সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

রোহিঙ্গা সংকট: প্রতীকী প্রত্যাবাসনের লাভ–ক্ষতির হিসাব

হঠাৎ করেই খবর পাওয়া গেল, নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাইলট উদ্যোগে সবার সমর্থন চেয়েছে। ১৯ মে নিউইয়র্কে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আবদুল মুহিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্প সমর্থন করতে জাতিসংঘ, আসিয়ান এবং আঞ্চলিক দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। নিরাপত্তা পরিষদের যে সভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এই সমর্থন চান, সেটি আনুষ্ঠানিক ছিল না; বরং আররিয়া ফর্মুলা নামে পরিচিত অনানুষ্ঠানিক আলোচনা ছিল। মিয়ানমারের বিরাজমান সংকটের বিষয়ে যুক্তরাজ্যের আহ্বানে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। খবরটিতে অনেকেই একটু চমকিত হয়েছেন, বিস্ময়ে নড়েচড়ে বসেছেন।  


লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পাইলট প্রকল্প শুরু করার বিষয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে মিয়ানমার কোনো আহ্বান জানায় নি; আবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে মধ্যস্থতাকারী চীনও নয়। আহ্বানটি চীনের তরফ থেকে আসতে পারতো কি না, সে প্রশ্ন একেবারে অযৌক্তিক নয়। কেননা, চীন নিরাপত্তা পরিষদের অন্যতম স্থায়ী সদস্য এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা বা তিরস্কারমূলক প্রস্তাব গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশটি এ পর্যন্ত কখনোই সমর্থন দেয়নি। সম্প্রতি দেশটির পক্ষ থেকে খোলামেলাভাবেই বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধানে তারা মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। মধ্যস্থতা বা সহায়তাকারী দেশ হিসাবে অন্য সবার কাছে তারা সহযোগিতা চাইলে তাই ততটা বিস্মিত হওয়ার কিছু ছিল না। 


বাংলাদেশ যে ১২ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নিয়ে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের মধ্যে আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এর মধ্যে আর্ন্তজাতিক সহায়তা বিপজ্জনকভাবে কমছে। সর্বসম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, ডাব্লু এফপি, পরিবারপ্রতি মাসিক খাদ্য সহায়তা আরো কমিয়ে পরিবারপ্রতি মাসিক আট ডলার নির্ধারণের কথা জানিয়েছে। এর পরিণতি উদ্বাস্তু নারী–শিশুদের ওপর কতটা মারাত্মক হবে, তা নিয়ে ত্রাণকর্মীরা রীতিমতো শঙ্কিত।


প্রত্যাবাসনের জন্য জোর চেষ্টা চালানো তাই স্বাভাবিক। কিন্তু ২০১৭ সালে নতুন করে উদ্বাস্তুর ঢল নামার পর থেকে গত ছয় বছরে প্রত্যাবাসনের সামগ্রিক পরিকল্পনা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতা ছাড়া একটি প্রতীকী প্রত্যাবাসন শুরু কেন এতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা মিলছে না। মিয়ানমার যে তাদের ভাষায় কথিত ’বাস্তুচ্যূত লোকজন’ ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে নানা ধরনের অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করে এসেছে, তা কারোরই অজানা নয়। রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাইয়ের প্রক্রিয়ায় বছরের পর বছর পার করে মাত্র হাজার খানেক উদ্বাস্তুকে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ছাড়াই ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ ও প্রস্তুতির যে কথা তারা জানিয়েছে, তা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আন্তরিকতার স্বাক্ষ্য বহন করে না। বরং, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এই প্রতীকী প্রত্যাবাসনের সূচনা মিয়ানমারের একটি রাজনৈতিক কৌশলমাত্র। 


রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তরিক উদ্যোগের বদলে প্রতীকী বা পাইলট প্রকল্পে মিয়ানমারের আগ্রহের বিষয়টি দেশটির বিরুদ্ধে আর্ন্তজাতিক আদালতে গাম্বিয়ার দায়ের করা বিচারাধীন গণহত্যার মামলার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই মামলায় গণহত্যা থেকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়ার যে অর্ন্তবর্তী আদেশ আদালত ২০২০ সালের জানুয়ারিতে দিয়েছিল, সেই অর্ন্তবর্তী পদক্ষেপের শুনানিতে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে পেশ করা যুক্তি এখানে স্মরণ করা দরকার। ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর মিয়ানমারের পক্ষে আদালতে যে আইনজীবি ও বিশেষজ্ঞদল বক্তব্য পেশ করেছিলেন, সেই দলের একজন সদস্য ছিলেন লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্ন্তজাতিক আইনের অধ্যাপক ফোবি ওকোওয়া। 


মিসেস ওকোওয়া মামলাটি কেন চলতে পারে না, তার পক্ষে চারটি যুক্তি তুলে ধরেন: (ক) প্রথমত:, গাম্বিয়াকে আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে যে মিয়ানমারের গণহত্যা সনদ লঙ্ঘনের একটি বাস্তব এবং আসন্ন ঝুঁকি এখন রয়েছে; (খ) দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি গণহত্যার আসন্ন ঝুঁকির দাবির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কেননা, মিয়ানমার বর্তমানে বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের প্রত্যাবাসনে সহায়তা করার জন্য প্রত্যাবাসন উদ্যোগে নিয়োজিত আছে, যে উদ্যোগে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সমর্থন রয়েছে। সেখানে আশু গণহত্যার ঝুঁকি থাকলে এসব শক্তির সমর্থন সম্ভব হতো না; (গ) তৃতীয়ত, মিয়ানমার বর্তমানে রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগে নিযুক্ত রয়েছে, যারা সেখানে আছে বা যারা সেখানে ফিরে আসবে তাদের রক্ষা করা এবং অতীতের সহিংসতার জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনারও চেষ্টা করছে। এগুলো গণহত্যার অভিপ্রায় প্রকাশ করে না; এবং (ঘ) রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক অস্থিতিশীলতার জন্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর  ভূমিকা গাম্বিয়া স্বীকার করতে ব্যর্থ হয়েছে।


প্রত্যাবাসনের আলোচনা যে কত বড় অজুহাত হতে পারে আদালতে মিসেস ওকোওয়ার পেশ করা বক্তব্যে তা স্পষ্ট। চারবছরেও সেই উদ্যোগের বিন্দুমাত্র বাস্তবায়িত হয়নি। এখন প্রতীকী প্রত্যাবাসনের সঙ্গেও যে আদালতের শুনানি প্রক্রিয়ার কোনো সম্পর্ক নেই, সে কথা কি বলা যাবে? আদালতে মামলার সাম্প্রতিক অগ্রগতিগুলো এখানে দেখে নেওয়া যাক। 


গাম্বিয়ার পেশ করা আরজির জবাব দাখিল করতে মিয়ানমারের জন্য গত ২৪ এপ্রিল সময়সীমা নির্ধারিত ছিল। তখন তাদের তরফে একটা তাড়াও লক্ষ্য করা গেছে। তড়িঘড়ি করে তাদের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে উদ্বাস্তু শিবিরে এসেছে, রোহিঙ্গাদের কয়েকজন প্রতিনিধিকে তাদের প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্য জায়গা ও প্রস্তুতি দেখাতে নিয়ে গেছে। ওদিকে তারা আবেদনে করেছিল সময় বাড়ানোর এবং আইসিজে সময়টা ২৪ মে পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়ার পর দেখা গেল তাড়া কিছুটা কমেছে। ইতিমধ্যে তারা আবারো আবেদন করে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়ার জন্য। গত ১২ মে আদালত তাদের আবেদন ও গাম্বিয়ার বক্তব্য বিচার–বিশ্লেষণ করে এখন ২৪ আগস্ট পর্যন্ত সময় মঞ্জুর করেছেন।   


মিয়ানমারের এই যে সময় বাড়ানোর আবেদন, তার একটিতে দেশটির পক্ষ থেকে কেন বাড়তি সময় প্রয়োজন, তার যুক্তি তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরে বর্তমানে বসবাসরত সাক্ষীদের কাছে বাংলাদেশ তাদের যেতে দেবে এমন সম্ভাবনা কম; আর যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে শিগগিরই কোনো রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ফিরে আসবে সেই সম্ভাবনাও নেই ( দেখুন, আদালতের ৬ এপ্রিল, ২০২৩ এর আদেশ, আইসেজের ওয়েবসাইট )। রোহিঙ্গাদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়ার সদিচ্ছা থাকলে আদালতের কাছে তাঁরা বলতেন না যে শিগগিরই তাদের ফেরৎ যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। এথেকে বোঝা যায়, মামলার শুনানি বিলম্বিত করা এবং মামলায় নিজেদের সাফাই দেওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করাই হচ্ছে মিয়ানমারের লক্ষ্য এবং সে জন্যই বিভিন্ন কৌশল উদ্ভাবন।  


এ পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা কার্যত মিয়ানমারকে আইসিজের গণহত্যার মামলায় সহায়তা কি না, সে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা দরকার। প্রত্যাবাসন এবং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে দ্বিপক্ষীয় অথবা বহুপক্ষীয় আলোচনার প্রয়োজনীয়তা কেউ অস্বীকার করছে না। আসিয়ান এবং জাতিসংঘও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রতি সমর্থন দিয়ে এসেছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া কোনো সমঝোতায় টেকসই সমাধান মিলবে না। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এ শিক্ষা নিশ্চয়ই আমাদের হয়েছে? 


(২৫ মে, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...