উপমহাদেশের জনপ্রিয় গণসঙ্গীত শিল্পী প্রয়াত সলিল চৌধুরী তাঁর গানে গেয়েছিলেন, ’বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা আজ জেগেছে সেই জনতা’। তিনি তাঁর ৭০ বছরের জীবদ্দশায় তা দেখে যেতে পেরেছেন কিনা বলতে পারি না। তবে বাঙ্গালি এই শিল্পীর লেখা, সুর দেওয়া ও গাওয়া গানের বাস্তবরুপ আমরা যে দেখতে পেলাম, তা কোনো দিন আমাদের কল্পনাতেও আসেনি। তা–ও এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে ঘটলো, যার দায় রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ ও তার প্রধান শেখ হাসিনার এবং বিচার বিভাগের দিক থেকে সেই সব বিচারপতির, যাঁরা নিজেদের ন্যয়বিচারের প্রতিভূ ভাবার বদলে ’শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’ ভাবতে গর্ববোধ করতেন।
আদালতের দলীয়করণ নিয়ে গত দেড় দশকে বহুবার আমরা আমাদের উদ্বেগের কথা বলেছি। তবে অনেকটাই ভয়ে ভয়ে। কেননা শপথবদ্ধ রাজনীতিক পরিচয় ধারণ করা যে ভূল , এই কথাটি বলার জন্য আমরা জ্যেষ্ঠ্ আইনজীবিদের বিরুদ্ধেও আদালত অবমাননার বিচার করতে দেখেছি। এর আগেও আদালতের বিচ্যূতি বা ভূল–ভ্রান্তি নিয়ে লেখালেখি সাংবাদিকতার জন্য বাড়তি ঝুঁকির কারণ হয়েছে, তা–ও লিখেছি। ২০১৯ সালের ১৯ মে প্রথম আলোয় লিখেছিলাম ”সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়ে আদালত অবমাননার আইন বাতিল হয়ে যাওয়ার পর থেকে সংবাদমাধ্যম এমনিতেই বাড়তি ঝুঁকির মধ্যে আছে।”
গত বছর ২৫ অক্টোবর লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের (সোয়াস) বাংলাদেশের সংবাধিনের ইতিহাস বিষয়ক একটি বইয়ের আলোচনার সব কথা পত্রিকায় ছাপার জন্য লিখতে পারিনি। ওই আলোচনায় আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহমেদও একজন আলোচক ছিলেন। প্রকাশনা সংস্থা রাউটলেজের প্রকাশনা ’আ হিস্ট্রি অব দ্য কনস্টিটিউশন অব বাংলাদেশ’ বইয়ে তাঁর একটি নিবন্ধ আছে যার শিরোনাম, ’রুল অব ল উইদিন দ্য কনস্টিটিউশনাল স্কিম: আ জুডিশিয়াল পারসপেক্টিভ’। তাঁর নিবন্ধে কী আছে, সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচনার অবকাশ নেই। তবে আমার রিপোর্টিং নোট বলছে, তিনি বলেছিলেন, বিচার বিভাগীয় নিয়োগের একটা পদ্ধতি থাকার কথা, যা স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও একটা আকাঙ্খাই থেকে গেল।
বিচার বিভাগীয় নিয়োগের প্রশ্নে কোনো গ্রহণযোগ্য ও যৌক্তিক প্রক্রিয়া নির্ধারণ বা কোনো আইন না করার কারণ মোটেও দুর্বোধ্য নয়। রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারীরা আদালতের ওপর তাঁদের প্রভাব খাটানো ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই উচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের ক্ষমতাটি নিজেদের হাতে রেখে দিয়েছেন। বিদায় গ্রহণে বাধ্য হওয়া প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এনায়েতুর রহিম আইনশাস্ত্র পড়ায় আমার সহপাঠী এবং আমরা একই বছরে বার সমিতিতে তালিকাভুক্ত হই। ছাত্রলীগে তাঁদের সক্রিয়তা ও নেতৃত্বের গুণের কারণে আমার ধারণা ছিল, তাঁরা রাজনীতি করবেন বলেই আইন পেশা বেছে নিয়েছেন। আইনজীবি সমিতিতে তাঁরা রাজনৈতিকভাবেও যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন এবং বিএনপির শাসনকালে আদালত অঙ্গনে সরকারবিরোধী মিছিলও করেছেন। অবশ্য বিচারপতির আসনে বসার পর ভিন্নমতের আইনজীবীদের আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল করার অপরাধে বিচারের মুখোমুখি করতে কোনো সংকোচ বোধ করেননি।
তাঁরা ছাড়াও উচ্চ আদালতের বিচারকদের অধিকাংশের নিযুক্তি যে রাজনৈতিক বিবেচনায় হয়েছে, তা নিয়ে সংশয়ের কিছু নেই। বিচারপতি নিয়োগে রাজনৈতিক বিবেচনা এর আগে বিএনপির শাসনামলেও ছিল, তবে তা এতটা ব্যপক ও নগ্ন ছিল না। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর নিজের বাসায় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছ থেকে ফুলের তোড়াসহ অভিনন্দন গ্রহণের মতো খারাপ নজির ওবায়দুল হাসান ছাড়া আর কেউ তৈরি করেছেন বলে মনে পড়ে না। অথচ, তাঁদের যখন তিনি তাঁর বাসায় ঢুকতে দিয়েছেন, তখন ছাত্রলীগ সভাপতির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা তদন্তাধীন ছিল। আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অবিচল থাকার দৃষ্টান্ত আপিল বিভাগের আরেকজন বিচারপতির অবসর পরবর্তী কার্যকলাপেও আমরা প্রত্যক্ষ করেছি।
শুধু নিয়োগ এবং আইনজীবীদের প্রতি নির্দেশনাতেই তা সীমাবদ্ধ ছিল না। সোয়াসের আলোচনায় আইনজীবি আব্দুল হালিম প্রশ্ন তুলেছিলেন সুপ্রিম কোর্ট নীতি ঠিক করে দিতে পারে কি না। সংবিধান ও মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী বিভিন্ন আদেশ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট এক ধরনের ’বিচারিক নৈরাজ্য’ তৈরি করছে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন। উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, আল–জাজিরা টেলিভিশনে প্রচারিত তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজের নানা বেআইনি কাজের বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ’অল দ্য প্রাইমমিনিস্টার্স মেন’–এর উপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে যে রিট হয়েছিল, তা খারিজ করে আদালত স্বত:প্রণোদিত হয়ে দুটি নির্দেশ জারি করেছিলেন। হাইকোর্টের দুজন বিচারপতি ’এই মাটির সন্তান’ হিসাবে একটি নির্দেশ জারি করেছিলেন, যাতে আল–জাজিরার তথ্যচিত্র প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এবং ইন্টারনেট থেকে তা অপসারণের কথা বলা হয়েছিল। বিচারিক সক্রিয়তার নামে এক্ষেত্রে যা হয়েছে, তা সংবিধান পরিপন্থী এবং নৈরাজ্যজনক বলেও মন্তব্য করেন আব্দুল হালিম।
ওই সময়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আলোচিত একটি মামলা ছিল। খাদিজাতুল কুবরা মোট ১৫ মাস বন্দী ছিলেন, যার মধ্যে ১০ মাস শুধুমাত্র আপিল বিভাগের কারণে। হাইকোর্ট বিভাগ ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁকে জামিন দেওয়ার পর রাষ্ট্রপক্ষ তার বিরুদ্ধে আপিল করলে আপিল বিভাগ জুলাই মাসে প্রথম শুনানির সুযোগ আসলেও তখন তা পিছিয়ে নভেম্বরে ঠেলে দেয়। অথচ নারী হিসাবে তার জামিনের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা ছিল। সেই মামলায় শেষ পর্যন্ত এ বছরে নিম্ন আদালত খাদিজা পুরোপুরি অব্যাহতি পান।
ভিন্নমত পোষণ বা বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রে এরকম অসংখ্য মামলার নজির আছে, যেগুলোতে জামিন পাওয়ার অধিকার উচ্চ আদালত উপেক্ষা করেছে। সম্পাদকেরাও এ থেকে বাদ যাননি। হাইকোর্ট বিভাগে জামিন হওয়ার পর সরকার তা ঠেকানোর চেষ্টা করলেই আপিল বিভাগ তা ঠেকিয়ে দিয়েছে। বিএনপির প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি যে সুবিচার করা হয়নি, তা বিদেশিরাও বলে এসেছেন। ওই বিচারের পেছনেও যে রাজনীতি কাজ করেছে, তার প্রমাণ হচ্ছে হাইকোর্ট আপিলে তার সাজা দ্বিগুণ করে দিয়েছে। এই আপিল বিভাগই ৫০ হাজার কোটি টাকা পকেটস্থ করা বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের দূর্নীতির তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে।
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ – আইনসভা বা সংসদ, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতা পৃথক্করণের ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে আমাদের সংসদের মতোই আদালতও প্রধানমন্ত্রীর আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি রাষ্ট্রেই নির্বাহী বিভাগ অমিত ক্ষমতার অধিকারী। তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ সব সময় আইন মেনে কিম্বা ন্যয়সঙ্গত হয় না। ন্যয়বিচারের ধারণা এসেছে, এই ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে ক্ষুদ্র সত্ত্বা প্রতিটি নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের আদালতে তা ঘটে না। সুপ্রিম কোর্টসূত্রেই আমরা জানি যে দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি মামলায় রাষ্ট্র হচ্ছে একটি পক্ষ এবং জাতিসংঘে সরকারের দেওয়া প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার হার মাত্র ৩ শতাংশ। অথচ উচ্চ আদালতে জামিন মেলে না।
গত কয়েক বছরের মধ্যে অন্তত: তিনজন প্রধান বিচারপতির বক্তব্যে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার কথা আমরা বলতে শুনেছি। অবশ্য ওই তিনজনের প্রথমজন এস কে সিনহা বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে তুলে দেওয়ার আইন ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করার কারণে রাষ্ট্রীয় নিগ্রহের শিকার হয়ে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন। প্রধান বিচারপতি হিসাবে এস কে সিনহা যে খুব অনুকরণীয় ভূমিকা পালন করেছেন, তা নয়। তাঁর নিয়োগও রাজনৈতিক আনুগত্যনির্ভর ছিল। কিন্তু আদালতের স্বাধীনতার জন্য ন্যূনতম কাজটি করতে যাওয়ায় তাঁকে আওয়ামী লীগ দুর্নীতির অভিযোগ দিয়ে অপমান করে বিদায় দিয়েছে। পরিহাসের বিষয় হলো, ছাত্র–জনতার রোষানলে পড়ে সদ্যবিদায় নেওয়া প্রধান বিচারপতি ও তাঁর অর্ধডজন সহকর্মীকে বিদায় নিতে হলো রাষ্ট্রীয় নিপীড়ণে প্রতিকারের বদলে সমর্থন ও সহায়তার অভিযোগে।
সোয়াসের সেমিনারে হাল ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক ড জসিমউদ্দিন যথার্থই বলেছিলেন যে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসে সংবিধানে যে ত্রয়োদশ সংশোধনী করা হয়েছে, তা থেকেই ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রের ইতি ঘটানো হয়েছে। তাই আবারও সংবিধান সংশোধন আবশ্যক।
বিচারপতি সৈয়দ রিফাত আহমেদ স্বাধীন বিচারবিভাগের জন্য গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আইনের শাসন ও মানবাধিকারের প্রতি অঙ্গীকারের প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন। তিনি তখন বিচারপতিদের নৈতিক আচরণের জন্য স্বাধীন বিচারবিভাগীয় তদারকি সংস্থার (জুডিশিয়াল ওভারসাইট বডি) প্রয়োজনীয়তার কথাও বলেছিলেন। প্রধান বিচারপতির দায়ত্ব গ্রহণের পর তিনি বিচারকদের ’কোনো ধরনের বিচ্যুতিকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁর এ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সংস্কার কবে, কীভাবে সম্পন্ন হবে?
(১৫ আগস্ট, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন