সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আনিস, হারিসের দণ্ড মওকুফ কেন স্বাভাবিক নয়

আল-জাজিরার অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন তথ্যচিত্রটির কয়েকটি তথ্যের বিষয়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন ব্যক্তি অতিসম্প্রতি আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি প্রকাশ করে আমাদের কিছু বিষয় জানার সুযোগ করে দিয়েছেন। ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে তথ্যচিত্রটি সরিয়ে নিতে আদালতের আদেশ জারির পরই আইনমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকেই আমরা এসব অজানা কথা জানতে পারলাম। অবশ্য, এর মধ্যে প্রথম আলোও দুটি প্রতিবেদনে অনেক তথ্য প্রকাশ করেছে, যা আলোচনার পরিধিকে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে আইন-আদালতের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি যোগসূত্র যে দুজন মন্ত্রীর, তাঁদের বক্তব্য আরও অনেক নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যেগুলো মোটেও উপেক্ষণীয় নয়। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং এর প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদার স্পর্শকাতরতা বিবেচনায় অনেকেই এ-সম্পর্কিত আলোচনা এড়িয়ে যান। বিশেষ করে ব্যক্তির সঙ্গে প্রতিষ্ঠানকে মিলিয়ে ফেলার কারণে তা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। মন্ত্রীরা এ বিষয়ে মুখ খোলায় এখন অবশ্য এই আলোচনা অনেকটাই সহজ হলো।

নতুন প্রশ্নগুলো আলোচনার আগে সংক্ষেপে তথ্যগুলো ও ঘটনাক্রম স্মরণ করা ভালো। প্রথম আলোর প্রতিবেদন দুটির তথ্য হচ্ছে, খুনের দায়ে দণ্ডিত তিন ভাইয়ের মধ্যে যে দুজন আসামি—আনিস আহমেদ ও হারিস আহমেদ—যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত হিসেবে ফেরার ছিলেন, সরকার তাঁদের দণ্ড রেয়াত দিয়েছে ২০১৯-এর ২৮ মার্চ এবং দুই বছর ধরে তা প্রকাশ করা হয়নি। এঁদের মধ্যে আবার হারিসকে দ্বিতীয় আরেকটি খুনের মামলার যাবজ্জীবন সাজা থেকেও রেয়াত দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় খুনের মামলাটির কথা প্রথম আলোর এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগপর্যন্ত বিস্ময়করভাবে এত দিন সবারই চোখের আড়ালে ছিল। দ্বিতীয় খুনের মামলায় অন্য যাঁরা আসামি ছিলেন এবং দণ্ডিত হয়েছেন, তাঁদের একজন হলেন তিন ভাইয়ের কনিষ্ঠতম তোফায়েল আহমেদ জোসেফ। প্রথম মামলাটিতে জোসেফ আপিলে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন এবং পরে রাষ্ট্রপতির অনুকম্পায় ২০১৮ সালে মুক্তি পান। দ্বিতীয় মামলায় তাঁর মৃত্যুদণ্ডের সাজার কী হয়েছে, তা এখনো অস্পষ্ট। রাষ্ট্রপতি ও সরকারের নজিরবিহীন অনুকম্পা লাভকারী এই তিন সহোদরের আরেক ভাই হলেন আমাদের সেনাপ্রধান।

এঁদের পারিবারিক এই বন্ধনের কথা সবার জানা থাকলেও সহোদরদের অপরাধী জীবনের কথা আলোচনায় তুলে আনে আল-জাজিরা, ১ ফেব্রুয়ারি। ফেরার আসামিদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের যোগাযোগ বজায় রাখার বিষয়টি ঘিরেই তারা নানা ধরনের প্রশ্ন তুলেছে। ২ ফেব্রুয়ারি সরকারের তরফে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনা সদর তথ্যচিত্রটিকে আল-জাজিরার মিথ্যাচার এবং সরকারকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা বলে নাকচ করলেও অপরাধী ভাইদের বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেয়নি। তথ্যচিত্রটি প্রচারের ৯ দিন পর ১০ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী জার্মান সম্প্রচারমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক ইংরেজি ভাষার অনুষ্ঠানে বলেন যে এখন সেনাবাহিনীতে থাকা ভাইটি যদি তাঁর ভাইদের বিচার এড়াতে সাহায্য করে থাকেন, তাহলে এই অভিযোগ খুব, খুবই বৈধ হবে। কিন্তু তারপর ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর অনুসন্ধানে অপরাধী ভ্রাতৃদ্বয়ের দণ্ড মওকুফের কথা জানা যায়।

প্রথম আলোতে ওই রিপোর্ট প্রকাশের দিনেই সেনা সদর দ্বিতীয় আরেকটি বিবৃতিতে সেনাপ্রধানের ভাইদের দণ্ড মাফের সরকারি সিদ্ধান্তের তথ্যটিও তুলে ধরা হয়। আইএসপিআরের বিবৃতিতে দাবি করা হয়, ২৯ মার্চ ২০১৯ তারিখে সেনাবাহিনীর প্রধানের ছেলের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে তার কোনো ভাই কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত বা পলাতক আসামি অবস্থায় ছিলেন না, বরং সম্পূর্ণ অব্যাহতিপ্রাপ্ত হিসেবেই তারা ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন এবং উক্ত সময়ে তাদের বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় বা চলমানও ছিল না ইতিমধ্যে যে ১৫ দিন পার হয়ে যায়, সেই সময়টিতে সরকার, সেনাবাহিনী, সেনাপ্রধানের পরিবার, সাজায় রেয়াতপ্রাপ্ত ভাইয়েরা বা তাঁদের পরিবার, ক্ষমতাসীন দল—কেউই অভিযোগগুলোর বিষয়ে মুখ খোলেননি; বরং টিভি চ্যানেল ও পত্রপত্রিকায় সরকার-সমর্থকেরা ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচার করেছেন। এরপর ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো দ্বিতীয় আরেকটি প্রতিবেদনে জানায়, হারিস ও জোসেফ মিথ্যা তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন এবং পাসপোর্টের তথ্যও একাধিকবার পরিবর্তন করেছেন। এমনকি, বাবা-মায়ের আসল নাম বদল করে তাঁরা ভুয়া পাসপোর্ট নিয়েছেন।

ওই ১৮ ফেব্রুয়ারিই ঢাকায় সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানান, নিয়ম মেনেই সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই আনিস আহমেদ ও হারিস আহমেদের সাজা মওকুফ করা হয়েছে। এর আগে তিনি প্রথম আলোকে বলেছিলেন যে এঁদের সাজা মওকুফের বিষয়ে আমি কিছু জানি না। না জেনে কিছু বলতেও পারব না। তবে তিনি এ-ও বলেন, আমাদের কাছে একজন যাবজ্জীবন সাজা মাফের আবেদন করেছিলেন। নাম মনে করতে পারছি না। মহামান্য রাষ্ট্রপতি সেই আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন। আরেকজন নিজেকে মানসিক রোগী বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এইটুকুই আমার মনে পড়ছে। পলাতক কোনো আসামি কোনো আইনগত অধিকার পেতে পারেন কি না - এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কোনো আইনগত অধিকার পলাতক আসামি পায় না। আইনগত অধিকার পেতে হলে তাকে সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করতে হয়। এই সাজা মওকুফের বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সেদিন প্রথম আলোকে বলেন, কারও সাজা মওকুফ করা হয়েছে কি না, তা আমি জানি না। এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই
পরদিন ১৯ ফেব্রুয়ারি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ডয়চে ভেলের বাংলা সাক্ষাৎকারে বলেন, দেশের আইনের বিধান মেনেই ওই দুই ভাইয়ের সাজা মাফ করা হয়েছে। প্রায় ঘণ্টা দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকারে অনেক তথ্য স্পষ্ট করায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে ধন্যবাদ। তবে নতুন যেসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, সেগুলো কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আনিসুল হকের সাক্ষাৎকারেই আমরা যেসব বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি:
১. ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ এর আওতায় সরকার তার ক্ষমতা প্রয়োগ করে সাজা মাফ করেছে, কেননা সরকারের বিবেচনায় তাঁরা রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার ভুক্তভোগী।
২. প্রস্তাবটি এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে।
৩. আইন মন্ত্রণালয় প্রস্তাবটিতে আইনগত সম্মতি দিয়েছে।
৪. সাজা মওকুফের সিদ্ধান্তের জন্য সাজা দানকারী আদালতের মতামত চাওয়া হয়নি।
৫. ফৌজদারি আইনের ৪০১ নম্বর বিধির ২ উপবিধিতে সাজা প্রদানকারী আদালতের মতামত নেওয়ার প্রশ্নে ইংরেজি মে (May) শব্দটিকে সরকার ইচ্ছাধীন হিসেবে গণ্য করেছে, বাধ্যবাধকতা হিসেবে নয়। যে কারণে সরকার মনে করেছে, আদালতের মতামত নেওয়া আবশ্যক নয়। তবে এ রকম সুবিধা অতীতে আর কেউ পেয়েছেন, এমন কোনো নজির তিনি দিতে পারেননি।
৬. সাজা মওকুফের জন্য সরকারের কাছে দণ্ডিতদের পক্ষ থেকে আবেদন করা হয়েছিল।
৭. সরকারের কাছে আবেদনটি করেছিলেন ফেরার আসামিদের মা।
৮. আসামিরা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে হাজির না হয়েই অনুকম্পা লাভ করেছেন।
৯. আইনমন্ত্রী নিজে এবং তাঁর মরহুম পিতা আইনজীবী সিরাজুল হক অতীতে এই আসামিদের কৌঁসুলি ছিলেন।
১০. দণ্ড মওকুফের প্রজ্ঞাপনটি আইনমন্ত্রী দেখেননি।
১১. ঈদ ও স্বাধীনতা দিবসের মতো বিশেষ উৎসব উপলক্ষে দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের নিয়মিত এই আইনে সরকার সাজা মওকুফ করে থাকে।
১২. আল-জাজিরা তাঁর কাছে তথ্যচিত্রে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর বিষয়ে বক্তব্য জানতে চেয়ে যে চিঠি পাঠানোর কথা বলেছে, তিনি সেই সেই চিঠি পেয়েছিলেন। তবে তার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি।

তাঁর বক্তব্যে যেসব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি:
১. আল-জাজিরার অভিযোগগুলো যতটা গুরুতর, তথ্যচিত্রটি প্রচারের আগে আইনবিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি কিংবা সরকার কেন সেগুলো খণ্ডনের বিষয়টিকে ততটা গুরুত্ব দেননি? তিনি ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সেনা সদর, পুলিশ এবং অভিযুক্তদের আল-জাজিরার জিজ্ঞাসা উপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত কি কাকতালীয়? দুই বছর আগে দণ্ডিতদের সাজা মওকুফ করা হয়ে থাকলে সেই তথ্য আল-জাজিরাকে না জানানোর ব্যাখ্যা কী? সম্মিলিত নীরবতার পর আল-জাজিরার সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে কী ফল মিলবে?
২. তথ্যচিত্রটি প্রচারের পর ১৫ তারিখ পর্যন্ত সাজা মওকুফের তথ্যটি কেন প্রকাশ করা হলো না? দেশজুড়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয়টি সম্পর্কে কেউ জানতে চায়নি বলে আইনমন্ত্রী যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হয়? ১৫ তারিখ পর্যন্ত কি তথ্যটি আইএসপিআরও জানাতে পারেনি?
৩. তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন যে প্রথম আলো ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁর যে বক্তব্য নিয়েছে, তা যথাযথভাবে প্রকাশ করেনি। তিনি ওই একই সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তিনি প্রজ্ঞাপনটি দেখেননি। প্রজ্ঞাপনটি না দেখে থাকলে সাজা মওকুফের খবরটি তিনি কীভাবে জেনেছেন? কবে জেনেছেন? সাজা মওকুফের সিদ্ধান্তটি কবেকার, তা তিনি কীভাবে নিশ্চিত হয়েছেন? প্রথম আলোতে তাঁর উদ্ধৃতি,
কারও সাজা মওকুফ করা হয়েছে কি না, তা আমি জানি না। এ বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। যথাযথ না হয়ে থাকলে উদ্ধৃতিটি প্রকাশের পর তিনি তার কোনো প্রতিবাদ জানাননি কেন?
৪. আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে দণ্ডিত ব্যক্তিরা রাজনৈতিক হয়রানির শিকার বলে তাঁর দাবি এবং তাঁদের আইনজীবী হওয়ার সুবাদে আনিস, হারিস ও জোসেফের নাম তাঁর মনে না থাকার কথা নয়। অথচ প্রথম আলোর অনুসন্ধানের জবাবে তিনি তাঁদের দণ্ড মওকুফের বিষয়টি না জানার কথা বলেছেন। ঘটনা কি তাই? নাকি বিষয়টি গোপন রাখার সিদ্ধান্ত ছিল বলে তিনি তখন তা বলেননি?
৫. তিনি যে দণ্ডিত ব্যক্তিদের আইনজীবী ছিলেন, তাঁদের দণ্ড মওকুফ করায় আইনমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অনুমোদন দেওয়া আদৌ কতটা সমীচীন হয়েছে? তা-ও যেখানে আইনের ব্যাখ্যায় সরকার নজিরবিহীন সুবিধা নিয়েছে? স্বার্থের দ্বন্দ্ব বা কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্টের যে ধারণা রয়েছে, সেটা কি আমাদের শাসনব্যবস্থায় আর কার্যকর নেই?
৬. উৎসব-পার্বণে দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দীদের মুক্তির নজির আনিস, হারিসের দণ্ড রেয়াত পাওয়ার সঙ্গে কীভাবে তুলনীয়? বন্দীরা কারাগারে থেকে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন করে থাকেন। যার মানে হচ্ছে, তাঁরা ফেরার নন এবং আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। সুতরাং আত্মসমর্পণ ছাড়া এ ধরনের আবেদন কীভাবে আইন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি বা অনুমোদন পায়?
৭. উৎসব-পার্বণে যেসব বন্দী রাষ্ট্রপতির অনুকম্পায় মুক্তি পান, তাঁদের ক্ষেত্রে অপরাধ কতটা গুরুতর ছিল, তা বিবেচনা করা হয় এবং হত্যা ও ধর্ষণের মতো অপরাধে দণ্ডিতরা এই সুযোগ পান না। ব্যতিক্রম হয় কেবল তাঁদের ক্ষেত্রে, যাঁদের সাজার সিংহভাগ খাটা হয়ে গেছে এবং কারাজীবনে তাঁদের ভালো আচরণ ও কাজের নিরিখেই তাঁরা সেই যোগ্যতা লাভ করেন। ফেরারি অবস্থায় এ রকম দণ্ড রেয়াত লাভ করেছেন, এমন কোনো নজির স্বাধীন বাংলাদেশে আছে কি?
৮. দুটি হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিতরা একই ধরনের অনুকম্পা দুবার কীভাবে পেতে পারেন? এ রকম নজির শুধু দেশে নয়, ভারতবর্ষে আর আছে কি?
৯. ২০১৮ সালের মে মাসে দণ্ডিত তিন ভাইয়ের মায়ের একটি আবেদনে তোফায়েল আহমেদ জোসেফের সাজা মওকুফ করা হয়। ঠিক ১০ মাস পর পলাতক অপর দুই সন্তানের জন্য একই মায়ের আবেদন নিঃসন্দেহে কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। একই পরিবারের তিন ভাইকে ক্ষমা করার এ রকম বিরল আবেদন বিবেচনার ক্ষেত্রে সরকার তার সিদ্ধান্তের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় নিয়েছিল কি? এটি কি ভবিষ্যতের সরকারগুলোর জন্য ক্ষমতা অপব্যবহারের নজির হয়ে থাকবে না?
১০. যে দুই মামলায় এঁরা অনুকম্পা পেলেন, সেসব মামলায় সাজাপ্রাপ্ত সহযোগীরাও কি একই সুবিধা পেয়েছেন? নাকি তাঁরা আওয়ামী লীগের কর্মী নন? তাঁদের বেলায় মামলাটি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক ছিল না?

এখানে স্মরণ করা প্রয়োজন, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মন্ত্রিসভা রাজনৈতিক হয়রানির মামলা অভিহিত করে দলীয় নেতা-কর্মীদের মামলাগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলামের নেতৃত্বে এ ধরনের মামলাগুলো বাছাইয়ের একটি কমিটিও হয়েছিল এবং সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৩ সালে সাত হাজারের বেশি মামলায় মোট এক লাখের বেশি ব্যক্তিকে কথিত রাজনৈতিক হয়রানির মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল (রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক বিবেচনায় মামলা প্রত্যাহারের সুপারিশ, বিবিসি বাংলা, ২২ আগস্ট, ২০১৩)। তখন জোসেফের মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন ছিল এবং ২০১৫ সালে আপিল বিভাগ তাঁর সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এ কেমন রাজনৈতিক হয়রানির মামলা যে সাত হাজারের বেশি মামলার মধ্যেও তা স্থান পায়নি?

অপরাধী দুই ভাই হারিস এবং জোসেফ যে ভুয়া পরিচয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট নিয়েছেন, তা-ও দেশের প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন এবং শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ। প্রথম আলোর প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী তোফায়েল আহমেদ জোসেফ কারাবন্দী থাকা অবস্থায় ভুয়া পাসপোর্ট করিয়েছেন। আর হারিস আহমেদ ভুয়া পাসপোর্ট করিয়েছেন ফেরার অবস্থায় এবং তাঁরা দুজনেই পাসপোর্টে ছবি ও ঠিকানা পরিবর্তন করিয়েছেন। পাসপোর্ট অধিদপ্তর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। পাসপোর্ট আইনে আছে কমপক্ষে দুই বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত কোনো ব্যক্তি পাঁচ বছরের মধ্যে পাসপোর্ট পেতে পারেন না। কিন্তু এঁরা জেলে বসে এবং ফেরার অবস্থাতেও পাসপোর্ট পেয়েছেন। আইনে আছে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনে আরও আছে, মিথ্যা তথ্য দিয়ে নেওয়া পাসপোর্ট বাতিল হবে। পাসপোর্ট অধিদপ্তর বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেউই এ পর্যন্ত এই অপরাধের বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি এবং কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানায়নি। আমরা কি প্রশ্ন করতে পারি না, এই অপরাধকে কেন প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর বুঝতে কারও কষ্ট হয় না। বিশেষ ব্যক্তির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা।

সেনা সদরের বিবৃতি এবং সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বক্তব্যে দাবি করা হয়েছে যে সরকারের অনুকম্পা ঘোষণার কারণে তাঁর ভাইয়েরা অব্যাহতিপ্রাপ্ত। দুঃখজনক সত্য হচ্ছে, এই বক্তব্য মোটেও আইনসম্মত নয়। সাজাপ্রাপ্ত কাউকে অব্যাহতি দেওয়ার আইনগত কর্তৃত্ব একমাত্র আদালতের। আদালতে দণ্ডিত ব্যক্তিকে অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতির ক্ষমতা সংবিধান রাষ্ট্রপতিকেও দেয়নি। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ বলছে, কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।এখানে দায়মুক্তি দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই।

আপন সহোদরের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করা যে অসম্ভব, সেটা সবাই বোঝেন। কিন্তু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকলে তাঁর কাছে স্বভাবতই প্রত্যাশা করা হয় যে তিনি অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবেন। ভাইদের সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্ন উঠেছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনীর নয়। সারা বিশ্বে শান্তিরক্ষার কাজে পেশাদারি ও দক্ষতার মাধ্যমে সেনাবাহিনী যে সুনাম ও মর্যাদা অর্জন করেছে, তা যে ঝুঁকির মুখে পড়ছে না, সে কথা কি আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি?

এই ঝুঁকির দ্রুত নিরসন হওয়া প্রয়োজন। মন্ত্রীদের ব্যাখ্যা ও সেনা সদরের ভাষ্য এ পর্যন্ত যা এসেছে, তাতে তথ্যগত ঘাটতি ও অপূর্ণতা রয়ে গেছে। ফলে সংশয় আরও বাড়ছে। এসব সংশয় দূর করতে সরকার অচিরেই উদ্যোগী হবে, সেটাই সবার প্রত্যাশা।

(২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১‘র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...