নির্বাচন, গণতন্ত্র, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কিম্বা মানবাধিকারের প্রসঙ্গ উঠলেই আমাদের মন্ত্রীরা এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা হুঙ্কার দিয়ে বলে থাকেন, এসব বিষয়ে বিদেশিদের নাক গলানোর কোনো সুযোগ নেই। ক’দিন আগেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছেন নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের বক্তব্য ধর্তব্য নয়। তাঁর কথায় নির্বাচন নিয়ে তারা (বিদেশিরা) কি বলছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না।
জাতীয় নির্বাচনের আট মাস বাকি থাকতেই নির্বাচন প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে আসায় তিনি সেদিন সাংবাদিকদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আপনারা (গণমাধ্যমকর্মী) নিজেরা বকবক করেন, বিদেশিগুলারে দিয়ে বকবক করান।’ দেশে আর কোনো কাজ নাই? অনেক কিছু দেশে আছে। জলবায়ু, এমপ্লয়মেন্ট চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জের শেষ নেই। আপনারা এগুলো না বলে শুধু বকবক করেন নির্বাচন নিয়ে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই এখন স্বস্তিবোধ করছেন যে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের মতো আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গণতন্ত্র, নির্বাচন কিম্বা মানবাধিকারের কথা বলছে না। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রতিকূলতা মোকাবিলায় সক্ষমতা বাড়ানোার বিভিন্ন সংস্কার, প্রকল্প গ্রহণ ও তার অর্থায়নে ঋণ দেওয়ার বিষয়েই মনোযোগী হয়েছে। মানতেই হয় সরকারের ঋণভাগ্য ভালো।
২.
আইএমএফের ঋণ পাওয়া যে সবচেয়ে কঠিন, তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তাদের ঋণ অনুমোদনের আগে যেসব শর্ত মেনে নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে, তা স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশে সহজ কোনো কাজ নয়। তবে তাদের কাছ থেকে ঋণ পাওয়ার অর্থ হচ্ছে ঋণের যোগ্যতার প্রমাণ, যা অন্যান্য সূত্র থেকেও ঋণ পাওয়ার পথ খুলে দেয়। বাংলাদেশের জন্য নিকট ভবিষ্যতের ঋণপ্রবাহের একটা ব্যবস্থা তাই নিশ্চিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
আইএমএফের এই ঋণের মন্দ দিকটা অবশ্য এখন আর আড়ালে থাকছে না, খুব দ্রুতই প্রকাশ পাচ্ছে। আমাদের বিভিন্ন অর্থ ব্যবস্থাপনায় এখন যেসব নীতিগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে, সেগুলোতে ঢিলা দেওয়ার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। সে রকম হলে ঋণের কিস্তি ছাড় হবে না। ফলে অপ্রিয় ও গণদূর্ভোগের কারণ সৃষ্টিকারী বিভিন্ন কঠোর সংস্কার শুরু হয়েছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এর একটা সহজবোধ্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর কথায় ’কিছুটা হলেও নীতি-সার্বভৌমত্ব হারিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে সরকার ঋণ নিয়েছে’, যাকে তিনি ’নীতি-সার্বভৌমত্বের আত্মসমর্পণ’ অভিহিত করেছেন।
আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী প্রতি বছর কর-জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ হারে বাড়াতে অতিরিক্ত কর আদায় করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এছাড়া করছাড় যৌক্তিক করারও শর্ত রয়েছে। এগুলো নিজস্ব তাগিদে আরও আগেই করার কথা ছিল জানিয়ে তিনি বলেন দেশের অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী এ পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি, কিন্তু এখন সংকটে আইএমএফের দ্বারস্থ হওয়ায় তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদ্যুৎ-সারের দাম বেড়েছে, এর দায়িত্ব কে নেবে প্রশ্ন করে তিনি বলেছেন, আইএমএফের ঋণ নেওয়ার বিষয়টি সরকার অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু তা নিয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে আলোচনা হয়নি, মন্ত্রিসভার অর্থনীতিবিষয়ক উপকমিটিতেও আলোচনা হয়নি। জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ছাড়া এ ধরনের সংস্কার কীভাবে এগিয়ে যাবে, সে প্রশ্নও তোলেন তিনি।
শর্তের তালিকা অনেক লম্বা, যার সবগুলো সবসময়ে আলোচনায় আসে না। টাকার অবমূল্যায়ন, সুদের হার নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা, খেলাপি ঋণের বোঝা সামলাতে ব্যাংকখাতে সংস্কার, রপ্তানির আয়ের হিসাব মেলানো, বিদেশি দায়দেনার হিসাব দেওয়া এবং মুদ্রাস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের হিসাব ঠিক করার মতৌ বিষয়গুলোর সবই এখন আইএমএর কথায় হচ্ছে। এসব শর্তের জ্বালা কারো বুঝতে বাকি নেই। বিদ্যূতের ভর্তুকি কমানোর কথা বলে বারবার সাধারণ ভোক্তাদের জন্য দাম বাড়ানো হচ্ছে, অথচ এ খাতে যারা মুফতে মুনাফা করে চলেছেন, তাদের মুনাফা কমেছে – এমন কোনো তথ্য নেই। দায়মুক্তি আইনের সুবাদে অব্যবস্থাপনা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেটাও এখন টের পাওয়া যাচ্ছে। নতুন নতুন প্রকল্প উদ্বোধনের পর মাস না পেরোতেই কয়লার অভাবে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ডলার সংকটে জ্বালানি তেলের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় বেসরকারি প্লান্টের কাউকে কাউকে বসিয়ে রেখে পয়সা দিতে হচ্ছে। এগুলোর সংস্কার অর্থাৎ দায়মুক্তির অবসান ও অপশাসনের জবাবদিহির কথা অবশ্য আইএমএফের শর্তের মধ্যে নেই।
৩.
শুরুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি সেটা যে দিনের কথা, তার ঠিক একদিন আগে ছিল রানা প্লাজা ধসের ১০ বছর পূর্তির দিন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ৯ তলা ভবনটির ধসে প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক এবং আহত হয়েছেন ২ হাজার ৪৩৮ শ্রমিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। ওই মর্মান্তিক ধুর্ঘটনার পরও পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করায় ততদিন পর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় বড় কোনো পরিবর্তন হয়নি, যতদিন না বিদেশিদের চাপে বিশেষ কর্মসূচি অ্যাকর্ডের মাধ্যমে শুরু হয়। বাস্তবতা হচ্ছে পাশ্চাত্যের ভোক্তাদের প্রতিবাদ ও দাবির মুখে বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও তার প্রত্যয়ন বা সার্টিফিকেশনের ব্যবস্থা করে। দেশীয় শ্রমিক সংগঠন, অধিকারকর্মী ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর পক্ষ থেকে কারখানাগুলোর সংস্কারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেওয়া হলেও তা গ্রহণ করা হয় নি। ক্ষমতাসীন দল ও সংসদে পোশাক শিল্প মালিকদের প্রভাব ও দাপটেই তা সম্ভব হয় নি।
বিদেশিদের চাপ ও তদারকিতেই শেষ পর্যন্ত পোশাক খাতের সংস্কার হয়েছে। এখন পোশাক কারখানাগুলোর বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা ও পরিবেশবান্ধব হিসাবে বিশ্বে নজির তৈরি করেছে। কারখানাগুলোর এসব সংস্কারে নতুন বিনিয়োগের পর বৈশ্বিক বাজারের পোশাকের দাম কমলেও ওইসব কারখানা অলাভজনক হয়নি। বরং, অনেকে তাদের উৎপাদনক্ষমতা বাড়িয়েছে। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি নাটকীয়ভাবে কমেছে। বৈশ্বিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জোট ইন্ডাস্ট্রিঅল এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর জোট মিলে বাংলাদেশের অ্যাকর্ডের মডেল অন্যান্য দেশেও অনুকরণের উদ্যোগ নিয়েছে।
৪.
অর্থনীতি সামাল দিতে নীতি–সার্বভৌমত্বে ছাড় দেওয়া সম্ভব হলেও গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের প্রশ্নে সার্বভৌমত্বে বিন্দুমাত্র নড়চড় ঘটতে দিতে ক্ষমতাসীনেরা দৃশ্যত: রাজি নন। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে অপ্রকাশ্যে তাদের তুষ্ট করার চেষ্টা থাকে না। সদ্য ঘোষিত এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় দৃষ্টিভঙ্গী বা নীতির লক্ষ্য ও যৌক্তিকতা প্রকাশে অনেকে সেরকম আভাস দেখতে পেয়েছেন। ওই আউটলুকে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ইন্দো–প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ভালোই মিল পাওয়া যায়, যার সঙ্গে আবার জাপান এবং ভারতের নীতিকৌশলেরও তেমন বড় কোনো ফারাক নেই। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাম্প্রতিক যে টানাপোড়েন, তা এখন সত্যিই দূর হয় কিনা, তা নিয়ে জল্পনা থেকে নিবৃত্ত থাকা তাই বোধহয় অসম্ভব।
(৪ মে, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন