ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের পর যে অর্ন্তবর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, সম্ভবত তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সাহসী একটি পদক্ষেপ হচ্ছে, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ‘গুমের’ ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন। গত দেড় দশকে শত শত পরিবার যে অবর্ণনীয় মানসিক যন্ত্রণা ও দুর্ভোগের শিকার হয়েছে, তার একটা জবাব রাষ্ট্রের কাছ থেকে মিলবে বলে এখন অনেকের মধ্যেই আশাবাদ থেরি হয়েছে। দেশে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য এটি খুবই জরুরি একটি পদক্ষেপ হলেও কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের ওই কমিটি গঠনের যে প্রজ্ঞাপন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গত মঙ্গলবার জারি করেছে, তাতে বলা হয়েছে এটি গঠিত হয়েছে তদন্ত কমিশন আইন, ১৯৫৬ অনুসারে। এই আইনে কমিশন গঠিত হওয়ার ভালো দিক হচ্ছে, তাদের ক্ষমতা আদালতের সমতুল্য। এ কমিশন কোন ব্যক্তিকে তাদের সামনে উপস্থিতি হতে তলব ও বাধ্য করতে পারবে এবং তাদের জবানবন্দি বা জিজ্ঞাসাবাদ হবে শপথের অধীনে। কমিশন যে কোনো নথি চাইতে ও দেখতে পারবে; সাক্ষ্যপ্রমাণের সঙ্গে হলফনামা চাইবে এবং প্রয়োজন হলে সাক্ষী বা নথি পরীক্ষার জন্য যে কোনো জায়গায় যেতে পারবে। ফলে কমিশনের জন্য প্রতিটি অভিযোগের তদন্তে যতটা প্রয়োজন ততটা গভীরে তারা যেতে পারবে।
তবে প্রজ্ঞাপনের ভাষায় কিছুটা সংশয় তৈরি হয়েছে। কেননা, প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘আইন-শৃঙ্খলা প্রয়োগকারী সংস্থা তথা বাংলাদেশ পুলিশ, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ব্যাটালিয়ন, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা বাহিনী, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), কোস্টগার্ডসহ দেশের আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী কোনো সংস্থার কোনো সদস্য কর্তৃক জোরপূর্বক গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানের’ জন্য এ কমিশন। করণিক অদক্ষতার কারণে এটি ঘটেছে এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। আমরা অবশ্য এমন কথাও ভাবতে চাই না যে কমিশনের কার্যক্রমে বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য কোনো করিৎকর্মা আমলা ইচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্ম দিয়েছেন।
তদন্তের দাবি যাঁরা করছিলেন তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল কমিশন সত্য উদঘাটন করবে, দোষীদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির ব্যবস্থা করবে এবং কমিশনের কাজের সুবাদে এখনও যাঁরা নিখোঁজ হয়ে কোনো সংস্থার হাতে আটক আছেন, তাঁদের ফিরে পাওয়া সম্ভব হবে। কিন্তু প্রজ্ঞাপনে শুধু সন্ধানের কথা বলা হয়েছে, যে কাজটি মূলত পুলিশের। গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা এবং তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনার কথা প্রজ্ঞাপনে অনুপস্থিত। প্রজ্ঞাপনের এ ত্রুটি অবিলম্বে সংশোধন প্রয়োজন।
এই তদন্ত উদ্যোগের দ্বিতীয় যে বিষয়টি ত্রুটিপূর্ণ, তা হচ্ছে এর কাজের সময়সীমা মাত্র ৪৫ দিন নির্ধারণ করা। ২০২১ সালে আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ’হয়্যার নো সান কেন এন্টার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছিল, তারা ৬০০ লোকের গুম হওয়ার তথ্য পেয়েছে। তারপর অধিকার ৬৯৯ জনের একটি তালিকা করেছিল। এরপর যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড নাটকীয়ভাবে কমে আসে।
কিন্তু এরপর শুরু হয় স্বল্পমেয়াদি গুম। অভিযোগ ওঠে, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ও সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিট সন্দেহভাজন হিসাবে অনেককেই বাড়ি বা রাস্তা থেকে উঠিয়ে নিয়ে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ অজ্ঞাতবাসে রাখার পর ভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেপ্তার দেখানোর বেআইনি চর্চা করেছে। অন্য একটি সংস্থার বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ অব্যাহত থাকে। এ রকম স্বল্পমেয়াদী গুমের শিকার মানবাধিকারকর্মীদের হিসাবে অন্তত শ দুয়েক।
সোজা কথায় প্রায় ৯০০ জনের গুম হওয়ার অভিযোগ আছে। এখানে অপরাধ একটি নয়, ৯০০ আলাদা আলাদা অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, যার প্রতিটির স্বতন্ত্র্ বৈশিষ্ট্য আছে। তদন্ কমিশনে প্রত্যেক ভুক্তভোগী বা তাঁদের পরিবারের সদস্যদের কথা বলার অধিকার রয়েছে এবং তাদের সে সুযোগ দিতে হবে। প্রতিটি অভিযোগের জন্য যদি গড়ে তিন ঘন্টা করে সময় বরাদ্দ করা হয়, তাহলে শুধু ভুক্তভোগীর জবানবন্দি এবং সম্ভাব্য দায়ী ব্যাক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্তত ২৭০০ কর্মঘন্টা বা প্রায় ৩৩৮ দিন ( আট কর্মঘন্টায় দিন হিসাবে) প্রয়োজন। এর সঙ্গে যোগ হবে নথিপত্র উদ্ধার করে সেগুলো যাচাই–বাছাই ও প্রতিবেদন তৈরি। এই কর্মযজ্ঞ ৪৫ দিনে কীভাবে সম্ভব? বাস্তবে এ ধরনের তদন্তে ন্যূনতম দেড় থেকে দুই বছর সময় প্রয়োজন।
এ ধরণের তদন্তে ফৌজদারি আইনে বিশেষজ্ঞ আইনজীবি এবং অপরাধ তদন্তের বিশেষজ্ঞ জ্ঞান প্রয়োজন হয়। কমিশনের সহায়তায় তাই এরকম বিশেষজ্ঞ দল গঠনেরও প্রয়োজন হবে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাই যথার্থই জাতিসয়ঘের মাধ্যমে আর্ন্তজাতিক বিশেষজ্ঞ সহায়তা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। সরকারও জাতিসংঘের সহায়তাকে স্বাগত জানানোর কথা বলেছিল। আর্ন্তজাতিক বিশেষজ্ঞ সহায়তা সংগঠিত করাও কিছুটা সময়সাপেক্ষ বিষয় বলে তদন্তে বাড়তি সময়ের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যাবে না।
এই বাস্তবতায় ত্রুটিপূর্ণ প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে কমিশনের কাজের পরিধি পুর্ননির্ধারণ ও সময় বাড়ানোর কাজটি দ্রুতই করা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। এ ছাড়া সরকারের সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের জন্য নির্দেশ জারি করা জরুরি যে গুমসংক্রান্ত কোনো নথি ও সাক্ষ্যপ্রমাণ নষ্ট বা অপসারণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হবে। গুমের মতো ঘৃণ্য অপরাধের বিচারের উদ্যোগ যেন কোনোভাবেই ব্যর্থ না হয় অথবা অতীতের বিভিন্ন কমিশনের মতো ধূম্রজাল সৃষ্টির প্রহসনে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করতে এসব পদক্ষেপ আবশ্যক। আমাদের অতীত থেকেই এই ধারণার উৎপত্তি যে অপরাধ ধামাচাপা দেওয়ার সহজ উপায় হচ্ছে, দ্রুততার সঙ্গে তদন্ত কমিটি গঠনের ঘোষণা এবং তারপর তা মানুষের স্মৃতি থেকে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য সময়ক্ষেপণ।
(৩০ আগস্ট, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত বিশ্লেষণ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন