বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রক্রিয়া যাতে গণতান্ত্রিক হয়, নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়, সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র ভিসার হুমকি ঘোষণার পর দেশে তিনটি মহানগরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথমটি হয়েছে ভিসা নীতি ঘোষণার মাত্র একদিন পর। তবে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিস্ময়করভাবে গলা মিলিয়ে ওই ভিসানীতিকে স্বাগত জানিয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সরকারের যে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছে। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে সরকারের সুর বদলাতে শুরু করেছে এবং কোনো ধরনের হুমকিকে পরোয়া না করার ঘোষণাও এসেছে। এরপর অনুষ্ঠিত হলো খুলনা ও বরিশালের সিটি নির্বাচন। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনগুলো কেমন হলো, তার নানা রকম মূল্যায়ন পাওয়া যাচ্ছে,যা কিছুটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যতাড়িত।
নির্বাচন কমিশনের মূল্যায়নে ‘সার্বিক অর্থে সুন্দর ও সুচারুভাবে নির্বাচন হয়েছে। কমিশন সন্তুষ্ট।’ তবে এই সুন্দর নির্বাচন ও সন্তুষ্টির একটা মান নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। বরিশালে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের হামলায় আহত হলেও ’ইন্তেকাল’ না করায় তাঁর কাছে আর কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আহত হলে তিনি এমন দায়িত্বহীন ও নিন্দনীয় কথা বলতেন কি না, সন্দেহ আছে। অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুপস্থিতিতে এসব নির্বাচন যেমন হয়েছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার আসল লড়াই হবে তার চেয়ে ঢের বেশি প্রতিযোগিতার। ফলে এতে সহিংসতার আশঙ্কা থাকে প্রবল। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ঠিক করা মাপকাঠি অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী দলের কারো ইন্তেকাল না হওয়া পর্যন্ত সহিংসতা গ্রহণযোগ্য বলে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসন যদি মনে করে, তাহলে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলো কেমন হবে, তার একটা ধারনা এখন পাওয়া যাচ্ছে।
গাজীপুরে ভোটের দিন কোনো ঝামেলা না হলেও ভোটের আগে নির্বাচন মোটেও হাঙ্গামামুক্ত ছিল না। ক্ষমতাসীন দলের মনোনীত ও মনোয়নয়নবঞ্চিত দুই রাজনীতিকের গোষ্ঠীগত লড়াইয়ে একপক্ষ প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতা ও সুরক্ষা পেলেও অন্য পক্ষের প্রার্থিতা বাতিল থেকে শুরু করে তাঁর বিকল্প প্রার্থীর প্রচারে বারবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুত্রের পরিচয়ের সূত্র ধরে প্রার্থী হওয়া নারী তাই সম্ভবত যথেষ্ট পরিমাণে সহানুভূতির ভোট লাভ করেছেন।
রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সিটি নির্বাচনে যে কটিতে সবার আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে, সেগুলোতে দুটো বিষয় লক্ষ্যণীয় – প্রথমত, ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীগত লড়াই যেখানে প্রবল, আর, দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দল যেখানে প্রার্থী বদল করেছে অথবা বাইরে থেকে কাউকে আমদানি করেছে, সেখানে।। বরিশাল ও গাজীপুর দুই মহানগরে আগের মেয়রদের পুর্ননির্বাচনের সুযোগ না দেওয়ার প্রধান কারণ তাদের বিরুদ্ধে নানা রকম অন্যায়–অনিয়মের অভিযোগ। এক্ষেত্রে বরিশাল ও সিলেটে যথাক্রমে ঢাকা ও লন্ডন থেকে নতুন মুখ পাঠানো হয়েছে, যারা স্থানীয় রাজনীতিতে যুক্ত না থাকায় দলের জুলুমবাজদের থেকে তারা নিজেদের আলাদা হিসাবে তুলে ধরতে পারছেন। দ্আবার যেখানে উপদলীয় সংঘাত প্রকট নয়, সেখানে আগের নেতারাই পুর্ননির্বাচনের সুযোগ পেয়েছেন। তাঁদের নির্বাচন একেবারেই নিরুত্তাপ।
নির্বাচন কমিশনের মতোই ক্ষমতাসীন দলও সিটি নির্বাচনের ফলাফলে বেশ সন্তুষ্ট বলেই মনে হয়। মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলেছেন, এসব নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ প্রমাণ করেছে, বিএনপির নির্বাচন বর্জনে কিছুই আসে যায় না। তাঁরা আরো বলছেন, বিএনপিকে এখন রাজনীতিতে টিকতে হলে নির্বাচনে আসতেই হবে। গাজীপুর, বরিশাল এবং খুলনায় ভোটাের হার পঞ্চাশ শতাংশের আশপাশে, যা স্বাভাবিক প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়, সেটা তাঁরা হয় ইচ্ছে করেই আড়াল করছেন, নয়তো ভুলে গেছেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সবসময়েই ভোটের হার বেশি হয়।
বিএনপিসহ প্রধান প্রধান দলের অংশগ্রহণে সিটি করপোরেশনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার্পূণ নির্বাচন সর্বশেষ হয়েছিল ২০১২ ও ২০১৩ সালে। ওইসব নির্বাচনে গড়ে ভোটের হার ছিল ন্যূনতম ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ। এমনকি ২০১৭ ও ২০১৮ তে কুমিল্লা ও সিলেটে বিএনপি শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকায় ওই দুই মহানগরে ভোটের হার বেশি ছিল। কিন্তু খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহীতে বিএনপির প্রার্থীরা দিনের প্রথম ভাগে ভোট বর্জন করায় সে হার অনেক কমে যায়। সুতরাং প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাজনৈতিক দলের একটির অনুপস্থিতি যে নির্বাচনকে যথেষ্ট প্রতিনিধিত্বশীল করে না, সে কথা অস্বীকার করা যায়না।
এবারের সিটি নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দল সম্ভবত জাতীয় পার্টি, যারা সংসদে সরকার মনোনীত বিরোধীদল হিসাবে প্রায় এক দশক পূর্ণ করতে চলেছে। গাজীপুরে তাদের প্রার্থী জামানত খুইয়ে চতূর্থ হয়েছেন, আর বরিশাল ও খুলনাতেও তাদের অবস্থান চতূর্থ। দলটির অধোগতির সুফল অবশ্য তুলে নিয়েছে চরমোনাই পীরের অনুসারীরা। তাদের ইসলামী আন্দোলন মহানগরগুলোর ভোটের হিসাবে এখন জাতীয় পার্টির চেয়ে বড় দল। জাতীয় পার্টির জন্য আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ভোটের ব্যবধানে কিন্তু তাদের পিছিয়ে পড়ার ব্যবধান ক্রমশই বাড়ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা হুমকির পটভূমিতে এসব নির্বাচন থেকে কার কতটা লাভ হলো , অথবা ঝুঁকি বাড়ল? নির্বাচন কমিশন তিনটি সিটির ভোট বিনা বাধায় সম্পন্ন করতে পারায় যতই সন্তুষ্টির কথা বলুন না কেন, নির্বাচনী প্রচারে সহিংসতা বন্ধ করতে না পারায় গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার পরীক্ষায় উতরানোর সামর্থ্য ও যোগ্যতার প্রমাণ এখনো মেলেনি। উপরন্তু বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেপ্তার না করতে সরকারকে অনুরোধ জানাতে কমিশন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে সংসদে আইনমন্ত্রীর ঘোষণায় প্রশ্ন ওঠে, নির্বাচন পরিচালনায় কীধরনের ব্যবস্থা প্রয়োজন, সেই সিদ্ধান্ত কে নিচ্ছে – নির্বাচন কমিশন, না সরকার? তাহলে কমিশনের স্বাধীনতা আদৌ আর থাকে কি?
রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ প্রশ্নে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সংযত হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা, নির্বাচনী প্রচারে হামলা, প্রার্থীকে আক্রমণ – কিছুই বন্ধ হয়নি। তবে, নেতাদের অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ–উৎকন্ঠার ছাপ স্পষ্ট। প্রশাসনেও পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। তা না হলে প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের মতবিনিময় সভায় এক পদস্থ আমলার কন্ঠে ’এখানে গণতন্ত্রের গ–ও নেই’ মন্তব্য শোনা যেত না।
ভিসা নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি দায়িত্বশীল কূটনীতিক সূত্র অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেছে, তাঁদের তথ্য বলছে, পদস্থ রাজনীতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের প্রায় আশি শতাংশের পরিবারের কেউ না কেউ লেখাপড়া, ব্যবসা অথবা অভিবাসন সূত্রে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছে। উগান্ডা বা নাইজেরিয়ার মতো দেশের থেকে বাংলাদেশের বেলায় পার্থক্য স্পষ্ট করে ওই সূত্র জানায় যে সাত মাস আগে এই নীতি ঘোষণার উদ্দেশ্য হচ্ছে, নির্বাচনের আগেই যাতে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পরিচয় নির্দিষ্ট না করেও ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণার সুযোগ রয়েছে বলেও সূত্র উল্লেখ করেছে।
কোনো দল নির্বাচন বর্জন করলে তাদের উপর নির্বাচনে অংশগ্রহণের চাপ হিসেবে এই নীতি কাজ করবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, কোনো দল যদি মনে করে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি না হওয়ার তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না, সে অধিকার তাদের রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সেকারণেই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক হতে হবে – এমন কোনো কথা বলছে না। তবে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না ঘোষণা দিয়ে সহিংস বাধা দিলে বিরোধী দলও ওই নীতির আওতায় পড়বে। সরকারের ধারাবাহিকতার পক্ষে থাকা আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সম্ভাব্য উদ্বেগ ও আপত্তির বিষয়ে ওই কূটনৈতিক সূত্র বলেছে, বর্তমান স্থিতিশীলতায় তারা সাময়িক স্বস্তিবোধ করলেও যুক্তরাষ্ট্র মনে করে কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী অস্থিরতার ঝুঁকি সবার জন্যই বিপদ বাড়াবে।
সুষ্ঠূ ও অবাধ নির্বাচনের জন্য আদতে যে রাজনৈতিক সমঝোতা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ প্রয়োজন , তা যদি নিজেরাই নিজস্ব তাগিদে তৈরি করা সম্ভব হয়, তাহলে এ সব শর্তের আলোচনা একেবারেই অপ্রৌজনীয়। আমাদের সেই বোধোদয় আদ্য হবে কি?
(১৫ জুন, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন