নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিকল্প যে চরম রাজনৈতিক নিপীড়ণ এবং
নির্বাচনের মৌশুমেও যে তা থেকে রেহাই মিলবে না এই উপলব্ধি থেকেই বিরোধীদল বিএনপি
এবং তার জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই ভোটের লড়াইতে নেমেছে।
গ্রেপ্তার কিম্বা মামলা দেওয়া বন্ধ এবং সভা-সমাবেশের স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার
নিশ্চিত করার বিষয়ে সংলাপে সরকারের আনুষ্ঠানিক আশ্বাসের পরও ঢাকা এবং রাজশাহীতে
জনসভা করতে গিয়েই ঐক্যফ্রন্ট টের পেয়েছে ওইসব আশ্বাস কতটা মূল্যহীন। এখন অসম জমিনে
ভোটের লড়াইতে তারা কতটা কী অর্জন করতে পারবে, তা ৩০ ডিসেম্বর বোঝা যাবে।
নির্বাচনের ফল ভবিষ্যতে শাসনব্যবস্থায় কোনো গুণগত পরির্বতন
আনতে পারবে - এমনটা কেউই আশা করেন না। রাজনীতিকরা যেসব অঙ্গীকার করেন সেগুলো ভুলে
যাওয়া মুহুর্তের ব্যাপার মাত্র। বিএনপি-জামাত জোটের সরকারের অপশাসনের বিপরীতে সুশাসনের
অঙ্গীকার ছিল মহাজোটের। ক্রসফায়ারের গল্প শোনানো বন্ধের অঙ্গীকার ছিল।
বিচারবিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। আশংকার কথা হচ্ছে, এবারের নির্বাচনে
এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নের বিষয়ে জবাবদিহি করা কিম্বা আগামী পাঁচ বছরে কী কী অনিয়ম
দূর করা হবে সেসব বিষয়ে কোনো আলোচনা গুরুত্ব পাবে বলে মনে হয় না। অন্তত: আলামত তা
বলে না। বরং, রাজনীতির প্রধান দুই পক্ষ – আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে কোন আসনে কতজন মনোনয়নের দৌড়ে
আছেন, তাঁদের মধ্যে কে কতটা প্রভাবশালী, কার কতটা তারকামূল্য এগুলোই এখন জন-আলোচনার
মূল বিষয়। এই মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় গণপ্রতিনিধিত্ব আইন (আরপিও) মানা হলে এসব গৌণ
বিষয়কে মূখ্য আলোচ্য হিসাবে দেখতে হোত না। আইন বলছে প্রতিটা দলের তৃণমূলের কমিটি
সম্ভাব্য প্রার্থী হিসাবে পাঁচজনের তালিকা করে দিলে দলের সংসদীয় বোর্ড সেই তালিকা থেকে মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে। আইন মানা
হলে কোনো আসনের জন্য দুই ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর ৩০ হাজার টাকা করে মনোনয়ন ফরম কেনার
কথা নয়, ধানমন্ডি আর নয়া পল্টনেও রাস্তাঘাট বন্ধ হয়ে যেত না।
২০১৮‘র
নির্বাচন নিয়ে আরও অনেক কিছুই এখন লেখা যায়, কিন্তু সেটি আমার উদ্দেশ্য নয়। এই
নিবন্ধে আমি মূলত নজর দিতে চাই অন্য আরেকটি দিকে। কতটা নীরবে আমাদের রাজনীতিতে
কতটা গুরুতর রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটে গেছে, মূলত সেই দিকটি তুলে ধরাই হচ্ছে আমার
লক্ষ্য।
২০০৬ সালের কথা অনেকরেই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার কথা।
সেই সময়ে আওয়ামী লীগ একটি ইসলামপন্থী দল ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে নির্বাচন সামনে
রেখে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় স্বাক্ষর করেছিল। ওই চুক্তিতে আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার
ছিল তারা নির্বাচিত হলে কোরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো আইন করবে না। প্রায়
সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এবং প্রগতিশীল পরিচয়ে পরিচিত বিভিন্ন
নাগরিক-সামাজিক গোষ্ঠী প্রতিবাদে সোচ্চার হলো। যাঁরা তখন এবিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন
তাঁদের মধ্যে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। তখন বামপন্থীরা
ছিলেন আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ এবং তাঁদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার একটা বিষয় ছিল।
প্রতিবাদের মুখে সেসময় আওয়ামী লীগ স্বল্পতম সময়ে সেই লিখিত চুক্তি বাতিল করতে
বাধ্য হয়। এরপর, জোটবদ্ধ নির্বাচনে বামপন্থীদের একাংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয় অপর
অংশ জোটের বাইরে থাকাই শ্রেয় বিবেচনা করে। বামপন্থীদের যে অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে
জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করেছে সেই অংশ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ায় মোটামুটিভাবে আওয়ামী
লীগে অংশীভূত হওয়ারই উপক্রম হয়েছে। তারা ২০১৪তেও বিনা প্রতিদ্বন্দিতার নির্বাচনেও
জোটের সঙ্গী হয়ে থেকেছে।
জাতীয় রাজনীতিতে যে নীরব মেরুকরণের কথা বলছিলাম সেটি ২০০৬
কিম্বা তারও আগে শুরু হয়েছিল কিনা তা নিয়ে হয়তো বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু, আমার
আলোচ্য ২০০৬ নয়, ২০১৩ এবং ২০১৮। ২০১৩ সালে নির্বাচনের মাস সাতেক আগে মে মাসে ঢাকায়
ইসলামপন্থী জোট হেফাজতে ইসলামের একটি সমাবেশকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতির জন্ম
হয়েছিল তার পটভূমিতে কেউ কি তখন ভেবেছিলেন যে এই কট্টরপন্থী ইসলামী গোষ্ঠীর সঙ্গে
আওয়ামী লীগের একটি আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে? জোটের বামপন্থী শরীকরা তো বটেই এমনকি
আওয়ামী লীগের নেতারাও হেফাজতের শীর্ষনেতাকে যে অভিধায় অভিহিত করেছিলেন, মাত্র পাঁচ
বছরের ব্যবধানে তাঁরা সেই অভিধা ব্যবহারকে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ করেছেন। আল-হাইয়াতিল
উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ নামে কার্য্যত হেফাজত আয়োজিত শুকরিয়া মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীর
সামরিক সচিব জানান, প্রধানমন্ত্রী
বেঁচে থাকতে কোরআন ও সুন্নাহর সঙ্গে সাংঘর্ষিক কোনো বাংলাদেশের মাটিতে হতে দেবেন
না।
লক্ষ্যণীয়
বিষয় হচ্ছে ৫ বছরে বাংলাদেশের এতোটাই বদলে গেছে যে এসব বিষয় এখন আর তেমন একটা উদ্বেগের
বিষয় নয়। পাঠ্যসূচিসহ শিক্ষাব্যবস্থায় বিনাবাধায় হেফাজতের ইচ্ছাপূরণ ঘটেছে। হেফাজতে
ইসলামের অন্যতম কট্টর শরীক সেই ইসলামী ঐক্যজোটের সঙ্গে আওয়ামী লীগের আবারও নির্বাচনী
সমঝোতার খবরেও কোনো বিরুপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। ৪ নভেম্বর স্কুল পরীক্ষা স্থগিত
করে আয়োজিত শুকরানা সমাবেশের দু‘দিন
পর ৬ নভেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের এক
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয় শুকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণকে তাঁরা নেতিবাচকভাবে
দেখেন না। কিন্তু, সেই সংবাদ সম্মেলনেই তাঁরা দাবি করেছেন আগামী নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার
নিষিদ্ধ করতে হবে (শুকরানা মাহফিলে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ নেতিবাচক
নয়, বাংলা নিউজ২৪.কম, ৬ নভেম্বর, ২০১৮)। রাজনীতির এই রুপান্তর
শুধু যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, আমাদের সংস্কৃতি জগতের নেতাদের কথায়
তারই স্বাক্ষ্য মেলে। ওই সংবাদ সম্মেলনে তাঁরা অবশ্য উদার-গণতন্ত্রী রাজনীতিক ডঃ কামাল
হোসেনকে একহাত নিতে ভোলেন নি। তাঁরা বলেছেন ডঃ কামাল ১৯৭২ এর সংবিধান প্রণেতা। সেখানে
বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের কথা বললেও এখন তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে সংবিধানের
বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ( নির্বাচন নিয়ে ৬ দফা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের, কালের কন্ঠ,
৭ নভেম্বর, ২০১৮)।
একথা ঠিক যে
বিএনপিকেন্দ্রিক মেরুকরণটিও কম বিস্ময়কর নয়। কয়েকমাস আগেও যেধরণের মৈত্রীর কথা
অকল্পনীয় ছিল, সেরকমই একটি জোট অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বাস্তবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
সম্ভবত, সেকারণেই জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সংলাপে প্রধানমন্ত্রী তার
মুখোমুখি বসা বিরোধীনেতাদের অর্ধেকেরও বেশি নেতাকে স্মরণ করিয়ে দিতে পেরেছেন যে
তাঁরা একসময়ে তাঁর দলেই ছিলেন, তিনি তখন তাঁদের কী কী সুবিধা দিয়েছেন। আওয়ামী
লীগের সাবেকদের তালিকা ডঃ কামাল হোসেন, মাহমুদুর রহমান মান্না , আকরাম হোসেন বা
সুলতান মনসুরেই শেষ হয়নি। এরপর তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কাদের সিদ্দিকীও। সাবেক
আওয়ামী লীগ নন, কিন্তু, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভায় কাজ করা জেএসডি নেতা
আসম রবও এই জোটের শরীক।
তবে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের
জোটবদ্ধতায় রাজনৈতিক আদর্শ বা ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রশ্ন এখনও আসেনি। আপাতত: তাঁদের
ঘোষিত লক্ষ্য গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার। তাঁদের ভাষ্য অনুযায়ী গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের
পর সরকার গঠনের ভাগাভাগিটা কেমন হবে বা তাঁদের রাজনৈতিক অঙ্গীকারগুলোতে কী থাকবে - তা আমাদের অজানা।
৫ বছর আগের বিনা প্রতিদ্বন্দিতার
একতরফা নির্বাচনের পরিণতিতে দেশে গণতন্ত্রের ওপর যে খড়গ নেমে এসেছিল তা অস্বীকার
করার উপায় নেই। গণতন্ত্রের প্রাণ যে একটি কার্য্যকর বিরোধীদল সেটি ৫ বছর ধরে
অস্বীকার করে আসার পরিণতি যে এরকম হবে সেটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব কতটা উপলব্ধি
করতে পারছে তা আমাদের জানা নেই। তবে, রাজনীতিতে নীতিহীন আপোষরফার যে পথে তাঁরা
অগ্রসর হচ্ছেন তাতে একসময়ের দাপুটে দলটিকে এখন নির্বাচন জেতার জন্য সংসদীয় অসনের প্রতি
চারটির মধ্যে অন্তত একটি নতুন-পুরোনো শরীকদের জন্য ছাড়ার কথা বিবেচনা করতে হচ্ছে। একইভাবে
চরম প্রতিকূলতার মুখে থাকা বিএনপিরও এখন জোটনির্ভরতা বেড়েছে এবং তা সম্প্রসারিত
হয়েছে। তবে, এর ফলে তাদের রাজনৈতিক অবস্থান কতটা বদলাবে তা দেখার জন্য আমাদের আরও
অপেক্ষায় থাকতে হবে।
(১৪ নভেম্বর, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন