা চলে না।
(১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন