তাঁর সম্পর্কে যখন প্রতিদিনই নতুন নতুন দুর্নীতির অভিযোগ বেরোচ্ছে এবং বিদেশে তাঁর অবস্থান সম্পর্কে রহস্য তৈরি হয়েছে, তখন আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ’বেনজীর আহমেদের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনী নেবে না’(বাসসের খবরের শিরোনাম ১ জুন, ২০২৪)। দায় না নেওয়ার কথাটি এর আগেও শুনেছি বলেই মনে হলো। সুতরাং, এমন কথা আর কে বলেছেন, কবে বলেছেন, তা যাচাইয়ের চেষ্টায় গুগলের শরণাপন্ন হলাম। আপনারাও দেখতে পারেন, বিফল হবেন না। তালিকাটা অনেক দীর্ঘ হয়ে যেতে পারে। তাই বাছাই করা কয়েকটি এখানো উদ্ধৃত করাই শ্রেয়।
পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়া নিয়ে নানা সমালোচনার মুখে বেনজীর আহমেদের পূর্বসুরি সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের মুখেও এমন কথা উচ্চারিত হয়েছে ২০১৬ সালে। সিলেটে এক সভায় তিনি বলেন, ‘পুলিশের কোনো সদস্য যদি কোনো অপরাধ করে, ওটা তার দায়িত্ব, তা আমার বিভাগের দায়িত্ব না।’ হুবহু না হলেও প্রায় একইধরনের কথা অন্যান্য আইজিপিরাও তাঁদের দায়িত্বপালনের সময়ে বলেছেন। তবে এবারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, পুলিশের শীর্ষকর্তার অপরাধের দায় পুলিশ বাহিনীর নয়।
অথচ বেনজীর র্যাব এবং পুলিশের প্রধান থাকার সময়ে ওই দুই বাহিনীর সদস্যদের কাজে লাগিয়েছেন। ভয় দেখিয়ে সংখ্যালঘুদের জমি দখলে নিতে পুলিশ শুধু তাদের বড় কর্তার হুকুম প্রতিপালন করেছে, তা–ই নয়. তার পাহারাদারিও করেছে বলে ভুক্তভোগীরা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন। গাজীপুরেও ক্ষমতার জোরে সরকারের বন বিভাগের জমি জবরদখল করেছেন। প্রতিষ্ঠান হিসাবে পুলিশকে বেআইনি ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহারের এমন নজির তৈরির পরও পুলিশকে দায়মুক্তি দিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফলে পুলিশ বাহিনীর মাঠপর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা বা সদস্য তাঁর অন্যায় আদেশ বেআইনিভাবে কার্যকর করেছেন, তাঁদের আর জবাবদিহির অবকাশ থাকছে না।
পুলিশের সঙ্গে রাজনীতিকদের সম্পর্কের সমীকরণ কেমন তার একটা স্বীকারোক্তি শহীদুল হকের কথাতেই আছে। বছর দুয়েক আগে তিনি তাঁর বই ‘পুলিশ জীবনের স্মৃতি: স্বৈরাচার পতন থেকে জঙ্গি দমন’ –এর প্রকাশনা উৎসবে বলেন, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল চায় তারা যা বলবে পুলিশ তাই করবে; সংসদ সদস্য চান, তিনি যা বলবেন ওসি সেটাই করবেন। এসব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে কাজ করা খুবই কঠিন (ক্ষমতাসীনরা চায় তারা যা বলবে পুলিশ তাই করবে: সাবেক আইজিপি, সংবাদ, ২৮ মে, ২০২২)।
দেশে নিরাপত্তা ও আইনপ্রয়োগের কাজে যাঁরা মূল দায়িত্বে ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্কের কথা এখন আর ক্ষমতাসীন দল নিতে চাইছে না। যে কারণে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এখন বলছেন যে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়া সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ আওয়ামী লীগের লোক নয়। সরকারি চাকরিতে থেকে দলের সদস্য হওয়ার সুযোগ নেই বলে এমন ব্যাখ্যা দাঁড় করানো খুবই সহজ।
কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের সুনজর ও কৃপালাভের আশায় এসব পদস্থ ব্যক্তিরা যখন ক্ষমতাসীন দলের প্রতি রাজনৈতিক পক্ষপাত করেন এবং নানারকম নিয়মবিরুদ্ধ সুবিধা দেন তখন ’তারা আমাদের কেউ নয়’ দাবিকে গা–বাঁচানোর বেপরোয়া চেষ্টা ছাড়া কি ভিন্ন কিছু বলা চলে? আল–জাজিরা টেলিভিশন যখন জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে বেআইনি বিভিন্ন কাজ ও দুর্নীতির অভিযোগের বিস্তারিত নিয়ে ’অল দ্য প্রাইম মিনিস্টার্স মেন’ প্রতিবেদন প্রচার করল, তখন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ’আই এম প্রাইম মিনিস্টার্স ম্যান’ ব্যাজ ব্যবহার করেছিলেন, তার উদ্দেশ্য কী ছিল? এখন তো সেই অভিযোগগুলোই নতুন করে আরও বিশদে আলোচিত হচ্ছে, ভিন্ন কিছু নয়।
এই গা–বাঁচানোর বিষয়টি অনেকদিন ধরেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও সরকারের খুব প্রিয় একটা কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুবলীগের ঢাকা মহানগরীর কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতি এবং নানা অপরাধের কাহিনিগুলো যখন রাজনীতিতে তোলপাড় তুলেছিল, তখনকার কথা স্মরণ করে দেখুন। তখনো ওবায়দুল কাদেরের মুখেই আমরা শুনেছি, গুটিকয়েক লোকের দায়ভার আওয়ামী লীগ নেবে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর ভূমিকার কথা ঘোষণা করে তিনি সেদিন বলেছিলেন, যারা বিএনপি ও ফ্রিডম পার্টির লোকদের বৃহৎ এ দলে এনেছেন, অনুপ্রবেশে সহায়তা করেছেন তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা যে অভিযান শুরু করেছেন তা চলমান থাকবে (গুটিকয় নেতাকর্মীর দায় দল নেবে না, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯)।
ওবায়দুল কাদেরর ওই ঘোষণার পর দুর্নীতি বেড়েছে, নাকি কমেছে, তা সাধারণ মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণাতেও দুর্নীতির সম্প্রসারণ ছাড়া সংকোচনের কথা কেউ বলে না।
এর মাত্র মাসখানেকের মধ্যেই আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের হাতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ডের জেরে সারা দেশে যে বিক্ষোভ–প্রতিবাদের ঝড় ওঠে তখন আবার আমরা ওবায়দুল কাদেরের কন্ঠে শুনতে পাই, ’ছাত্রলীগের গুটিকয়েক অপরাধ করলে বা যুবলীগের গুটিকয়েক অপরাধ করলে সেটার জন্য গোটা সংগঠন দায়ী নয়। দলের পরিচয়ে কেউ অপকর্ম করলে ছাড় পাবে না”(গুটিকয়েকের অপরাধের দায় পুরো সংগঠনের নয়: কাদের, বিডিনিউজ ২৪, ৮ অক্টোবর, ২০১৯)।
দায় না নেওয়ার বিষয়টি মন্ত্রীসভাতেও যে সংক্রমিত হয়েছে, তার নজির হলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ইভ্যালিসহ প্রায় ডজনখানেক ই–কর্মাস প্রতিষ্ঠানের কেলেঙ্কারির কথা নিশ্চয়ই সবার স্মৃতিতে জাগরূক আছে। আগাম টাকা নিয়ে পণ্য না দেওয়া এবং টাকা লোপাট করার ওইসব ঘটনায় যখন তোলপাড় চলছিল, তখন তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বললেন, গ্রাহকদের ক্ষতির দায় সরকার নেবে কেন? তিনি উল্টো ভোক্তাদের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে প্রশ্ন তুললেন, গ্রাহকরা যখন ১ লাখ টাকার পণ্য অর্ধেক মূল্যে কেনার জন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে লগ্নি করেছেন, তখন তারা সরকারকে কি জানিয়েছেন? কম মূল্যে পণ্য কেনার স্বভাবজাত চেষ্টাকেই তিনি তাদের ক্ষতির কারণ হিসাবে চিহ্নিত করলেন ('ই-কমার্সে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের দায় নেবে না সরকার', যুগান্তর, ৮ অক্টোবর, ২০২১)।
জনগণের ভাগ্য উন্নয়ন এবং দেশের উন্নতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রত্যয় ও অঙ্গীকার করে রাজনৈতিক দল যখন সরকার গঠন করে, তখন এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দল এবং সরকারের দায় না নেওয়ার দাবি কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে? দায় নিতে না চাইলে তাঁদের তো দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার কথা।
(৬ জুন, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন