সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা কেন অশুভ সংকেত?


স্কুলছাত্র নাইমুল আবরারের অবহেলাজনিত মৃত্যুর মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি ছাড়া অন্য কিছু ভাবার সুযোগ নেই। একজন স্কুলছাত্রের দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যু  অবহেলাজনিত হত্যাকান্ড হলে তার বিচার নিশ্চয়ই হওয়া দরকার। কিন্তু, ঘটনাস্থলে অনুষ্ঠানের কোনো পর্যায়েই তিনি উপস্থিত ছিলেন না। সেই হিসাবে সেখানে তাঁর যে সরাসরি কোনো ভূমিকা ছিল না সেকথা মোটামুটি সর্বজনস্বীকৃত। বিপরীতে, এই মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরকে প্রথম আলোর কন্ঠরোধের আরও একটি চেষ্টা হিসাবে সন্দেহ করার অনেকগুলো কারণ দৃশ্যমান।
প্রথমত: কিশোর আলোর প্রকাশক হিসাবে তাঁর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনতে হলে বাংলাদেশের যেসব প্রতিষ্ঠানে দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর সবকটির প্রধান নির্বাহীরা অভিযুক্ত হবেন। তা সেটি গার্মেন্টস কারখানা হোক, সরকারী দপ্তর হোক, কিম্বা রেল-সড়ক-নৌ-বিমান দূর্ঘটনাই হোক। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব ছাত্র নিহত হয়েছেন সেজন্য কজন উপাচার্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? ভোট আয়োজন নিয়ে যেসব মানুষ নিহত হয়েছেন তার জন্য কখনো কি কোনো প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে? এরকম আরও অনেক দৃষ্টান্ত টানা যায়।
দ্বিতীয়ত: ঘটনাস্থলটি যে স্কুল ও কলেজের মাঠ , সেই ভেন্যু কর্তৃপক্ষের কোনো দায় কিন্তু নির্ধারণ করা হয় নি। অথচ, অধিকাংশ দেশেই দেখা যায়, আইনগতভাবে অনুষ্ঠানস্থলের কর্তৃপক্ষের দায়ই হচ্ছে প্রধান।
তৃতীয়ত: দূর্ঘটনার প্রায় সপ্তাহখানেক পরে মামলাটি দায়েরের পিছনে সরকার যে প্রকাশ্য উৎসাহ যুগিয়েছেন, তা নিছক ঘটনাচক্রের বিষয় নয়। প্রথম আলোর সম্পাদকের নাম মামলায় অর্ন্তভুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ভূমিকা বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। মামলা হওয়ার আগে ও পরে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দৈনিক প্রথম আলোর আয়োজকদের অবহেলার কারণে রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের শিক্ষার্থী নাইমুল আবরারের মৃত্যু হয়েছে।এরপর, সম্পাদকের বিচারের পাশাপাশি প্রথম আলো বন্ধের দাবি নিয়ে  ছাত্রলীগ পত্রিকাটির কার্যালয়ের সামনে একাধিকবার মানববন্ধন করে।

চতূর্থত, মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সমন জারির সুযোগ থাকলেও তা না করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রহস্যজনক। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে প্রকাশ্যে প্রথম আলোকে দায়ী করে দেওয়া বক্তব্য এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে বলে ধারণা করা কি অযৌক্তিক হবে?
পঞ্চমত: প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে গত কয়েক বছর ধরে যেসব নির্বতনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেগুলোর থেকে এই মামলায় সম্পাদককে অর্ন্তভূক্ত করা মোটেও বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। প্রথম আলোকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং তাঁর সব অনুষ্ঠানে নিষিদ্ধ করা,  বেসরকারী বিজ্ঞাপনদাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ রাখতে বাধ্য করা, সংসদে পত্রিকাটির বিরুদ্ধে মন্ত্রী-সাংসদদের বিষোদগার এবং শুধুমাত্র হয়রানির উদ্দেশ্যে সম্পাদক হিসাবে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে কথিত মানহানির একটি অভিযোগে বিভিন্ন জেলায় ৫৫টি মামলা দায়েরের নজির স্থাপনের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়।
ষষ্ঠত: বিভিন্ন দূর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য প্রকাশের কারণে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা প্রথম আলোর বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগ করে আসছেন। সুতরাং, পত্রিকাটির ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল হিসাবে এই দূর্ঘটনাটিকে ব্যবহারের আশংকা তাই প্রবল।
সপ্তমত: ক্রমশ অপসৃয়মান ব্যাক্তি স্বাধীনতা, নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোর পটভূমিতে যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে তার মধ্যে প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টার এখনও সাহসের সঙ্গে অধিকারগুলোর কথা বলে চলেছে। মতিউর রহমান গত কয়েকবছরে অনেকবার প্রকাশ্য বক্তৃতা, সাক্ষাৎকার এবং লেখায় বলেছেন যে তিনি যেসব কথা বলতে চান তা বলতে পারছেন না। মাহফুজ আনাম লিখেছেন ‘লিখতে পারি না লেখার স্বাধীনতা‘টুকু নিয়েও তাঁর উদ্বেগের কথা। বিপরীতে, মন্ত্রী-সাংসদ এবং সরকারসমর্থক মিডিয়া শুধু প্রকাশনা ও টিভি-রেডিওর সংখ্যা দিয়ে দাবি করে চলেছেন দেশে বহুমতের গণতন্ত্র রয়েছে। সুতরাং, কথা বলার স্বাধীনতা নেই এই কথাগুলোর উচ্চারণও বন্ধ করতে সরকার যে উৎসাহী হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথম আলোর ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্য তাই একটাই গণমাধ্যমকে পুরোপুরি বশীভূত করা।
প্রথম আলোর সম্পাদকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনাকে কেউ কেউ অবশ্য মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি হিসাবে বিবেচনা করতে রাজি নন। এঁদের মধ্যে একটি অংশের এই অবস্থানের কারণটি রাজনৈতিক, আর অপর অংশের ব্যাক্তিগত ক্ষোভ ও ঈর্ষা। রাজনৈতিকভাবে যাঁরা এই ঘটনাকে গণমাধ্যমের কন্ঠরোধের চেষ্টা বলতে নারাজ, তাঁরা প্রধানত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সমর্থক। সরকারঘনিষ্ঠ এবং আর্শীবাদপুষ্ট সাংবাদিকনেতাদের দুএকজনের মন্তব্যেও তা প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়াও, এই মামলাকে সংবাপত্রের কন্ঠরোধের চেষ্টা হিসাবে বিবেচনা করার সত্ত্বেও আরেকটি গোষ্ঠী রাজনৈতিক কারণে বিষয়টিতে নীরবতা পালনের নীতি অনুসরণ করছেন। তাঁদের অভিযোগ - সাবেক বিএনপি নেতা ও আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও জামায়াতে ইসলামীর প্রকাশনা দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক আবুল আসাদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে প্রতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম আলো তাঁদের পাশে দাঁড়ায় নি।
এরপর একটি দল আছেন যাঁরা প্রথম আলোর সাফল্যে ঈর্ষান্বিত। প্রথম আলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাঁরা নিজেদের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা উন্মোচিত হবে বলে ধারণা করেন। সুতরাং, তাঁরা বরং কিছুটা উৎসাহিত বোধ করছেন। এঁদের কাছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গৌণ ও গুরুত্বহীন। এঁরা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে যাঁরা ক্ষমতাধর, তাঁদের তোষণকেই সাফল্যের ভিত্তি হিসাবে গণ্য করেন। প্রথম আলোর বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা এই খাতে সবচেয়ে ভালো বলে যে ধারণা চালু আছে তা যেমন সত্য, তেমনই পত্রিকাটিতে প্রতিযোগিতা এবং কাজের চাপও অপেক্ষাকৃত বেশি। ফলে,  অনেককেই বিভিন্নসময়ে বিদায় নিতে হয়েছে। এসব সাবেক কর্মীদের কেউ কেউ ব্যাক্তিগত ক্ষোভের কারণে নীরবতা পালন অথবা পালে হাওয়া দেওয়ার নীতি অনুসরণ করছেন।
তবে, আশার কথা হচ্ছে, প্রথম আলোর সাফল্যই তার প্রধান শক্তি। কোটি কোটি পাঠক পত্রিকাটির প্রতি আস্থা রেখেছেন। যার মানে হচ্ছে পত্রিকাটির সম্পাদকীয় নীতির প্রতি আস্থা রেখেছেন।এই কৃতিত্ব অবশ্যই পত্রিকাটির সম্পাদক, মতিউর রহমানের।পাঠকদের এই আস্থার শক্তিতে সব হয়রানি এবং ভীতিকে জয় করা সম্ভব। নাইমুল আবরারের দূর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর বিচার নিশ্চয়ই হতে হবে। কিন্তু, সেই বিচার প্রথম আলোকে শায়েস্তা করার উপলক্ষ্য হতে পারে না। এজন্যেই প্রশ্ন উঠছে, ভিন্নমত প্রকাশের জন্য দেশের শীর্ষ পত্রিকার কন্ঠরোধী পদক্ষেপ আর্ন্তজাতিক পরিসরে ব্যাখ্যা করা কঠিন বলেই কি একজন ছাত্রের র্দূঘটনাজনিত মৃত্যুকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহারের চেষ্টা? প্রথম আলোর সম্পাদকীয় স্বাধীনতা রক্ষায় তাই সবারই অকুন্ঠ সমর্থন জানানো প্রয়োজন।   


মন্তব্যসমূহ

  1. বিষয়টিঅত্যন্ত গুরুতর। বাংলাদেশে বরাবরই মুক্তকণ্ঠ ও মুক্তচিন্তার কন্ঠ রোধে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করে আসছে। আমরারের অবহেলাজনিত মৃত্যুর অবকাঠামোর মালিকই হবার কথা দোষী। কিন্তু হচ্ছে পুরো উল্টো। মৌলবাদীদের পূর্বেকার ষড়যন্ত্রের কথা মনে থাকলে দেশের সকল প্রগতিশীল মানুষেরা এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন এটাই প্রত্যাশা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...