সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভারতের কাছে প্রতিদান না চাওয়ার বন্ধুত্ব

 মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কোনো দেশের সরকারপ্রধান যখন প্রতিবেশি রাষ্ট্রে দুবার সফর করেন, তখন মানতেই হবে যে ওই দুই দেশের সম্পর্কে নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু ব্যাপার আছে।  যৌথ সংবাদ সম্মলনে দুই প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও এর উল্লেখ আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুন মাসে দুবার দিল্লি সফরের বিষয়টি উল্লেখ করে তাকে বন্ধুত্বের আন্তরিকতা ও দৃঢ়তার প্রমাণ হিসাবে উল্লেখ করেছেন। 


দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এই বিশেষত্বের একটি ভালো বিবরণ দিয়েছে ভারতের ফ্রি প্রেস জার্নাল। সেখানে সাংবাদিক জয়ন্ত রায় চৌধুরী লিখেছেন, বেইজিং যাওয়ার আগে শেখ হাসিনার ভারত সফরের বিষয়টি ছিল দিল্লিকে এটা আশ্বস্ত করা যে তার ’সবার আগে প্রতিবেশী’ (নেইবারহুড ফার্স্ট)  নীতি কোথাও যদি কাজ করে থাকে তাহলে সেটি জ্বলজ্বল করছে ঢাকায় ক্ষমতার অলিন্দে। 


দক্ষিণ এশিয়ার অন্য প্রতিবেশিদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক সময়ের স্রোতে বরফের রুপ নিয়েছে; নেপাল শুধু চীনের দিকেই ঝুঁকেছে, তা নয়, মানচিত্রও নতুন করে প্রকাশ করেছে, যাতে কুমাওনের একটি অংশ (বিরোধীয়) তাদের হিসাবে দেখানো হয়েছে; এবং ভুটান চীনের সঙ্গে বৈরিতা এড়াতে এতই উদগ্রীব যে বেইজিংয়ের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনায় তারা ব্যস্ত (নেইবারহুড ডিপ্লোম্যাসি: ঢাকা ইন্ডিয়াস অনলি বেস্ট ফ্রেন্ড, ২৩ জুন, ২০২৪)। 


তিনি আরও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মুইজ্জু মোদির শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হলেও চীনপন্থী বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়ে চলেছেন, যার মধ্যে ভারতের কয়েক ডজন সৈন্যকে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার জন্য কয়েকদফায় কৌশলগত আলোচনাও তিনি বাতিল করেছেন। চীনের ঋণের ফাঁদে আটকা পড়া শ্রীলংকাও যে ঋণ পুন:তফসিলীকরণের প্রয়োজনে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াবে, তাতেও কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর কথায় পরিস্থিতি এমনই যে প্রতিবেশিদের মধ্যে ’ভালো বন্ধু’ বলতে একমাত্র ঢাকাই ভরসা। 


গত কয়েক দিনে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলোয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সম্পর্কে যেসব প্রতিবেদন ও নিবন্ধ ছাপা হয়েছে, তার অধিকাংশেরই মূল কথা হচ্ছে, ঢাকাকে পক্ষে টানতে বেইজিংয়ের সঙ্গে দ্বৈরথে এখনও পর্যন্ত দিল্লিই এগিয়ে আছে। যদিও তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সবেচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, তবুও সামগ্রিকভাবে সমঝোতার বিষয়গুলোর ব্যপকতা ও বৈচিত্র অনেক বেশি তাৎপর্য বহন করে। 


সন্দেহ নেই তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘায়িত হতে থাকা অচলাবস্থা সত্ত্বেও তার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার প্রশ্নে কোনো অর্থায়ন প্রস্তাব ছাড়াই ভারতকে সমীক্ষা চালাতে দেওয়ার বিষয়টি অপ্রত্যাশিত ছিল। কেননা চীন  তিস্তার পানি সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার প্রকল্পে শত কোটি ডলার অর্থায়নের প্রস্তাব দিয়েছে কয়েক বছর আগেই এবং সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য বলেছেন চীন ও ভারতের প্রস্তাব দুটির যেটি কল্যাণকর মনে হবে, সেটিই তিনি গ্রহণ করবেন।

 

ভারতে নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অপেক্ষাকৃত দুর্বল তৃতীয় মেয়াদের যাত্রা এখনও পুরোপুরি গতি পায়নি। কিন্তু তার আগেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তড়িঘড়ি সফর আয়োজন যে স্পষ্টতই তাঁর চীনের সফরসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত, সে কথাটি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যতটা স্পষ্ট করে বলেছে, আমরা ঠিক সেভাবে কাউকে বলতে শুনিনি। 


ডেকান হেরাল্ড উচ্ছ্বসিত শিরোনামে বলেছে, বাংলাদেশের নদী সংরক্ষণ প্রকল্প থেকে ভারত কনুই মেরে চীনকে হটিয়ে দিয়েছে। কলকাতার টেলিগ্রাফ ’বাংলাদেশে চীনের উচ্চাকাঙ্থা নস্যাৎ ভারতের: ঢাকার নজর পানি–বন্টনে’ শিরোনামে লিখেছিল, ভারত তিস্তার ব্যবস্থাপনা চীনের হাতে চলে যাওয়া ঠেকাতে মরিয়া। কারণ এটি কেবল তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত প্রতিবেশীর সাথে জল-কূটনীতির ব্যর্থতার ইঙ্গিত বহন করবে না, বড় কৌশলগত উদ্বেগেরও কারণ হবে। টাইমস অব ইন্ডিয়া লিখেছে, চীনের প্রতি নজর রেখে বাংলাদেশকে ভারতের নদী সংরক্ষণে সহায়তার প্রস্তাব। 


এখন মমতা বন্দোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে যে চিঠি দিয়েছেন, তাতে তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা এবং গঙ্গা চুক্তির নবায়ন – দুটোই যে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়বে, তার সম্ভাবনা প্রকট হয়ে উঠছে। নদীর পানি ব্যবস্থাপনা রাজ্যের এখতিয়ার – এই অজুহাত শুধুমাত্র মমতা বন্দোপাধ্যায়ের আপত্তিতে গত এক দশকেও দিল্লি তিস্তা চুক্তি অনুমোদন করতে পারেনি বা করেনি। করেনি কথাটা বলাই যায়, কেননা দিল্লি চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে ভারতের সুপ্রিম কোর্টেই হয়তো তার মীমাংসা হতো। 


আন্তরাজ্য পানিবন্টনের বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার কারণেই এমন যুক্তি উঠতে পারে। তিস্তা আটকে রাখার পর মমতা বন্দোপাধ্যায় এবার যেভাবে ফারাক্কা থেকে তৈরি হওয়া নানা সমস্যার কথা যেভাবে তাঁর চিঠিতে মোদিকে লিখেছেন, তাতেও মনে হচ্ছে গঙ্গার প্রতিশ্রুত পানি না পাওয়ার হতাশা ভবিষ্যতে শুধুই বাড়বে, কমবে না। 


বন্ধু হিসাবে বাংলাদেশ ভারতের কাছে বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছে বলেই সেখানকার সংবাদমাধ্যমের একটা মতৈক্য চোখে পড়ে। তারা প্রায় প্রত্যেকেই মালদ্বীপের মতো বাংলাদেশেও ভারতের পন্য বয়কট আন্দোলনের গতিপথ নিয়ে তাদের যে উদ্বেগ আছে সেকথা জানাতে ভোলেনি। কিন্তু সেই বয়কট আন্দোলন উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সফরের ফলাফলে তাদের তৃপ্তির বহি:প্রকাশই বেশি। তাদের হিসাবে অর্জনের তালিকায় আছে, কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রমেন্টের (সেপা) জন্য আলোচনা শুরুর সমঝোতা, রেল সংযুক্তি সম্প্রসারণ, যৌথভাবে সমরাস্ত্র উৎপাদন এবং সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন, ডিজিটাল এবং গ্রিন পার্টনারশিপ ও মহাকাশের অংশীদারত্বের উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টিকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ওই খাতে চীনের দীর্ঘদিনের প্রাধান্যকে খর্ব করার সুযোগ তৈরির উদ্যোগ হিসাবে। 


২০১৮ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী ভারতে এ রকম একটি সফর শেষ করে আসার পর বলেছিলেন, ভারতকে যা দিয়েছি তারা তা সারা জীবন মনে রাখবে ( ৩০ মে, ২০১৮ তে গণভবনের সংবাদ সম্মেলন)। এবারের সমঝোতা স্মারকগুলোতে দেখা যাচ্ছে, দেওয়ার পালা শেষ হয়নি। আনন্দবাজারে ’বাংলাদেশ ভারতের কাছে প্রতিদান চায়’ শিরোনামের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তখন তিনি বলেছিলেন, ’আমি কোনো প্রতিদান চাই না। প্রতিদানের কী আছে?’ এখনও তিনি প্রতিদান না চাওয়ার নীতিতে অটল আছেন বলেই মনে হচ্ছে। 


রেল সংযোগ সম্প্রসারণের বিষয়ে ইউরোপের দৃষ্টান্তটা ভালো। কিন্তু ইউরোপের মহাদেশজুড়ে রেলসংযোগ আমাদের কথিত কানেকটিভিটির সঙ্গে মোটেও তুলনীয় নয়। আমাদের সংযোগ সম্প্রসারণের সুবিধা মূলত ভারতের সীমানাতেই সীমিত এবং তাতে এক পক্ষ অসম সুবিধা লাভ করবে। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সংযোগ সম্প্রসারণ হলেই কেবল তাকে ইউরোপের সঙ্গে তুলনা করা চলে। অথচ, দক্ষিণ এশিয়ার সহযোগিতা জোট সার্কের প্রায় অপমৃত্যু হয়েছে এবং তার কারণ হচ্ছে ভারত ও পাকিস্তানের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। এখন যোগ হচ্ছে চীনের সঙ্গে ভারতের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রভাব। 


ভূরাজনীতির প্রভাব শুধু যে পররাষ্ট্রনীতি বা প্রতিরক্ষানীতির মধ্যেই সীমিত থাকছে, তা নয়। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ওপর তার প্রভাব যে কতটা ক্ষতিকর ও প্রকট হতে পারে, সে কথা নিশ্চয়ই নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই।   


(২৭ জুন, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...