সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে গ্যাস ছিল ঢাকা–লন্ডন কূটনীতির কেন্দ্রে



বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবসা পাওয়ার জন্য বৃটিশ সরকার গত শতকের শেষ পাঁচ বছরে সর্ব্বোচ্চ পর্যায়ে কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়েছিল বলে সর্বসম্প্রতি অবমুক্ত বৃটিশ সরকারের নথিপত্রে দেখা যাচ্ছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে বৃটেনে প্রথম সরকারি সফরে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের দপ্তর ও সেখানকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণায়ের মধ্যে যেসব চিঠিপত্র চালাচালি হয়, সেগুলো থেকে এমন ধারণা মেলে। ডাউনিং স্ট্রিটের পদস্থ কর্মকর্তারা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের জন্য যে নথি তৈরি করেন, তাতে যুক্তরাজ্যের জন্য এক নম্বর অগ্রাধিকার হিসাবে চিহ্নিত ছিল দুটি বৃটিশ কোম্পানি শেল ও কেয়ার্ন এনার্জির পক্ষে তদবির।   


গত ৩০ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল আর্কাইভ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের যেসব গোপন নথি অবমুক্ত করে দেয়, তার মধ্যে ৯৭ সাল থেকে শুরু করে ২০০১ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালের বাংলাদেশ বিষয়ক যত চিঠিপত্র ও নথি তৈরি হয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়েছে। এর বাইরে অতি স্পর্শকাতর আর কোনো নথি অন্য কোনো দপ্তর বা বিভাগে থাকা অবশ্য অসম্ভব নয়। শেল ও কেয়ার্ন তার আগের বছর গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দ্বিতীয় দফায় আহুত আর্ন্তজাতিক প্রস্তাবে বাংলাদেশের গ্যাস ব্লক ১০ ও ৫ এর জন্য প্রস্তাব জমা দিয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিল। শেল বাংলাদেশ ভূখন্ডে বহু আগে থেকেই অন্যান্য অনুসন্ধান ও উন্নয়ন প্রকল্পে যুক্ত ছিল। আর কেয়ার্ন ১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে সাঙ্গুতে গ্যাসের মজুত আবিষ্কার করে তার উত্তোলন শুরু করে। তখন তার বিনিয়োগ ৫০ কোটি ডলারে পৌঁছেছিল বলে বৃটিশ সরকারের নথিতে উল্লেখ রয়েছে। 


নথিপত্রে দেখা যায়, তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরটি প্রথমে ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ওই বছরের ভয়াবহ বন্যার কারণে তা শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। তারপর সফরের নতুন তারিখ নির্ধারণের আলোচনা শুরু হয় এবং সফরটি হয় ১৯৯৯ সালের ৬ থেকে ৯ জুলাই। ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর আনুষ্ঠানিক বৈঠকটি হয় ৭ জুলাই সন্ধ্যা সোয়া ছয়টায়। বৈঠক চলে  আধঘন্টা এবং তাঁরপর তাঁরা দুজনে একযোগে বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের দরবার হলে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসবের উদ্বোধন করেন। 


প্রকাশিত চিঠিপত্রে দেখা যায় কেয়ার্ন এনার্জির প্রধান নির্বাহী বিল গ্যামেল ও শেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পর তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দেওয়ার সুযোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের দপ্তরে মি গ্যামেল চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ২৯ জুনের ওই চিঠির জবাবে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের একান্ত সচিব এন্ড্রু প্যাট্রিক বৈঠকের একদিন আগে ৫ জুলাই লেখেন যে প্রস্তাবটি অবাস্তব এবং তা যথাযথ হবে না। উভয় প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের পরের দিন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সকালে বিল গ্যামেলের একটি প্রাত:রাশ বৈঠক বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে জানানোর পটভূমিতে মি গ্যামেল ওই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মি ব্লেয়ারের একান্ত সচিবের চিঠিতে অবশ্য লেখা হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে শেল ও কেয়ার্নের প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গো বৈঠক করেন সেজন্য দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে অনুরোধ জানানো হবে। 


গ্যাস অনুসন্ধানে প্রসিডেন্ট ক্লিনটনের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল বৃটেন

আরেক চিঠিতে দেখা যায় বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর (এফসিও) এবং বাণিজ্য ও শিল্প বিষয়ক দপ্তরের (ডিটিআই) তরফে বৃটিশ কোম্পানি দুটির পক্ষে তদবিরের জন্য প্রধানমন্ত্রী টোনি ব্লেয়ারকে ভূমিকা নিতে বলার পিছনে কারণ ছিল ওই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের বাংলাদেশে প্রস্তাবিত সফরসূচি। ওই বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ঢাকা সফরের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানির পক্ষে প্রভাব খাটাতে পারেন এই আশঙ্কা থেকে বৃটিশ কোম্পানি দুটির পক্ষে ব্লেয়ার সরকারকে তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। গ্যাস অনুসন্ধানের লাইসেন্স প্রদানের প্রক্রিয়া অবশ্য সেই মেয়াদে শেষ হয়নি।  


১০ নম্বর গ্যাস ব্লক পরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের জন্য রেখে দেওয়া হয় এবং পাঁচ নম্বর ব্লকে অনুসন্ধানের কাজ দেওয়া হয় যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি হ্যালিবার্টনকে। আর কেয়ার্ন এনার্জি সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র ও ১৬ নম্বর ব্লকের অনুসন্ধান কাজের ৫০ শতাংশ ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্টোসের কাছে বিক্রি করে দেয়। ২০১৪ সালে সাঙ্গুর মজুত প্রায় নি:শেষিত হয়ে আর উত্তোলনযোগ্য গ্যাস  না থাকায় তা পরিত্যক্ত হয়। 


এর আগে অবমুক্ত হওয়া জানুয়ারি ১৯৯৫ থেকে মে ১৯৯৭ সময়কালের নথিপত্রেও দেখা যায় শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ছ’মাস পরই তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর ঢাকা সফর করেছিলেন এবং সফরকালে আলোচনায় তেল–গ্যাস অনুসন্ধানে বৃটিশ কোম্পানিগুলোকে অন্যান্য বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে সমতার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালের ১১ জানুয়ারি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব  জন মেজরের সফরকালে শেখ হাসিনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনার যে বিবরণী তৈরি করেছিলেন, তাতে লেখা আছে যে নৈশভোজের সময়ে বিষয়টি উত্থাপিত হয়। বৃটিশ কোম্পানি শেল ও কেয়ার্নকে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ না দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনোক্যালের সঙ্গে সমঝোতা সই হতে যাওয়র খবরে জন মেজর প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেন যে সুযোগ পেলে বুটিশ কোম্পানিগুলো আরো ভালো প্রস্তাব দিতে পারবে। শেখ হাসিনা তখন জানান যে বিষয়টি তাঁর নজরে আসেনি এবং এরকম আরো অনেক অনুসন্ধান কাজের সুযোগ আছে।   

  

ওই সফরের সময়েই জন মেজর আশাবাদ প্রকাশ করেন যে ওই বছরের অক্টোবরে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে শেখ হাসিনার সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ হবে। তাছাড়া ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিতব্য ক্ষুদ্র ঋণ শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণের সময়ে যাওয়া বা আসার পথে শেখ হাসিনা লন্ডনে যাত্রাবিরতি করলে প্রধানমন্ত্রী মেজর তাঁকে ডাউনিং স্ট্রিটে স্বাগত জানাতে আগ্রহী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ ফেব্রুয়ারি ওয়াশিংটন যান এবং তারপর তখনকার হাইকমিশনার মাহমুদ আলি বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরকে জানান যে ৮ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে শেখ হাসিনা কয়েক ঘন্টার জন্য যাত্রাবিরতি করবেন। ফলে সে যাত্রায় আর জন মেজরের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত হয়নি। 


কিছুদিনের মধ্যেই জন মেজর নির্বাচন দেন এবং পরাজিত হয়ে ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বিদায় নেন। লেবার পার্টির নেতা টোনি ব্লেয়ার নতুন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মি ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কেয়ার্ন এনার্জি এডিনবরায় তাদের নতুন সদর দপ্তর উদ্বোধনে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীকে একত্রিত করার উদ্যোগ নেয় এবং প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের দপ্তরে চিঠি দিয়ে সময়সূচি ঠিক করার প্রস্তাব দেয়। ওইবছর অক্টোবরে যে কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলন হয়, সেই সম্মেলনের সময়েই প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এডিনবরায় কেয়ার্ন এনার্জির নতুন সদর দপ্তরে যৌথভাবে ফলক উন্মোচন করেন। এছাড়াও কেয়ার্নের পক্ষ থেকে সে বছরেই সেপ্টেম্বরে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদের লন্ডন সফরের সময়ে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎের ব্যবস্থা করার জন্য এফসিওতে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানানো হয়। অবশ্য ডাউনিং স্ট্রিট সময়ের অভাবের কথা বলে তাতে সম্মত হয়নি।  ইতিমধ্যে দ্বিতীয় দফায় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ আর্ন্তজাতিক পরিসরে প্রস্তাব আহ্বান করে, যাতে শেল ও কেয়ার্ন অংশ নেয় ছয়টি ব্লকের জন্য। বেশ কয়েকটি আমেরিকান ও পশ্চিমা কোম্পানিও তাদের প্রস্তাব পেশ করে। 


শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণের জন্য লর্ড পিটার শোরের অনুরোধ

নতুন অবমুক্ত হওয়া নথিপত্রে দেখা যায়, বৃটেন–বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ার লর্ড পিটার শোর ২১ মে, ১৯৯৮ তারিখে প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে একটি চিঠি দিয়ে বলেন যে চলতি বছরের গ্রীষ্মে যুক্তরাজ্যে একটি সরকারি সফর সম্ভব কি না, সে বিষয়ে শেখ হাসিনা তাঁকে অনানুষ্ঠানিকভাবে খোঁজ  নিতে বলেছেন। তিনি শেখ হাসিনাকে কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে চেনেন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকেও তিনি চিনতেন উল্লেখ করে লর্ড শোর বলেন যে ১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সরকারি সফরে আসেন নি। তাই তাঁকে আমন্ত্রণ জানানো ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি বৈঠকের ব্যবস্থা করা হলে তাঁর যা সহযোগিতা প্রয়োজন তিনি তা করতে প্রস্তুত আছেন। ২৩ জুন ১৯৯৮ লর্ড পিটার শোরকে তাঁর চিঠির জবাবে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার লেখেন, চলতি বছরেই সফরটি সম্ভব হতে পারে, এবং ঢাকায় আমাদের হাইকমিশন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সুবিধাজনক তারিখ ঠিক করবে। টাইপ করা পাঁচ লাইনের চিঠির নীচে মি ব্লেয়ার নিজ হাতে লেখেন, ’প্রিয় পিটার আশা করি আপনি এখন ভালো বোধ করছেন।’


এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮ ফরেন ও কমনওয়েলথ অফিস (এফসিও)র এন্ড্রু প্যাট্রিক ডাউনিং স্ট্রিটে ফিলিপ বার্টনের কাছে চিঠি দিয়ে জানান যে শেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মার্ক মুডি–স্টুয়ার্ট ও কেয়ার্নের চেয়ারম্যান বিল গ্যামেল ঢাকায় গেছেন এবং ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎের সময় ঠিক হয়েছে। তার আগে এঁরা দুজন চান প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে তাঁদের জন্য যেন কথা বলেন। 


এফসিওর চিঠিতে বলা হয় ঢাকায় আমাদের হাইকমিশনারের মত হচ্ছে কিছুদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদ্রোহ নিরসনে যে শান্তিচুক্তি করেছেন, তার জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার একটি বার্তা পাঠালে ভালো হয়। অভিনন্দন জানানোর মধ্য দিয়ে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথার অবতারণা করাই ভালো বলে মত দিয়ে বলা হয় বার্তাটি ২৬ ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করা দরকার। এতে করে পরের দিন শেল ও কেয়ার্নের প্রতিনিধিদের বৈঠকে তা ভূমিকা রাখতে পারে।  




পাবর্ত্য শান্তুি চুক্তির অভিনন্দন বার্তায়ও গ্যাস কোম্পানির জন্য লবিং

২৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির জন্য শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি বার্তা পাঠান। ওই বার্তায়ও মি ব্লেয়ার সামুতাং ও হালদা এলাকায় কেয়ার্নের অনুসন্ধান কাজের কথা নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেন। বাংলাদেশে শেলের দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার কথাও বার্তায় উল্লেখ করা হয়। দ্বিতীয় রাউন্ডের দরপত্র বাছাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে কোম্পানি দুটো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রাখতে সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে মি ব্লেয়ারের বার্তা শেষ হয়। 


ওই বছরেই জুলাই–আগষ্টে ব্লক বরাদ্দের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার কথা থাকলেও তা যুক্তরাষ্ট্রের লবিংয়ের জন্য দীর্ঘায়িত হচ্ছিল বলে বৃটিশ কোম্পানিগুলোর মধ্যে ধারনা জন্মায়।  ২১ জুলাই, ১৯৯৮, কেয়ার্নের প্রধান নির্বাহী বিল গ্যামেল বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী জনাথন পাওয়েলের কাছে এক চিঠিতে অনুরোধ জানান যে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার যেন বৃটিশ কোম্পানিগুলোর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন।  এর আগে ৯ জুন ১৯৯৮ বৃটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের (এফসিও) পক্ষ থেকে ডাউনিং স্ট্রিটে এক চিঠি দিয়ে জানানো হয় যে, লর্ড শোরের চিঠির সূত্র ধরে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি সরকারি সফর চলতি বছরের নভেম্বরে সম্ভব কি–না তা জানার চেষ্টা করছিলাম। ১৫ জুলাই ১৯৯৮ তারিখেও আরেকটি চিঠিতেও এফসিও’র এন্ড্রু প্যাট্রিক ডাউনিং স্ট্রিটে ফিলিপ বার্টনকে জানান যে লর্ড শোর সর্বইউরোপীয় বঙ্গবন্ধু এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং  নভেম্বরে তাঁদের সংগঠনের বার্ষিক সভায় শেখ হাসিনার বক্তৃতা করার কথা আছে। তখন ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের ব্যবস্থা করা যায় কিনা। 


ওই চিঠিতে এফসিও জানায় যে শেল এবং কেয়ার্নকে ধারনা দেওয়া হয়েছিল যে ব্লক ১০ ও ৫ তাঁদের অনুকূলে বরাদ্দ করা হবে। কিন্তু এখন জোরালো গুজব শোনা যাচ্ছে যে ১০ নম্বর ব্লকের সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখা হচ্ছে এবং সেগুলো হয়তো অন্য কাউকে দেওয়া হবে। এতে বলা হয় শেল এমনকি বাংলাদেশ থেকে চলে আসার কথা ভাবছে। একই চিঠিতে বলা হয় সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের চাপে এমনটি ঘটছে। নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের সফরের সম্ভাবনার জন্য এটি বিলম্বিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। 


তবে এরই মধ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে এফসিওতে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হয় যে আগামী বছরের জুলাইয়ে একটি বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডনে আসার কথা আছে, তখন প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্ভব কিন। এফসিও ডাউনিং স্ট্রিটে ওই প্রস্তাবের কথাও জানায় এবং উল্লেখ করে যে এটি একটি নতুন প্রস্তাব। 


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরকে বৃটিশ সরকারের অতিথির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে এরপর এফসিও এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মধ্যে যেসব চিঠিপত্র আদানপ্রদান হয়, তার বেশ কয়েকটিতে বাংলাদেশের জ্বালানিখাতে বৃটিশ স্বার্থের উল্লেখ রয়েছে। যেমন ১১ নভেম্বর ১৯৯৮ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব এন্ড্রু প্যাট্রিক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কর্মকর্তা ফিলিপ বার্টনকে লেখেন, আমরা এ সফরে তাঁকে সরকারের অতিথির মর্যাদা দিতে চাই। গ্যাস অনুসন্ধান ও বিদ্যূৎ উৎপাদনসহ জ্বালানি খাতে বাংলাদেশের আমাদের স্বার্থ বাড়ছে। কেয়ার্ন এবং শেল ১০ নম্বর ব্লকের বিষয়ে চুক্তি সম্পন্ন করার কাছাকাছি আছে। তবে তা এখনো নিশ্চিত হয়নি এবং এই বিনিয়োগের জন্য তাদের অব্যাহত সমর্থন দরকার।  


লন্ডনে বাংলাদেশ উৎসবের পৃষ্ঠপোষকতায় সালমান রহমান

নতুন অবমুক্ত হওয়া দলিলপত্রে দেখা যায় ১৯৯৮ এর নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লন্ডন সফরের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজনকে ঘিরে। আর্টস ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফাউন্ডেশনের নামে ওই বাংলাদেশ উৎসব আয়োজিত হয়, যার যৌথ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন উভয় প্রধানমন্ত্রী। ১১ মার্চ ১৯৯৯ প্রধানমন্ত্রী ব্লেয়ার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে জুলাইয়ে ওই উৎসব উদ্বোধনের সফরটির সময়ে বৃটিশ সরকারের আতিথ্য গ্রহণের আমন্ত্রণ জানান। আর্টস ওয়ার্ল্ডওয়াইড নামের প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল বেক্সিমকো।  আর উৎসবে অংশ নেওয়া বাংলাদেশী অতিথিদের ঢাকা– লন্ডন যাতায়াতে সহায়তা দেয় বাংলাদেশ বিমান। 




মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...