ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নির্বিচার প্রয়োগ, যা কার্যত অপপ্রয়োগ বলেই ভুক্তভোগী ও সমালোচকরা বলে আসছেন, তা স্থগিত করার জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান আহ্বান জানিয়েছিলেন প্রায় ছয় সপ্তাহ আগে। আইনটি স্থগিত হয় নি, বরং স্থগিতের প্রসঙ্গটি সরকারের পক্ষ থেকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আইনটি বাতিল করা হবে না। আইনটির বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের বিশেষজ্ঞরা যেসব সুপারিশ করেছেন, তা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে প্রয়োজনে সংস্কার করা হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। সুপারিশগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষার সময়ে আইনটি স্থগিত রাখা কেন সম্ভব হলো না, তার কোনো ব্যাখ্যা দেশবাসীকে দেওয়া হয়নি; হাইকমিশনারকে জানানো হয়েছে কি–না, তাও আমরা জানি না। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আইনটি বাতিল বা স্থগিত রাখায় সমস্যা কী?
আইনটি এতটাই সমস্যাপূর্ণ যে সম্পাদক পরিষদ, বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন, মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো এবং প্রায় সব বিরোধী রাজনৈতিক দল এটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে। চলমান বিতর্কে মধ্যে মূল ধারার সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন সম্পাদক পরিষদ আইনটি বাতিল চেয়ে তাঁদের দাবির পক্ষের যুক্তিগুলো প্রথম তুলে ধরে ২০১৮ সালের ৮ মে। আইনটির বিরোধিতার মূল কথা ছিল, ”এমন একটি আইন করা হয়েছে, যা সংবাদমাধ্যমের কর্মকান্ডের ওপর নজরদারি, বিষয়বস্তুর ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং আমাদের সংবিধানপ্রদত্ত সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং নাগরিকদের বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করবে।”
এর মূল গলদ তুলে ধরতে গিয়ে তারা বলেছিল, এ আইনে অস্পষ্টতা আছে এবং এতে এমন অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে এবং সহজেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে। তারা আরও বলে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন এমন এক আতঙ্ক ও ভীতির পরিবেশ তৈরি করবে, যেখানে সাংবাদিকতা, বিশেষত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে। সম্পাদক পরিষদ তখন নয়টি ধারার সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণ তুলে ধরে আইনের সংজ্ঞায়নে সমস্যা, তার অপব্যবহারের সম্ভাব্য পরিধি এবং সাজার অত্যধিক কঠোরতার বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছিল। জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের সুপারিশমালাতেও একই রকম বিশ্লেষণ পাওয়া গেছে।
আইনটিতে তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে,” ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্তকরণ, প্রতিরোধ, দমন, বিচার ও আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে বিধান প্রণয়নকল্পে” এটি করা হয়েছে। এ আইনের অধীনে গঠিত ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি বা সরকারের অন্য কোনো শাখা এ আইনে কী কী অপরাধে, কতজনের বিরুদ্ধে, কী ধরনের মামলা হয়েছে এবং তার কতগুলোর আইনগত নিষ্পত্তি হয়েছে, তার কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি বাংলাদেশে সাইবার হুমকির একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০২২ সালের প্রতিবেদনটি সংস্থার ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে, যার বিবরণ পড়ে এ আইনটি তৈরির উদ্দেশ্য ও প্রয়োগে কতটা বিচ্যূতি ঘটছে, তার একটা স্পষ্ট ধারনা পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটিতে দেখা যাচ্ছে, গত বছরে বাংলাদেশের সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী, বাংলাদেশ ডিফেন্স কমান্ড এন্ড স্টাফ কলেজ এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সাইবার হুমকির শিকার হয়েছে। এসব বাহিনীর ইমেইল ডোমোইনে ফিশিংয়ের চেষ্টা চলেছে। ফিশিং হচ্ছে বিশ্বস্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ধারণ করে এবং জরুরি তাগাদা দেখিয়ে মেইলের মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার ম্যালওয়্যার। প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছে কোভিড টিকা কার্যক্রম সম্পর্কিত জাতীয় পোর্টালটি। অবশ্য এসব চেষ্টায় কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, বা কতটা ক্ষতি হয়েছে, কিম্বা অপরাধীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেসব বিষয়ে কোনো উত্তর প্রতিবেদনটিতে নেই।
এতে আরো বলা হয়েছে ভূ–রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো ধাক্কা বাংলাদেশের সাইবারজগতেও চ্যালেঞ্জ বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, কোভিডের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট কাটিয়ে না উঠতেই ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতগুলো সাইবারজগতে কীভাবে ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে। হুমকি সৃষ্টিকারীদের মধ্য আছে রাষ্ট্রীয় শক্তি, হ্যাকার গোষ্ঠী এবং বিভিন্ন বিষয়ে আন্দোলনকারীরা। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকারের কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম, যারা বিজিডি ই–গভ সিআইআরটি নামে পরিচিত্। তারা বলছে, গত বছর বাংলাদেশের সরকারি আর্থিক, সামরিক, শিল্প, বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা, স্টার্ট–আপ এবং জ্বালানি খাতগুলোতেও অনন্য সাইবার আক্রমণ তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। কী কী ধরনের সফটওয়্যার বিভিন্ন কম্পিউটার বা নেটওয়ার্ক অবকাঠামোতে অনুপ্রবেশ, বাধা সৃষ্টি বা তথ্য হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, তার তালিকা ও উৎসগুলোর কথাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এ সব হুমকির উৎস বেশিরভাগই বিদেশে।
সরকারিভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগবিষয়ক তথ্য–উপাত্ত প্রকাশ না করা হলেও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সংকলিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ আইনে মামলা যা হয়েছে, তার প্রায় সবই রাজনৈতিক অথবা ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব–বিদ্বেষ ঘিরে। ভিন্নমত প্রকাশ বা সরকার ও রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা বন্ধ করা, কথিত মানহানি এবং জনশৃঙ্খলার অভিযোগ তুলেই এসব মামলা দায়ের হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সাংবাদিক, শিক্ষক–গবেষক, ছাত্র এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে।
জনপরিসরে প্রাপ্য তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, সাইবার হুমকি মোকাবিলা বা নিয়ন্ত্রণে এ আইন তেমন কোনো কাজে আসেনি। এর প্রধান একটি কারণ হচ্ছে ভূ–রাজনৈতিক কারণে আর্ন্তজাতিক পরিসরে ভিন্ন রাষ্ট্র অনুমোদিত আক্রমণ এবং টিকাবিরোধীদের মতো গোষ্ঠীর অপরাধের ক্ষেত্রে এ আইনের নাগাল পৌঁছায় না। ওই সব হুমকি মোকাবিলায় বৈশ্বিক জোট, সমন্বয় ও ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। বিপরীতে আইনটি যে রাজনৈতিক নিবর্তন ও হয়রানির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে, তা স্পষ্ট।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করলে যে গুজবের মাধ্যমে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট ও জনশৃঙ্খলা নষ্ট হবে – এমন যুক্তি একেবারেই অচল। কেননা, আমাদের দন্ডবিধিতে এসব কাজ অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা আছে ও তার সাজাও নির্ধারিত আছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আইনটি সংশোধনের আশ্বাস দিলেও যে দুটি ধারা বাতিলের জন্য জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ নাকচ করে দিয়েছেন, তার একটি হচ্ছে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সম্পর্কিত এই ধারাটি। আর অন্য যে ধারাটি তিনি সংশোধন করা হবে না বলে জানিয়েছেন সেটি হচ্ছে ধারা ২১।
ধারা ২১ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রপাগান্ডা বা প্রচারণার দণ্ড। বিষয়টি প্রথমবারের মতো অপরাধ হিসাবে সংজ্ঞায়িত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এবং এর মূলে আছে বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি। আইনটি বাতিল বা স্থগিত করতে অস্বীকৃতির কারণটি যতটা না ডিজিটাল অপরাধ দমনের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক – এ ধারনা তাই নাকচ করা সহজ নয়। সাইবার অপরাধ বা হুমকি থেকে নাগরিকদের সুরক্ষার বদলে আইনটি ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে পরিণত হওয়ার ব্যাখ্যাও এর মধ্যেই নিহিত আছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলে আইনটি বাতিলে আর কোনো বাধা তো চোখে পড়ে না।
(১১ মে, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন