’এশিয়ার লৌহমানবী’ হিসাবে পরিচিতি পাওয়া ও বিশ্বের দীর্ঘতম সময় ক্ষমতায় থাকা একমাত্র নারী শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যূতি ও দেশত্যাগের ঘটনা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ১৯৮৬ সালে পত্রিকা অফিসের বার্তাকক্ষে। ফিলিপিনো সামরিক স্বৈরশাসক ফার্দিনান্দ মার্কোসের পতন ঘটেছিল ছাত্র–গণঅভ্যূত্থানে এবং তাঁকেও দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। নব্বুইয়ের গণঅভ্যূত্থানে উৎখাত হওয়া সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়নি।
গণ–অভ্যূত্থানে নিহত মানুষের সংখ্যা এক শ ছাড়ানোর পর বার্তা সংস্থা ইউএনবির সম্পাদক সায়ান এস খান ফেসবুকে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা উদ্ধৃত করার লোভ সম্বরণ করা কঠিন। তিনি লিখেছেন, ”ওপরে দেখা হলে এরশাদ কী বলবে জানো? ছি: আমাকে দেখ – দুজন মরছে, ছাইড়া দিছি, আর তুমি–––” । এরপর জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ প্রথমে জানাল, এ সহিংসতায় অন্তত ৩২ শিশুর প্রাণহানি ঘটেছে। পরে সেই সংখ্যা ৬৬ ছাড়িয়েছে। পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টায় এত বিপুলসংখ্যক শিশু হত্যা এবং চার শতাধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়ার দায় যখন কোনো রাজনীতিকের পরিচিতিতে স্থায়ী জায়গা করে নেয়, তখন তাকে কী অভিধায় অভিহিত করা যাবে?
প্রথম আলোর একটি খবর যুক্তরাজ্যের ফাইনান্সিয়াল টাইমস থেকে শুরু করে বিশ্বের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম উদ্ধৃত করে জানিয়েছে যে পদত্যাগের এক ঘন্টারও কম সময় আগে তিনি বিক্ষোভ দমনে গুলি ব্যবহারের জন্য সেনাবাহিনীর উপর চাপ প্রয়োগ করেছিলেন। তিনি যে পদত্যাগে রাজি হচ্ছিলেন না এবং প্রথম আলোর বর্ণনামতে পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের কথায় ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য শেষপর্যন্ত সম্মত হন, তা পরে একাধিক সাক্ষাৎকারে জয় নিজেও বলেছেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধান ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) ডেকে তিনি নিরাপত্তা বাহিনী কেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, সেটার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
এসব কর্মকর্তাকে তিনিই শীর্ষ পদে বসিয়েছেন বলে উল্লেখ করে তাদেন ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরির চেষ্টাও তিনি করেছেন। বৈঠকে তিনি পুলিশ ভালো করছে বলে মন্তব্য করে সেনাবাহিনী কেন একইরকম ভূমিকা রাখছে না বলে যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, তা এই ভয়াবহ নৃশংসতায় তাঁর ব্যক্তিগত দায় প্রমাণ করে। অথচ শেষ মুহূর্তেও শক্তি প্রয়োগ থেকে নিবৃত্ত করা হলে সেদিন ঢাকা মার্চে বাধার কারণে যে শতাধিক মানুষের প্রাণ গেল, তা এড়ানো যেত।
বলপ্রয়োগে ক্ষমতায় থাকার নীতি যদি কোনো রাজনীতিক গ্রহণ করেন, তাহলে তাঁকে তো আর বৈধ ক্ষমতার অধিকারী বলা চলে না। অবশ্য ক্ষমতায় থাকলে এক রকম আর ক্ষমতায় না থাকলে অন্য রকম বলার বিষয়টি তাঁর ক্ষেত্রে মোটেও নতুন নয়। শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের বক্তৃতাগুলোর সংকলনও ছাপা হয়েছে বলে শুনেছি। ওই সংকলনে আছে কি না জানিনা, তবে সংসদের কার্যবিবরণী খুঁজলে নিশ্চয়ই তাঁর ওইসব উক্তির রেকর্ড মিলবে, যা কোনো রাজনীতিকের মুখের ভাষা বলে বিশ্বাস করা কঠিন।
১৯৮৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি এক জনসমাবেশে বলেছিলেন, "পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীকে বলতে চাই-আপনারা জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না। জনগণের বিরুদ্ধে বন্দুক তুলে ধরবেন না। বাংলার জনগণ তাহলে আপনাদের রেহাই দেবে না। সঙ্গে সঙ্গে বলতে চাই, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের পরিবার পরিজনকে পাকিস্তানে রেখে এসেছিল। কিন্তু আজকের পুলিশ, বিডিআর, সেনাবাহিনীর আত্মীয়স্বজনরা বাংলার গ্রামেগঞ্জে বাস করে। এদের আত্মীয়স্বজনের ঠিকানা খুঁজে বের করুন, সতর্ক করে দিন। হুঁশিয়ার করে দিন, আর যদি এদেশের মানুষের বুকের উপর গুলি চালানো হয়, আর যদি এদেশের মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয় আপনাদের প্রতি আমার আহ্বান, প্রতিশোধ নেবেন।"
’পরিহাস’ শব্দটি বাংলা ভাষায় চালু হওয়ার কারণ পুরোপুরি উপলব্ধি করা যায় যেসব উপলক্ষ বা ক্ষণে, সে রকম একটি সময় আমরা এখন অতিক্রম করছি। শেখ হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীকে হেয় করার মানসে ’এতিমের টাকা চোর’ বলে উপুর্যপুরি খাটো করার চেষ্টা চালিয়েছেন। আদালতের রায়ে দোষী হওয়ার কথা বলা হলেও সেই বিচারপ্রক্রিয়ায় যে ন্যয়বিচারের মান অনুসৃত হয়নি সেকথা বিদেশি পর্যবেক্ষকরাও বলেছেন। এখন তিনি নিজেই শিশুহত্যা, এমনকি গণহত্যার (সংখ্যাগত ব্যাপকতা অর্থে) অভিযোগে অভিযুক্ত।
পরিহাস কী, তা বোঝাতেই সম্ভবত: বাণিজ্যবিষয়ক দৈনিক বণিক বার্তায় শিরোনাম হয়েছে, ’জেল খেটে খালেদা জিয়াই জিতলেন, পালিয়ে দলকে বিপদে ফেললেন হাসিনা’। বিএনপি তাদের অসুস্থ নেত্রীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার সুযোগ দাবি করলে তিনি কোনো দ্বিধা ছাড়াই বলেছিলেন. ’খালেদা জিয়ার বয়স তো আশির ওপরে, মৃত্যুর সময় হয়ে গেছে।’
বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে বিভিন্নভাবে হয়রানি ও হেনস্থার কথাও এখানে স্মরণ করা দরকার। তাঁকে তিনি পদ্মা নদীতে চোবাতে চেয়েছিলেন। কারণ তাঁর অভিযোগ, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন না করতে ড. ইউনুস বিশ্বব্যাংককে প্রভাবিত করেছেন। এগুলো তিনি করেছেন এতটাই দাপটের সঙ্গে যে কোথাও কোনো প্রতিকার পাওয়ার অবকাশ ছিল না। সবচেয়ে বড় অবিচার হয়েছে আদালতে, যেখানে শীর্ষস্থানীয় আইনজীবিরাও সরকারি রোষানলের শিকার হওয়ার ভয়ে এসব ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকার পেতে সহায়তা দিতে রাজি হননি।
ক্ষমতা ধরে রাখতে তিনি স্বৈরশাসকদের কৌশলগুলোর সবই প্রয়োগ করেছেন প্রায় নিখুঁতভাবে। সংগঠিতভাবে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, যারা সেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মোকাবিলায় বারবার একই কৌশল অনুসরণ করেছেন এবং যা মোকাবিলায় বিরোধী দল বিএনপি এবং অন্যান্যরা অসহায় হয়ে পড়েছিল। কৌশলগুলোর মধ্যে ছিল, যতভাবে সম্ভব ভিন্নমত প্রকাশ ও প্রচার নিয়ন্ত্রণ, সংগঠিত হওয়া ও সভা–সমাবেশ করতে না দেওয়া, দমন–পীড়ন ও ভীতিপ্রদর্শনের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিষ্ক্রিয় করা বা তাদের অপসারণে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নেওয়া।
নির্বতনমূলক নানা আইন তৈরি, সরকারি আদেশ জারি, গোয়েন্দা সংস্থার হুমকি এবং এমনকি আদালতের রাজনৈতিক ব্যবহারের মাধ্যমে মতপ্রকাশ ও ভিন্নমত প্রকাশ ও প্রচার নিয়ন্ত্রণে শেখ হাসিনার সরকার অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এসব কৌশলের সফলতায় স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে যে দর্প বা অহংবোধ তৈরি হয়েছিল, তাতে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া ছাত্র–তরুণরা সরকারের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারবে, এমনটি তাঁরা কল্পনাও করেন নি। বিস্ময়ের বিষয় হলো বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জোট বিরোধীদের আন্দোলনগুলোর ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা যে পাল্টা কৌশল উদ্ভাবন করেছে, তা মোকাবিলায় বহুলব্যবহৃত কৌশলগুলোর কোনোকিছুই কাজ করেনি।
আন্দোলনকারী ছাত্রদের রাজাকার অভিহিত করা কিম্বা বিএনপি–জামাতের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে আন্দোলনে বিভাজন তৈরি বা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার রাজনৈতিক বয়ান একদমই কাজে আসে নি। ইন্টারনেট বন্ধ করা, মোবাইল যোগাযোগে ফোর–জিকে টু–জিতে নামিয়ে আনার পরও অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আন্দোলনকারী তাদের মধ্যে যোগাযোগ সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। তাদের আন্দোলন শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের উপর নির্ভরশীল না হওয়ায় সরকার তা বন্ধ করে দিলেও আন্দোলনের গতি কমেনি।
তাদের সাংগঠনিক দক্ষতা যে রাজনৈতিক দলগুলোকে লজ্জা দিয়েছে, সেকথা আমি আগেও লিখেছি। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নতুন ঢেউ তৈরি হয়েছে। আবার তাদের ওপর আক্রমণ হওয়ায় স্কুল–কলেজের ছাত্র–ছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরাও বিক্ষোভে যোগ দিয়েছে। স্রোতের পর স্রোত যে গুলি করে ঠেকানো সম্ভব ছিল না, সেটাই শোণা গেছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একজন পুলিশ সদস্যের রিপোর্টে শোনা যায়, ”গুলি করি। মরে একটা। একটাই যায়, স্যার। বাকিডি যায় না। এটাই স্যার সবচে বড় আতঙ্কের।”
ছাত্রদের আন্দোলন যেভাবে গণ–অভ্যূত্থানে পরিণত হলো, তার প্রকৃতি পুরোটা বুঝতে তাই আমাদের আরও মনোযোগী হওয়া দরকার।
(২২ আগস্ট, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন