বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির পর ভাষা হিসেবে বাংলার উন্নয়ন কতটা হলো, ৭৫ বছর পর সে প্রশ্নের একটি আবেগবর্জিত পর্যালোচনার কথা কি আমরা ভেবেছি? আমাদের ভাষা আন্দোলনের ফল হিসেবে বাংলা একাডেমি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের জন্ম হয়েছে, যার কাজ হচ্ছে বাংলার প্রসার ও সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজ করা। পরে ২০১০ সালে দেশের ভেতরে মাতৃভাষার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ এবং বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারের উদ্দেশ্যে আইন করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। দ্বিতীয় এই প্রতিষ্ঠানও এক যুগের মতো কাজ করছে। কিন্তু বাংলার প্রসার কতটুকু ঘটেছে?
ভাষার প্রসার আপনা–আপনি হয় না। যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রায়োগিক কার্যকরতার ওপর নির্ভর করে ভাষার প্রসার। মানুষে মানুষে যোগাযোগের যেমন একটা মানবীয় দিক আছে, তেমনি আছে অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা। পরিবার ও সমাজে মানবিক সম্পর্কের কারণে যেমন আমাদের ভাষার প্রয়োগ দরকার হয়, তেমনি অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যও প্রয়োজন হয় ভাষার। ব্যবসা–বাণিজ্যের নিরিখে কোন ভাষার গুরুত্ব কত, সেটা তাই এখন উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে দেখা যাচ্ছে, কোন ভাষায় কত মানুষ কথা বলেন, শুধু তার নিরিখেই সেটির অবস্থান নির্ণয় করা হচ্ছে না; বরং অর্থনৈতিক প্রয়োজনে কতটা বেশি কাজে লাগছে, সেটার মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে সেই ভাষার গুরুত্ব। এমনকি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোন দেশ কতটা ক্ষমতাধর, সেটাও সেই দেশের ভাষার গুরুত্ব বা অবস্থান সমপর্যায়ে নিশ্চিত করতে পারে না।
বিশ্বে প্রায় পাঁচ হাজার ভাষা এখনো টিকে আছে। কিন্তু অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বহু দশক ধরে ইংরেজির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তারা তা উপনিবেশ তৈরির সময়ে সম্প্রসারিত করেছে; উপনিবেশ-উত্তর যুগেও টিকিয়ে রেখেছে। এখন যে বিশ্ব প্রযুক্তনির্ভর হয়ে পড়েছে, সেই প্রযুক্তির—বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ অনেকাংশেই ইংরেজিনির্ভর হয়ে আছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টার ২০২২ সালের নভেম্বরের হিসাব বলছে, বিশ্বে প্রায় দেড় শ কোটি মানুষ এখন ইংরেজি বলে। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে চীনের ম্যান্ডারিন ভাষা, তৃতীয় ভারতের হিন্দি। এ দুটো ভাষার লোকসংখ্যা যথাক্রমে ১১০ কোটি ও ৬০ কোটি। চতুর্থ হচ্ছে স্প্যানিশ (৫৪.৮০ কোটি), পঞ্চম ফরাসি (২৭.৪ কোটি) ও ষষ্ঠ আরবি (২৭.৪ কোটি)। আর সপ্তম অবস্থানটি হচ্ছে বাংলাভাষীদের, যাদের সংখ্যা হচ্ছে ২৭.২ কোটি।
কিন্তু অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিচারে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ক্ষমতার নিরিখে ভাষার সূচকে (পাওয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ ইনডেক্স র্যাঙ্কিং, ২০১৬) বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ভাষার অবস্থান যথাক্রমে ইংরেজি, চীনা, ফরাসি, স্প্যানিশ, আরবি, রুশ, জার্মান, জাপানি, পর্তুগিজ ও হিন্দি। শীর্ষ দশের তালিকায় বাংলা নেই। ভাষার ক্ষমতা নির্ধারণে যেসব বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে অর্থনীতিতে অংশগ্রহণে ভাষার সক্ষমতা, জ্ঞান ও গণমাধ্যম থেকে তথ্য আহরণের সক্ষমতা, ভৌগোলিক কূটনীতিতে যুক্ত হওয়ার সামর্থ্য, ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভাষার উপযোগিতা এবং সংলাপের ক্ষমতা।
ভাষাগত পরিচয়ধারী জনসংখ্যার সঙ্গে ভাষার অর্থনৈতিক মূল্যের এই ফারাকটা দূর করতে না পারলে বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার প্রসার কি আদৌ সম্ভব? ভাষার অর্থমূল্য বৃদ্ধি ঘটে কীভাবে, তা নিয়েও প্রচুর আলোচনা ও বিতর্ক পশ্চিমা দেশগুলোতে দেখা যাচ্ছে। ইংরেজি ভাষার আর্থিক ফায়দা সর্বোচ্চ কীভাবে লাভ করা যায়, তা নিয়ে যুক্তরাজ্যে প্রচুর পরীক্ষা–নিরীক্ষাও হয়েছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল নামের প্রতিষ্ঠানটির জন্মও প্রধানত ইংরেজির রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে। যুক্তরাজ্যের যে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও সমাদৃত, সেই বিবিসিও বহু দশক ধরে রেডিওর মাধ্যমে ইংরেজি শেখানোর বৈশ্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে এসেছে। আর গত শতকের শেষ দিকে শুরু হয়েছে ব্রিটিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিদেশে শাখা প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম।
এগুলোর মাধ্যমে যেমন ইংরেজির প্রসার ঘটছে, তেমনি শিল্প–সাহিত্যের মাধ্যমেও ইংরেজি ভাষার উল্লেখযোগ্য মূল্য সংযোজন ঘটেছে। সৃজনশীল শিল্পমাধ্যমের মধ্যে সিনেমা, নাটক ও গানের মাধ্যমে ইংরেজির প্রসার ও সমৃদ্ধির ধারাকে শক্তিশালী করতে সরকারিভাবে নানা ধরনের প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। সিনেমা তৈরিকে উৎসাহিত করতে সিনেমানগরী বানানোর জন্য বড় ধরনের কর ছাড় দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে বিনিয়োগ, যা থেকে দীর্ঘ মেয়াদে বিপুল মুনাফা আসবে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলা ভাষার বৈশ্বিক প্রসার ঘটাতে হলে ভাষার যে মূল্য সংযোজন প্রয়োজন, সেটা করতে আমরা কী করছি? কয়েক বছর ধরে বলা হচ্ছে, জাতিসংঘের কাজের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করা দরকার। এটি করতে পারলে তাতে আমাদের হয়তো কিছুটা রাজনৈতিক লাভ হবে। কিন্তু ভাষার অর্থমূল্য কি বাড়বে? আগেই দেখেছি যে অর্থমূল্যের দিক দিয়ে আরবি ও স্প্যানিশ ভাষা রুশ ভাষার চেয়ে এগিয়ে গেছে। অথচ রাশিয়া রীতিমতো একটি পরাশক্তি এবং জাতিসংঘের কাজে যে ছয়টি ভাষা আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহৃত হয়, তার অন্যতম রুশ।
জাতিসংঘ রেডিওতে ২০১২ সালে আমি বাংলা ভাষার কার্যক্রম শুরু করেছিলাম। তার আগে জাতিসংঘের কাজ করার ছয়টি ভাষা—ইংরেজি, ফরাসি, চীনা, রুশ, স্প্যানিশ ও পর্তুগিজের বাইরে আরবি ও সোয়াহেলি ভাষায় সংস্থাটির রেডিওর অনুষ্ঠান হতো। সে সময়ে বাংলার পাশাপাশি এমনকি হিন্দি ও উর্দু কার্যক্রম চালু করতেও আমি জাতিসংঘ রেডিওর শীর্ষ কর্তাদের সহায়তা করি। তবে এই তিনটি ভাষায় কার্যক্রম চালুর ব্যাপারটি খুব সুপরিকল্পিত কিছু ছিল না। এই কার্যক্রমের জন্য যে সামান্য অর্থ সংস্থাটি খরচ করেছে, তার পরিমাণ এতই অল্প যে তা দিয়ে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকাও প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। বাড়িতে বসেই সপ্তাহে একটি অনুষ্ঠান তৈরি করতাম এবং তা অনলাইনে সম্প্রচারের জন্য প্রকাশ করতাম। করোনাকালে ২০২১ সালে বাজেট–সংকটে জাতিসংঘ বাংলা রেডিওর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। তবে হিন্দি রেডিওর জন্য ভারত সরকার জাতিসংঘকে অতিরিক্ত চাঁদা দেওয়ায় তিন বছর ধরে অনুষ্ঠানটি দৈনিক হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের রেডিওর বাংলা কার্যক্রমের জন্য কৃতিত্ব দাবি করলেও তার ভিত্তি কী, তা আমার জানা নেই। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরও তারা জানে কি না সন্দেহ।
এ রকম বাস্তবতায় জাতিসংঘের কাজের অন্যতম ভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার জন্য বিপুল ব্যয়ের জোগান দিতে বাংলাদেশ কি সক্ষম? জাতিসংঘের কাজের যে পরিব্যাপ্তি, সেই বিপুল কার্যক্রমে বাংলায় ও বাংলা থেকে অন্য ছয়টি ভাষায় ভাষান্তর করার সক্ষমতা তৈরি করার খরচের ব্যবস্থা না করতে পারলে, সেটি সম্ভব বলে মনে হয় না।
বাংলা ভাষায় মূল্য সংযোজনের আরেকটি কার্যকর ও ভালো উপায় হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ভূমিকা বাড়ানো বা কার্যকর করে তোলা। বাংলা ভাষার সফটওয়্যার নিয়েই যে বিতর্ক ও বিশৃঙ্খলা, তাতে বাংলায় তথ্যপ্রযুক্তির কাজ কবে কতটা এগোবে বলা মুশকিল। চীনা বা জাপানি ভাষার মতো বাংলায় প্রোগ্রামিং কোড লেখার কাজ কতটা এগোল? বাংলায় অন্তর্জালের ঠিকানার (ইন্টারনেটের ডোমেন নেম) ব্যবহার সম্ভব হলেও তা দৃশ্যমান না। কেন হয়নি? কবে তা সম্ভব হবে?
বাংলা ফন্ট নিয়ে যে ঝামেলা, তার সমাধান গত তিন–চার দশকেও হলো না। আমি যখন বিবিসি বাংলার সম্পাদক ছিলাম, ২০০৪–০৫ সালের কথা, তখন প্রথম বিবিসির বাংলায় ওয়েবসাইট চালু করা হয়। ফন্টের জন্য তখন বিজয় ফন্টের উদ্ভাবক বর্তমান টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের সঙ্গে আমরা একটা চুক্তি করি। তিনি বিবিসির জন্য আলাদা করে ‘সুতন্বী বাংলা’ নামে একটি ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করে দেন। সেই ফন্ট নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা দেখেছি কম্পিউটারের বিভিন্ন সফটওয়্যারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খাপ খাওয়াতে বারবার তাঁর সহায়তা নিতে হয়েছে। অর্থাৎ নতুন নতুন সমস্যার নতুন নতুন সমাধান খুঁজতে হয়েছে।
সরকারি অনেক ওয়েবসাইটের বাংলা লেখা বিভিন্ন সময়ে সব ব্রাউজারে বা সব ডিভাইসে কিংবা সব অপারেটিং সিস্টেমে পড়া যায় না। সহজে ব্যবহার করা যায়, এমন অনেক ফন্টের উদ্ভাবন হলেও সেগুলো নিয়ে পর্যাপ্ত পরীক্ষা–নিরীক্ষা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা ভাষায় মূল্য সংযোজন কতটা করতে পারছি?
সাংস্কৃতিক মূল্য সংযোজনের দিক থেকেও আমাদের তেমন কোনো অগ্রগতি নেই। ইংরেজির পর চলচ্চিত্রের মাধ্যমে হিন্দির যে বৈশ্বিক প্রসার, তা রীতিমতো বিস্ময় সৃষ্টি করে। সম্ভবত সব মহাদেশেই হিন্দি চলচ্চিত্রের দর্শক আছে। পাঠান সিনেমার সাম্প্রতিক সাফল্যের কথাই এখানে স্মরণ করা যায়। কোরিয়ার পপ গানের ব্যান্ড কে–পপের বৈশ্বিক সাফল্যও এ রকম আরেকটি নজির। একই রকম সাংস্কৃতিক সাফল্যের নাগাল আমরা কবে পাব?
আমাদের অবশ্য বাড়তি একটা সুবিধা হচ্ছে বাংলাভাষীদের একটা বড় অংশ ভারতেও আছে। ভাষার মূল্য সংযোজনে সহযোগিতা ও সমন্বয়ে তাই একটা জোরালো উদ্যোগ নিশ্চয়ই সম্ভব। তবে শিগগিরই কিছু হওয়ার আশা নেই।
(২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন