শেয়ারবাজারে দরপতনের ধারা অব্যাহত থাকায় আবারও হায় হায় রব উঠেছে। এক দশকের
মধ্যে শেয়ারজাজারের মূল্যসূচক সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে। মাত্র একবছরের ব্যবধানে দেশের প্রধান
শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বাজার মূলধন কমেছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা।
শেয়ারবাজারের এই দূর্দশাকে অবশ্য দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির অগ্রযাত্রায় একটি
ব্যাতিক্রম বা বিচ্যূতি হিসাবে তুলে ধরার একটা চেষ্টা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। ভাবটা
যেন এমন যে সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে, শুধু শেয়ারবাজারটাই ঠিক করা যাচ্ছে না। এই
বিচ্ছিন্ন সংকট নিয়ে উৎকন্ঠার কিছু নেই।
দ্রুত টাকা কামাইয়ের আশায় যেসব কথিত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী বারবার
শেয়ারবাজারে স্বল্পমেয়াদে বিনিয়োগ করতে এসে পুঁজি হারিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যাশা
পূরণ হওয়ার নয়। এবিষয়ে তাঁদের বিনিয়োগের ওপর নির্ভরশীল কোম্পানিগুলো, বাজার
নিয়ন্ত্রক সংস্থা কিম্বা সরকার কারোর কোনো দায়িত্ব নেই। সামগ্রিকভাবে জবাবদিহিহীন
রাষ্ট্রে এর অন্যথা হওয়ার কথা নয়। সুতরাং, যাঁরা আশা করেন, কোনো না কোনো জাদুর বলে
এরকম মুমূর্ষু একটি বাজার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে তাঁদের ভ্রান্তি সহজে দূর হওয়ার
নয়।
শেয়ারবাজারের সমস্যা কীভাবে বৃহত্তর সংকটের অংশ সেটা প্রথমেই বোঝা প্রয়োজন
এবং সেই উপলব্ধি ছাড়া কিছু বিচ্ছিন্ন এবং স্বল্পমেয়াদী সহায়তা কিম্বা প্রণোদনা এই
বাজারের অস্থিরতা দূর করে আস্থা পুনরুজ্জীবন করতে পারবে না। ঢাকার শেয়ারবাজারে
তালিকাভুক্ত ইস্যূর ( শেয়ার, ডিবেঞ্চার ও বন্ড) সংখ্যা ডিএসইর ওয়েবসাইটের (১৪ জানুয়ারি ২০১৯ এর
তথ্য) অনুযায়ী মোট ৫৮৮। এর মধ্যে সরকারের
বন্ডই আছে ২১১টি – যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিক
বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সীমিত। কার্যত
বাজারের দৈনন্দিন লেনদেনে যেসব কোম্পানির শেয়ার প্রধানত প্রভাব ফেলে সেগুলোর
সংখ্যা সাড়ে তিনশোর মত। এর মধ্যে আর্থিক খাতের কোম্পানি ১০৬টি
, যার মধ্যে ব্যাংক ৩০টি, অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২৩ এবং বীমাখাতের
৫৩টি। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের যে বিপুল পরিমাণে খেলাপি ঋণ তাতে এই খাতের
শেয়ারগুলোতে বিনিয়োগকারীদের আস্থা রাখার কোনো যৌক্তিক কারণ আছে কী? সরকারি হিসাবে গত অর্থবছরের শেষে এটি ছিল মোট
ঋণের ১২ শতাংশ। আইএমএফ এর হিসাবে যা দ্বিগুণেরও বেশি ২৬ শতাংশ। বেসরকারী ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক ছিল যেটি
সেই ব্যাংকটির মালিকানায় রহস্যঘেরা রদবদলের পর গত কয়েকবছরে তার নিম্নগামিতার কথা
সবারই জানা। সার্বিকভাবে সুদের হার কমানোর চাপ এড়াতে ব্যাংকগুলো মরিয়া, কেননা
তাদের টিকে থাকাই নাকি ঝুঁকির মুখে পড়বে।
ব্যাংক নয় এমন আর্থিক কোম্পানিগুলোর মধ্যে পিপলস লিজিংয়ের মত একাধিক
কোম্পানি আছে যেগুলোর মূল পুঁজিই উদ্যোক্তারা হাওয়া করে দিয়েছেন। এরকম
দেউলিয়াত্বের মুখে পড়া আর্থিক কোম্পানি শিল্পখাতের একাধিক কোম্পানিকেও যে পথে
বসিয়েছে তার নজির হচ্ছে প্রশান্ত কুমার
হালদারের ৩৫০০ কোটি টাকা হাওয়া করার ঘটনা। বীমা খাতের কোম্পানিগুলোর মধ্যে হাতে
গোণা কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশেরই ব্যবসা নেই। সেখানেও কয়েকটি কোম্পানির উদ্যোক্তা
পরিচালকদের বিরুদ্ধে অনিয়ম-অসাধুতার অভিযোগ আছে। আর্থিক খাতে অবশ্য এগুলোই সব নয়। এরপর আছে ৩৭টি
মিউচুয়্যাল ফান্ড। শেয়ারবাজরের শুরুর দিকে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠান আইসিবি সেব
মিউচুয়্যাল ফান্ড চালু করেছিল, সেগুলোর অবস্থা ভালো । বেসরকারী খাতে পরে যেমব
মিউচুয়্যাল ফান্ড গড়ে উঠেছে তার মধ্যে হাতে গোণা কয়েকটি বাদে বাকিগুলোর অবস্থা
মোটেও সুবিধাজনক নয়। কেননা, তাদের বিনিয়োগও যে খুব মানসম্পন্ন ছিল, এমনটি বলা যায়
না।
ডিএসইতে বাজার মূলধনে একক কোম্পানি হিসেবে সবচেয়ে বড় অংশীদারত্ব
হচ্ছে গ্রামীণফোনের। বাজারের সবচেয়ে ভালো কোম্পানি হিসাবে গ্রামীণফোনে যাঁরা বিনিয়োগ
করেছিলেন, তাঁদের পুঁজি গত এক বছরে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। এই সময়ে কোম্পানিটির শেয়ারের
দাম কমেছে ১৪৮ টাকা বা ৩৮ শতাংশ। ফলে এ কোম্পানির শেয়ারের দরপতনে সূচকেও বড় ধরনের নেতিবাচক
প্রভাব পড়ে। সহসা গ্রামীণের কপাল খুলবে এমন সম্ভাবনাও কম। টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক
সংস্থার সঙ্গে তার টানাপোড়েন যেন মিটছেই না। সরকারের দাবি করা পাওনার অংক নিয়ে
তাদের বিরোধ আদালতে গড়িয়েছে এবং এসব দ্বন্দ্বের নিরসন হওয়ার আগে শেয়ারটিতে
বিনিয়োগের ব্যাপারে দ্বিধা-সংশয় স্বাভাবিক। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজার ধসের সময়েও
ডিএসইর তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাজার মূলধনের অংশ হিসাবে একক বৃহত্তম যে
কোম্পানি এবং একই উদ্যোক্তাদের পরিচালনাধীন কোম্পানিগুলোর দরপতনের প্রভাব কতটা
বিরুপ প্রভাব ফেলেছিল, তা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে।
ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে গত এক বছরে ভালো মানের শেয়ারগুলো
– অর্থাৎ, ঢাকার বাজারের বাছাই করা ৩০ কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত
ডিএস–৩০ সূচকে অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলোর দাম পড়েছে বেশি। এছাড়া, লক্ষণীয় আরেকটি উপাদান হচ্ছে নিম্নমানের শেয়ার , অর্থাৎ যেসব
কোম্পানি বছরের পর বছর ডিভিডেন্ড দিতে পারে নি, সেসব কোম্পানির শেয়ারে নাটকীয়ভাবে
দাম ওঠানামা করেছে। যাতে স্পষ্টতই অদৃশ্য যোগসাজশ ও কারসাজির আলামত মেলে। আবার,
আইপিও অনুমোদনের ক্ষেত্রেও বড়ধরণের অনিয়ম ও অসাধুতার অভিযোগ আছে, যা নিয়ন্ত্রক
সংস্থা , বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিসিইসি‘র দায়িত্বহীনতা, অযোগ্যতা বা অসাধুতা ছাড়া সম্ভব নয়।
এবিষয়ে ২০১০ সালের বাজার ধসের বিষয়ে তদন্তের নেতৃত্বদানকারী ব্যাংকার খোন্দকার
ইব্রাহিম খালেদের মূল্যায়নটি যর্থাথ। তাঁর কথায় বর্তমান বিএসইসির
সময়কালে বাজারে সবচেয়ে বেশি বাজে কোম্পানি এসেছে। তিনি নিয়ন্ত্রক সংস্থা পুর্নগঠনের কথা বলেছেন। কিন্তু, আশংকার কথা হচ্ছে
২০১০ এর তদন্ত রিপোর্টের মতই এসব সুপারিশ উপেক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
১৯৯৬ সালের ধসের তিক্ত অভিজ্ঞতার পর অনেকেই যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে বাজার
ব্যবস্থাপনা, তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ এগুলোর সবক্ষেত্রেই আমাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার
ঘাটতি একটা বড় কারণ। কিন্তু, প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সেগুলো দূর করা যাবে।
দীর্ঘ আড়াই দশকেও একটা কার্যকর বিধিভিত্তিক ও স্বচ্ছ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব
হয় নি। ইতোমধ্যে ২০১০ সালে আরও একবার বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কোনোবারই
বাজারের নেপথ্য কারিগরদের জবাবদিহি করতে হয় নি। বরং, সরকার সাময়িক দাওয়াই হিসাবে পুঁজিবাজারে
বিনিয়োগের জন্য টাকার সরবরাহ বাড়ানোর যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তাতে বাজার
পরিচালনাকারীরা লাভবান হয়েছে। বিনিয়োগ
হিসাবে ঋণের ওপর সুদ মওকুফের কারণে বিনিয়োগকারীদের অনেকের ক্ষতি হয়তো কিছুটা
কমেছে, কিন্তু ক্ষতি পোষানোর সুযোগ তাঁদের হয় নি। ওয়াল ষ্ট্রিটে কারসাজির জন্য সেই
বাজারের সবচেয়ে প্রভাবশালী কারবারি বার্নি ম্যাডোফকে দেড়শো বছরের কারাদন্ড নিয়ে
জেলে যেতে হয়। কিন্তু, বাংলাদেশের বাজারে কারসাজির দায়ে কাউকেই কোনো জবাবদিহি করতে
হয় না।
শেয়ারবাজারের এই দুরবস্থার কিছুটা দায় তাঁদের ওপরও বর্তায়, যাঁরা
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর হিসাব নিরীক্ষা করেন। এসব নিরীক্ষায় যদি কোনো ফাঁক-ফোকর
না থেকে তাহলে নিম্নমানের কোম্পানি যেমন আইপিওতে আসতে পারেনা, তেমনই রোগাক্রান্ত
কোম্পানির দূর্বলতা আড়াল করা এতোটা সহজ হতো না।
২০০৮ সালে লেম্যান ব্রাদার্সের পতনের পর সৃষ্ট বৈশ্বিক মন্দার পর থেকে গত
এক দশকে বেশ কয়েকটি বৈশ্বিক হিসাবনিরীক্ষক
প্রতিষ্ঠানকে ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের
কাছে বড়ধরণের জরিমানা গুণতে হয়েছে। আমাদের দেশে এরকম ব্যবস্থার কথা কেউ কখনো
শুনেছেন বলে মনে করা কঠিন।
শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরানোর কাজটি কখনোই সহজ নয়। একই ধরণের ব্যর্থতার
পুনরাবৃত্তির কারণে এখন তা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে।
ব্যাংক-বীমাসহ অন্যান্য আর্থিক খাতের মতই সমস্যাকে সামগ্রিক পটভূমিতে না দেখে
বিচ্ছিন্নভাবে তার সমাধান খুঁজলে সহসা দূর্ভোগের অবসান ঘটবে না।
(১৭ জানুয়ারি, ২০২০‘র প্রথম আলোয় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন