বহুদিন আগে – ঠিক কতদিন তার অবশ্য কোনো নির্ভরযোগ্য হিসাব আমার জানা নেই - সবধরণের অন্যায়-অবিচার-অনিয়মের কথা সাংবাদিকদের কলমে বেরিয়ে আসে বলে তাদের নাম হয়েছিলো কলমযোদ্ধা। কেউ কেউ আবার সাহসের জন্য নির্ভীক কলমসৈনিক অভিধাও পেয়েছেন। কিন্তু, সেই যুদ্ধ এখন নতুন রুপ পেয়েছে। বিশ্ব জুড়েই কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরতন্ত্রী শাসকরা এখন সাংবাদিকতাকে তাঁদের আক্রমণের এক নম্বর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছেন। স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার বিশ্বের যে দেশটিতে সবচেয়ে বেশি আইনগত সুরক্ষা পেয়ে থাকে সেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাংবাদিকদের গণশত্রু অভিহিত করে চলেছেন। রাজনৈতিক স্বার্থে অসত্য বলায় অভ্যস্ত ট্রাম্প সত্যকে ভুঁয়া খবর বা ফেক নিউজ আখ্যা দিয়ে সাংবাদিকতা পেশাকে শুধু তাঁর দেশেই যে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন তা-ই নয়, বাকি বিশ্বেও সাংবাদিকদের জীবন বিপন্ন করে তুলছেন।
বিশ্বজুড়ে সম্প্রতি যে হত্যাকান্ড আলোড়ন তুলেছে তার শিকার একজন সাংবাদিক – জামাল খাসোগি। ভিনদেশের মাটিতে খাসোগি সৌদি রাষ্ট্রের যে নৃশংসতার শিকার হয়েছেন তার রোমহর্ষক বিবরণ মধ্যযুগীয় বাস্তবতাকেও হার মানায়। বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট, পাশ্চাত্যের গণমাধ্যমগুলোর অব্যাহত অনুসন্ধিৎসা, তাঁর তুর্কি প্রেয়সীর বুদ্ধিমত্তা এবং তুরস্কের রাজনৈতিক স্বার্থের অভূতর্পূব সম্মিলনের কারণে হত্যাকান্ডটি ধামাচাপার সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে যায়। ইয়েমেনে সৌদি নৃশংসতায় হাজার হাজার মৃত্যুর চেয়েও খাসোগির মৃত্যু সৌদি সরকার এবং রাষ্ট্রকে অনেক বেশি এবং কঠোরতর সমালোচনার মুখে ফেলেছে। কিন্তু, অপরাধের অকাট্য প্রমাণ প্রকাশের পরও খাশোগির ওপর জঙ্গিবাদীর অপবাদ চাপিয়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ তার দায় এড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে। পরিহাসের বিষয় হচ্ছে বিশ্বের সর্বাধিক সংখ্যক সাংবাদিককে কারাগারে আটকে রাখার অভিযোগ যে নেতার বিরুদ্ধে সেই প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এই ঘটনায় সাংবাদিকবান্ধব হিসাবে নিজেকে জাহির করার সুযোগ নিচ্ছেন।
ছোট-বড়, দেশি-বিদেশী, জাতীয়-বৈশ্বিক সব পরিসরেই সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যম এখন এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বৈশ্বিক সংবাদ সংস্থা, রয়টার্সের সদর দপ্তরে গত ১৭ অক্টোবর থমসন রয়র্টাস ফাউন্ডেশনের এক অনুষ্ঠানে এই চ্যালেঞ্জের কথা বলতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মনিক ভিলা সংবাদমাধ্যমের প্রতি বৈশ্বিক পরিসরের এই বৈরিতার কিছু বিবরণ তুলে ধরেন। রাষ্ট্র, রাজনীতিক, অপরাধীচক্র, সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী, বৃহৎ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সবার তোপ সংবাদমাধ্যমের দিকে তাক করা। ২০০০ সালে সিয়েরালিওনে নিহত রয়টার্সের যুদ্ধ সাংবাদিক কুর্ট শরকের স্মরণে প্রচলিত সাংবাদিকতার পুরষ্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে মনিক ভিলা যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান, সৌদি যুবরাজ মোহ্ম্মদ বিন সালমান (এমএসবি) , মিয়ানমারের সুচির প্রশাসন, ভারত এবং ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে পরিবেশ কতটা বৈরী হয়ে উঠছে সেদিকে আলোকপাত করেন।
মনিকের বক্তব্যে যেসব দেশের কথা বাদ পড়েছে সেগুলোর কথা উঠে এসেছে পুরষ্কারপ্রদান পর্বের পর অনুষ্ঠিত সেমিনারে। সেমিনারের শিরোনাম ছিল রিপোর্টিং ফ্রম রিপ্রেসিভ এনভায়রনমেন্টস। আলোচক ছিলেন ইনডেক্স অব সেন্সরশিপের প্রধান নির্বাহী জোডি গিন্সবার্গ, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)‘র সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কৌশল বিষয়ক প্রধান কলিন পেরেরা, বিবিসির ইয়েমেনি সাংবাদিক নাওয়াল মাগাফি, রয়টার্সের আঞ্চলিক সম্পাদক সায়মন রবিনসন এবং লেখকদের সংগঠন পেন এর বন্দী লেখক বিষয়ক কমিটির প্রধান সলিল ত্রিপাঠি। দূর্ভাগ্যের বিষয়, আলোচনায় বাংলাদেশের কথা ঘুরেফিরে অনেকবারই উচ্চারিত হয়েছে – বিশেষত: বিনা বিচারে আটক আলোকচিত্রী শহীদুল আলমের কথা। রাষ্ট্রীয়ভাবে ভিন্নমত দমনের অভিযোগ তুলে সলিল শহীদুলের জামিন না হওয়া, ছাত্রবিক্ষোভের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলা এবং সাংবাদিকদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের দৃষ্টান্ত দেন। অন্য যেসব দেশের কথা আলোচনায় উঠে আসে তার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া এবং আফ্রিকার কয়েকটি দেশ। এসব দেশে রাষ্ট্রীয় নীতি এবং রাজনীতিকরা সংবাদমাধ্যমের প্রতি ক্রমশই বৈরী হয়ে ওঠার নানা নজির তাঁরা উল্লেখ করেন।
কথা ওঠে অপেক্ষাকৃত নতুন এবং ভীতিকর একটি প্রবণতার , যার উৎস মূলত রাজনৈতিক এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শে। রাজনীতিকরা তাঁদের অনুসারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে উসকানি দিয়ে ভিন্নমত পোষণকারী ও সাংবাদিকদের নাজেহাল করছেন যা ‘মব জাস্টিস‘ এর সঙ্গে তুলনীয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর ডিজিটাল প্লাটফর্মে অসহিষ্ণুতার বহিঃপ্রকাশ কোথাও কোথাও এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে সাংবাদিকরা শুধু ব্যাক্তিগতভাবে নয়, পারিবারিকভাবে ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প সমর্থকদের একটি বড় অংশ এবং ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা এদিক থেকে এখন সবচেয়ে আক্রমণাত্মক বলে ধারণা করা হয়। ভিন্নমত বা অপ্রীতিকর তথ্য প্রকাশকারী সাংবাদিকের ডিজিটাল পরিচিতি (আইডি)‘র সূত্র ধরে তার ব্যাক্তিগত জীবন, বাড়ি-অফিস-ক্লাবের ঠিকানা বের করে তাঁকে হুমকি দেওয়া বা হয়রানি করার ঘটনা আশংকাজনকভাবে বাড়ছে। এই হয়রানি এবং হুমকি এমনকি সাংবাদিকদের স্ত্রী/ স্বামী-সন্তান-পরিবার পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে।
চলতি বছরেই এপ্রিলে ভারতে সাংবাদিক রানা আয়ুব নজিরবিহীন হুমকি এবং হেনস্থার শিকার হন। তাঁর নামে ভুঁয়া এক অ্যাকাউন্ট থেকে শিশু ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত একজন মুসলিমের পক্ষে টুইট প্রকাশ করা হয় যাতে বলা হয় যে ভারত মুসলমানদের জন্য নিরাপদ নেয়। তাঁর অস্বীকৃতি সত্ত্বেও তাঁকে যে পরিমাণে হুমকি ও গালি-গালাজ সহ্য করতে হয়েছে যে তাঁর সমর্থনে জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর বিবৃতি দিয়ে তাঁকে সুরক্ষা দেওয়ার দাবি জানায়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিএনএনকে ফেক নিউজ আখ্যায়িত করার পর তাঁর সমর্থকরা প্রতিষ্ঠানটির সাংবাদিকদের প্রতি যেধরণের আচরণ করে তা রীতিমত ভীতিকর।
এই প্রবণতা থেকে আমাদের দেশ যে মুক্ত সেকথা অবশ্য বলা যায় না। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে একজন নারী সাংবাদিকের নিগৃহীত হওয়ার স্মৃতি নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদকের একটি ভুল স্বীকারকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে সংগঠিতভাবে বিভিন্নমাধ্যমে অপদস্থ করার চেষ্টার কথাও এখানে স্মরণ করা যায়। ভিন্নমত পোষণকারী অথবা সমালোচককে রাজনৈতিক তকমা লাগিয়ে অপদস্থ করার এরকম দৃষ্টান্ত আরও আছে, যা স্পষ্টতই স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মতপ্রকাশের পথে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
প্রযুক্তির অভূতর্পূব অগ্রগতি এবং চমকপ্রদ সব উদ্ভাবনের কারণে এই শতাব্দির শুরু থেকেই ধারণা করা হচ্ছিলো যে ডিজিটাল জগত হবে গণতন্ত্রায়নের চূড়ান্ত রুপ। নাগরিকরা মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যে অবাধ স্বাধীনতা পাচ্ছে তা আর কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তথ্যপ্রবাহের ক্ষেত্রে সব বাধা দূর হবে এবং নাগরিকরা অভূতরুপে ক্ষমতায়িত হবেন। এই সাইবার ব্প্লিবের নেতৃত্ব দিয়েছে ফেসবুক এবং টুইটার। কিন্তু, পরিহাসের বিষয় হোল এই সামাজিক মাধ্যমগুলোকে কর্তৃত্ববাদী রাজনীতিক এবং উগ্রবাদীরা একদিকে গণ-উন্মাদনা তৈরির হাতিয়ারে পরিণত করেছেন এবং অন্যদিকে নাগরিকদের স্বাধীনতা খর্বের উদ্দেশ্যে নানাধরণের বিধিনিষেধের বেড়াজাল তৈরি করছেন। এ দুটিই ঘটছে সমান্তরালভাবে এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন্যবস্থায় থাকা দেশগুলোতে।
বাংলাদেশে সম্প্রতি পাশ হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সম্প্রচার বিষয়ক নীতিমালা ও আইনের বিধানগুলোও স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করবে এই ধারণাই প্রবল। একমাত্র ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা ছাড়া অন্য প্রায় সবাই এবং বিদেশী পর্যবেক্ষক ও বন্ধুদের বিবেচনায় এটি গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এসব আইন এবং নীতিমালার বিধান কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে আশংকা হচ্ছে সরকারী ভাষ্যে যাকে সত্য বলা হবে সেটাই সত্য, আসল সত্য আর বিবেচ্য হবে না।
সত্য আড়াল করতে সবচেয়ে ঘৃণ্য যে আঘাতটি আসে তা হলো প্রাণঘাতি। জাতিসংঘের সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা , ইউনেসকোর পরিসংখ্যান বলছে বিশ্বে প্রতি চারদিনে একজন সাংবাদিক নিহত হচ্ছেন। ২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল এই ১১ বছরে নিহত হয়েছেন এক হাজারেরও বেশি সাংবাদিক। জাতিসংঘের হিসাবে চলতিবছরে ইতোমধ্যেই নিহত হয়েছেন ৮৮ জন। ’
এসব পরিসংখ্যান যতটা দু:খজনক, তার চেয়েও কষ্টের বিষয় হলো বিচারহীনতা। বাংলাদেশে একটি ধারণা চালু আছে যে সাংবাদিক পিটালে কিছু হয় না। এই ধারণা বিশেষভাবে প্রকট রাজনৈতিক দলের পান্ডা এবং আইন-শৃংখলাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে। শুক্রবার ছিল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতা অবসানের আন্তর্জাতিক দিবস। দিবসটি উপলক্ষ্যে সিপিজে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তির একটি সূচক প্রকাশ করেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে সবার ওপরে আছে ভারত, তারপর নাইজেরিয়া এবং তৃতীয় স্থানে বাংলাদেশ। সাত বছর আগে নিহত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির কথা নিশ্চয়ই পাঠকের মনে থাকবে। সাংবাদিক হত্যার বিচারের অগ্রগতি বিষয়ে সরকার ইউনেসকোর কাছে যে তথ্য দিয়েছে দেখা যাচ্ছে ১১ টি মামলা এখনও বিচারাধীন বা তার নিষ্পত্তি হয় নি।
সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচারহীনতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে জাতিসংঘ এখন অবিলম্বে এই বিচারহীনতা অবসানে ব্যবস্থা নিতে সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের চারজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত এবং মাত্রাহীন রাজনৈতিক উসকানি এখনই বন্ধ হওয়া দরকার। জাতিসংঘ মহাসচিব আরও একধাপ এগিয়ে বলেছেন সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয় এবং সত্যের মৃত্যু নেই। আমরা আশা করবো এই সত্যটুকু রাজনীতিকরা মেনে নেবেন।
(৪ নভেম্বর, ২০১৮‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত লেখকের নিবন্ধ।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন