সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

শেখ হাসিনা ও বেনজির ভুট্টো একসঙ্গে বৃটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর দেখতেন



সাবেক বৃটিশ উপনিবেশের দুটি রাষ্ট্রের দুজন নারী প্রধানমন্ত্রী, রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ও সক্রিয় ভূমিকায় আবির্ভুত হওয়ার আগে একসঙ্গে বৃটিশ পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব দেখতেন। এ দু’জন হলেন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পাকিস্তানের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো। যুক্তরাজ্য সরকারের সর্বসাম্প্রতিক অবমুক্ত করা গোপন নথিতে এই তথ্যের উল্লেখ রয়েছে। 


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনের পর প্রথমবারের মতো যুক্তরাজ্য সরকারের আমন্ত্রণে লন্ডন সফর করেন ১৯৯৯ সালের ৬ থেকে ৯ জুলাই। ওই সফরের সময়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তুতি হিসাবে ডাউনিং স্ট্রিটে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের জন্য যে সারসংক্ষেপ (ব্রিফিং পেপার) তৈরি করা হয়েছিল, তাতে এই তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।  গত ৩০ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালের মে থেকে ২০০১ সাল সময়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বিভিন্ন অপ্রকাশিত নথিপত্র অবমুক্ত করা হয়। ওইসব নথির মধ্যে পররাষ্ট্র বিষয়ক নথিপত্রের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। 


পিআরইএম ৪৯/১৭৩৮ নম্বর সম্বলিত নথিতে দেখা যায়, শেখ হাসিনার পরিচিতি, রাজনৈতিক জীবন, যুক্তরাজ্যের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচ্য বিষয়গুলো রয়েছে ঢাকা থেকে তৎকালীন বৃটিশ হাইকমিশনার ডেভিড ওয়াকারের পাঠানো শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পরিচিতি শিরোনামের নোটে।  এতে বলা হয়, শেখ হাসিনা লন্ডন খুব ভালো চেনেন । তাঁর পিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকান্ডের পর তিনি কিছুদিন লন্ডনে ছিলেন। সে সময়ে শেখ হাসিনা বেনজির ভুটোর সঙ্গে হাউস অব কমন্সের পিএমকিউ ( প্রাইমমিনিস্টর্স কোশ্চেন) দেখতেন বলে (বন্ধনীর মধ্যে) উল্লেখ করে বলা হয়েছে তিনি সরকার গঠনের পর বাংলাদেশের সংসদেও তা চালু করেছেন। অন্য কোনো সূত্র থেকে অবশ্য এ তথ্য যাচাই করা যায়নি। 


এতে লেখা হয় আওয়ামী লীগ লেবার পার্টির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক আছে বলে মনে করে, কারণ দলটির এমপিরা, বিশেষ করে পিটার শোর মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিল। ওই নোটে বলা হয় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরেছে। তারা জাতির পিতা শেখ মুজিবের সম্মান পুনরুদ্ধার করেছে। ওই সারসংক্ষেপে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্যের মধ্যে আছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি এবং বন্যার পর অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা। তবে ব্যর্থতা রয়েছে সুশাসনের মৌলিক ইস্যুগুলোতে। রাজনৈতিক পরিস্থিত অকার্যকর, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আইন–শৃঙ্খলা ও দূর্নীতি। রাজনৈতিক কৌশলে শেখ হাসিনা অত্যন্ত পারদর্শী বলেও ১৯৯৭ সালের ওই নোটে উল্লেখ করা হয়েছিল।  


হাইকমিশনারের নোটে লেখা হয়েছে তাঁর সম্পর্কে যা জানা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো তিনি জাতির পিতার কন্যা, যিনি ১৯৭৫ সালের আগষ্টে ভিন্নমতাবলম্বী সেনা কর্মকর্তাদের হাতে সপরিবারে নিহত হয়েছেন। শুধুমাত্র তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা তখন বিদেশে থাকায় বেঁচে যান। তাঁর হত্যাকারীদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছিল এবং অনেকেই ১৯৯৬–র মাঝামাঝি পর্যন্ত বিদেশে কূটনৈতিক চাকিরতে নিয়োজিত ছিল। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ওই দায়মুক্তির আইন অসাংবিধানিক ঘোষিত হয় এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত খুনিদের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার ও বিচার করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে। অনুপিস্থিত অন্যদেরও দন্ড দেওয়া হয়েছে। যতদূর জানা যায় অভিযুক্তদের কেউ যুক্তরাজ্যে নেই উল্লেখ করে ওই সারসংক্ষেপে বলা হয়, সাধারণভাবে মানুষ এই বিচার সমর্থন করছে। তবে হাইকমিশনার তাতে লিখেছেন, এখানে প্রতিশোধমূলক বিচারই রীতি।  


ওই সারসংক্ষেপ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বুদ্ধিমতী ও কর্মঠ এবং আওয়ামী লীগে তিনিই চূড়ান্ত র্কতৃত্বের অধিকারী। তিনি আলোচনায় থাকতে ভালোবাসেন এবং বিদেশ ভ্রমণের প্রতি তাঁর পক্ষপাত রয়েছে। 


 


শীর্ষপর্য়ায়ের আলোচনার ক্ষেত্রে যেসব বিষয় উঠতে পারে এবং সেগুলোতে বৃটিশ সরকারের অবস্থান বিষয়ক আরেকটি নোট, ’শেখ হাসিনা কল: চেকলিস্ট’ শিরোনামের তালিকায় দেখা যায় যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর অবদানের স্বীকৃতি, দ্বিপক্ষীয় সর্ম্পকে উন্নয়ন সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদশকে অগ্রাধিকার দেওয়া ( পূর্ববর্তী বছরের সাহায্যের পরিমাণ সাড়ে ছয় কোটি পাউন্ড), কেয়ার্নের সদর দপ্তর উদ্বোধন এবং শেল ও কেয়ার্নকে আরো দুটি গ্যাস ব্লক অনুসন্ধানের সুযোগ দেওয়ার পর তা উত্তোলনের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। 


বাংলাদেশ তখন কূটনীতিক ফারুক সোবহানকে কমনওয়েলথের পরবর্তী মহাসচিব পদে প্রার্থী করায় সমর্থন চাইতে পারে বলে অনুমানের ভিত্তিতে বৃটিশ সরকারের জবাব কী হবে তা–ও নথিতে উল্লেখ ছিল। লন্ডন ওই প্রার্থিতায় সমর্থন জানাতে প্রস্তুত ছিল না এবং বিষয়টি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার কথা জানানোর সিদ্ধান্ত ছিল। 


শীর্ষ বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে বিষয়টি অনুসন্ধান করা হবে বলে জানানোর কথা নোটে লেখা হয়। বাংলাদেশ তখন ফ্রিগেট কিনতে চাওয়ার প্রস্তাব দিতে পারে বলেও তাঁরা অনুমান করছিলেন এবং নোটে লেখা ছিল প্রস্তাবটি সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষার কথা জানানো হবে।


( প্রথম পর্ব পড়তে চাইলে এখানে পাবেন। )


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...