সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সেই সংক্রামক হাসি মিলিয়ে গেল

 বাংলাদেশে নারীরা এখন সাংবাদিকতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের সরব উপস্থিতি খবরের কাগজের পাতায়, টেলিভিশনের পর্দা ও বেতার তরঙ্গে এখন নিয়মিত ধ্বনিত হয়। কিন্তু আজ থেকে চার–পাঁচ দশক আগে রাতেরবেলায় বার্তাকক্ষে কোনো নারী খবর লিখছেন বা কোন পাতায় কোন প্রতিবেদন কী শিরোনামে ছাপা হবে সেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এমন দৃশ্য ছিল ব্যতিক্রম। এই ব্যতিক্রম যাঁরা তৈরি করার সাহস দেখিয়েছিলেন তাঁদের অন্যতম উর্মি রহমান। 


উর্মি আপা সংবাদে সাংবাদিকতা করেছেন আশির দশকে। তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রাতেও টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়া  অনুষ্ঠান পর্যালোচনা – যাকে সাধারণত সমালোচনা বলে গণ্য করা হতো – করতেন। পরে কিছুদিন প্রেস ইনিস্টিটিউট অব বাংলাদেশ ( পিআইবি) হয়ে লন্ডনে চলে আসেন বিবিসি বাংলার প্রযোজক হিসাবে। ঢাকায় এবং লন্ডনে সাংবাদিকতায় আমি তাঁর অনুগামী হলেও কখনো একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ হয়নি। তবে লন্ডনে আসার পর তাঁর সংক্রামক হাসির সঙ্গে পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে খুব একটা সময় লাগে নি। 


উর্মি রহমান যখন বিবিসির বাংলা বিভাগে কাজ করেছেন, তখন ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের একটা রীতি চালু ছিল, যা পরিচিতি পেয়েছিল ’ফ্রেশ ব্লাড পলিসি’ নামে। অর্থাৎ, বিবিসির পরিচালকেরা মনে করতেন বিদেশ থেকে যারা লন্ডনে কাজ করতে আসছেন, খুব অল্প সময়েই তাদের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ হালকা হতে থাকে। বৌগোলিক দূরত্ব জনভাবনা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একটা দূরত্ব তৈরি হয়। তাই তারা নিয়মিত বিরতিতে ওইসব দেশ থেকে নতুন নতুন কর্মী নিয়োগ করতেন। সবার সঙ্গে প্রথমে তিন বছরের একটা চুক্তি হতো এবং পরে তা আরও দুই বছরের জন্য নবায়ন করা হতো। ২০০০ সালের পর এ নিয়মে পরিবর্তন ঘটে এবং তখন চাকরি নিয়মিতকরণ বা স্থায়ীভিত্তিতে নিয়োগের প্রথা শুরু হয়। সে কারণেই আমি ১৯৯৭ সালে বিবিসিতে এসে উর্মি আপাকে আর সহকর্মী হিসাবে পাইনি। 


বিবিসিতে প্রযোজকদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও সাময়িক বিরতির পর তাঁদের খন্ডকালীন হিসাবে কাজ করার সুযোগ ছিল। আমি খন্ডকালীন সহকর্মী হিসাবে যাঁদের পেয়েছিলাম, তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন – প্রয়াত গোলাম মুরশিদ এবং গোলাম কাদেরের কথা মনে পড়ছে। উর্মি রহমানের মৃত্যুর মাত্র সপ্তাহ তিনেক আগে গত ২২ আগস্ট লন্ডনেই অধ্যাপক গোলাম মুরশিদের মৃত্যু হয় ।  গোলাম কাদের গত কয়েক বছর ধরে নানারকম শারীরিক সমস্যার মধ্যে রয়েছেন। 


উর্মি আপাকে সহকর্মী হিসাবে না পাওয়ার কারণ তিনি তখন লন্ডনে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশিদের জন্য এবং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য পূর্ণোদ্যমে লেগে পড়েছেন। তিনি বাংলাদেশি অধ্যূষিত পূর্ব লন্ডনের নিউহ্যাম কাউন্সিলে বাংলা অনুবাদের প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছেন। বালাভাষীদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে উদ্যোগী ও সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। লন্ডনে বাংলাদেশিদের পত্র–পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। আর বই লিখেছেন। গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ কাহিনি – কিছুই বাদ রাখেন নি। তাঁর বইগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য —ব্রিকলেন: ‘বিলেতের বাঙালিটোলা’, ‘পাশ্চাত্যে নারী আন্দোলন’, ‘সমান্তরাল, ‘অতিথি’, ‘এদেশে বিদেশে’ ‘বি ইজ ফর বাংলাদেশ’। 


উর্মি আপা ও সাগর চৌধুরী দম্পতির সঙ্গে লন্ডনেও যোগসূত্রটা ছিন্ন হয়ে গেল যখন তাঁরা স্থায়ীভাবে কোলকাতায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপরও তিনি মাঝেমধ্যে লন্ডনে এসেছেন, কিন্তু স্বল্প সময়ের জন্য। ফলে সবার সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ সম্ভব ছিল না। সহকর্মী–বন্ধুরা কোলকাতা গেলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। কিন্তু আমার এ শতকে আর কোলকাতা যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এখন তিনি যে জগতে চলে গেলেন, তা আমাদের নাগালের বাইরে। আমরা এখন মাত্র তিন সপ্তাহের ব্যবধানে বাংলা সাংবাদিকতা ও সাহিত্যের দুজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বকে হারালাম। মুরশিদ ভাইকে পূর্ব লন্ডনের গার্ডেন অব পিসে শুইয়ে রাখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু উর্মি আপাকে শেষ বিদায় জানানো হলো না। 


( ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ – এ সাপ্তাহিক পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...