বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুর্বণজয়ন্তীর বছরে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাম হিসাবে বিনা বিচারে বন্দী লেখক মুশতাক আহমেদ প্রাণ দিয়েছেন। স্বাধীন দেশে পাঁচ দশক পরেও যদি ব্যক্তি স্বাধীনতার জন্য কোনো নাগরিককে এ রকম চরম মূল্য দিতে হয়, তাহলে তার রাজনৈতিক এবং আইনি ব্যাখ্যা কী? যাঁরা রাষ্ট্র চালান তাঁরা রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি রক্ষার কারণ দেখিয়ে মুশতাককে গ্রেপ্তার করেছিলেন। মুশতাকের জন্য আদালতে ছয়বার জামিনের আবেদন হয়েছে। হয়তো রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির প্রশ্নেই তাঁর জামিন মেলেনি। ফেসবুকে মতপ্রকাশের কারণে বন্দীদশায় মুশতাকের মৃত্যুতে সেই রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কি রক্ষা পেয়েছে? না-কি কথিত ভাবমূর্তি লজ্জা আর গ্লানিতে তলিয়ে যাচ্ছে?
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, মুশতাক আহমেদ একজন লেখক এবং সাহসী উদ্যোক্তা। ক্যাডেট কলেজের পর বিদেশেও পড়াশোনা করেছেন এবং দেশে ফিরে চা বাগানে চায়ের গাছ লাগানো ও পরিচর্যার কাজ করেছেন। ব্যতিক্রমী উদ্যোক্তা হিসাবে কুমির চাষও করেছেন। চা বাগান এবং কুমির চাষের অভিজ্ঞতা নিয়ে দুটি বই লিখেছেন। এসব লেখায় রাজনৈতিক কোনো মতবাদ বা হুমকি সৃষ্টির মতো কাজকর্মের কোনো অতীতের সন্ধান মেলে না। তবে, সামাজিক মাধ্যমে আরও লাখ লাখ মানুষের মতো তিনি নানা বিষয়ে মতপ্রকাশ করেছেন। ফেসবুকে তাঁর পাতায় এমন কিছুই নেই, যা অন্যরা বলেন নি বা বলেন না। পরিচিত বন্ধুদের নিয়ে গ্রুপ করে সেখানে নিজেদের মধ্যে মতবিনিময়ও করেছেন। মামলার এজাহারেও ফেসবুকের মতপ্রকাশের অভিযোগই আনা হয়েছে।
মুশতাক ছাড়াও রমনা থানার মামলাটিতে অন্য আসামিরা হলেন কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, রাষ্ট্রচিন্তা নামের একটি সংগঠনের সদস্য দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান, তাসনিম খলিল, সায়ের জুলকারনাইন, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ, সাহেদ আলম ও আসিফ মহিউদ্দিন। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৫/৬জন আসামি। এজাহারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১, ২৫(১), ৩১ ও ৩৫ নম্বর ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারে অভিযোগ: এঁরা ফেসবুকের বিভিন্ন একাউন্ট ব্যবহার করে জাতির জনক, মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহামারী করোনা ভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্রের/সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষণ্ন করিবার অভিপ্রায়ে অপপ্রচার বা বিভ্রান্তি মিথ্যা বলে জ্ঞাত সত্ত্বেও গুজবসহ উপরোক্ত তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল করার উদ্দেশ্যে সর্ম্পূণ আকারে প্রকাশ বা প্রচার করে রাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অপরাধ করেছেন।
এজাহারে কিন্তু এঁদেরকে গুজব রচনাকারী বলা হয়নি, বরং তা মিথ্যা জেনেও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারের অভিযোগ আনা হয়েছে এবং এর পিছনে রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিপ্রায়ের কথা বলা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে চারটি ধারায় মামলা করা হয়েছে, সেগুলো অজামিনযোগ্য। একারণে ধারণা করা অন্যায় হবে না যে যদি কেউ গুজবের জন্ম দিয়েও থাকে, তাহলেও গুজব সৃষ্টিকারীদের ধরা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর লক্ষ্য ছিল না। একইভাবে, এটিও যৌক্তিকভাবে অনুমান করা চলে যে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তাঁদের একধরণের শিক্ষা দেওয়ার মানসে অজামিনযোগ্য ধারাগুলোই বেছে নেওয়া হয়েছে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, যাঁরা রাজনৈতিকভাবে সরকারের প্রতিপক্ষ নন, তাঁদের বিরুদ্ধে কেন এমন গুরুতর পদক্ষেপ? নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্র ক্ষমতাধর বিশেষ গোষ্ঠী ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করেছে কিনা এমন প্রশ্নও উত্থাপন করেছেন।
অনেকেই আশংকা প্রকাশ করেছেন বন্দী অবস্থায় এঁদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। এঁরা জানিয়েছেন যে কার্টুনিস্ট কিশোরের কানের পর্দা ফেটে গেছে এবং পায়ে আঘাতের কারণে তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেছন না। তাঁর ডায়াবেটিস অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় চিকিৎসা মেলেনি। কিশোরের জীবনরক্ষার আশংকাও তাই কম উদ্বেগের বিষয় নয়।
শিগগিরই যে এসব রহস্যের জট খুলবে এমন সম্ভাবনা দেখি না। তবে, এই মামলায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভয়াবহতা কতটা ব্যাপক তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। আর দশটা আইনের অপব্যবহারের চেয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহারের বিপদটা প্রকটভাবে উঠে আসে জামিনের বিধানগুলোতে। একইধরণের মামলায় ভারতে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ডিজিটাল মাধ্যমে সরকারবিরোধী বক্তব্যের জন্য আটক ২২ বছরের তরুণী দিশাকে দিল্লির হাইকোর্ট গেল সপ্তাহে জামিন দিয়েছেন। সেই জামিনের আদেশে আদালত বলেছেন, জামিন প্রত্যেকের অধিকার এবং তা ব্যতিক্রমী অপরাধ ও ঝুঁকি ছাড়া প্রত্যাখ্যান করা যায় না। ওই আদালত আরও বলেছেন , সরকারের সমালোচনা করা নাগরিকদের অধিকার এবং মতপ্রকাশের অধিকার চর্চা অপরাধ নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারায় মুশতাক ও অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছিল, এগুলো চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী। আইনের ২৫(১)(খ) ধারায় রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির সংজ্ঞা কী? ১০ মাস জামিন না দিয়ে এবং বিনাবিচারে জেলে রাষ্ট্রীয় হেফাজতে একজন নাগরিকের মৃত্যুতে কি রাষ্ট্রের মর্যাদা বেড়েছে? এজাহারে রাষ্ট্র/ সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগ আনা হয়েছে। রাষ্ট্র এবং সরকারকে এককাকার করে দেখানোর উদ্দেশ্যটা যে অসৎ, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে আমরা কেন নিবর্তনমূলক বা কালো আইন বলছি, তা নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। শুধু পরিসংখ্যানগুলো দেখলেই তা পরিষ্কার হয়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা আর্টিকেল ১৯-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশে এ আইনের অধীনে দায়ের করা হয়েছে মোট ১৯৮টি মামলা। আসামি করা হয়েছে ৪৫৭ ব্যক্তিকে। ৪১টি মামলার আসামি করা হয়েছে ৭৫ জন পেশাদার সাংবাদিককে। তার আগের বছর, ২০১৯ সালে এ আইনের অধীনে দায়ের করা মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৬৩টি। সংবাদপত্রের পাতায় খবর হয়নি, এমন মামলা যে আরও আছে এবং তার সংখ্যাও যে কম নয়, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।
২০১৮ সালে আইনটি তৈরির সময়ে এবং তারও আগে এর পূর্বরূপ, তথ্যপ্রযুক্তি আইন বাতিলের দাবির সময়ে এধরণের আইনে নিবর্তনমূলক বিধিবিধানগুলো পরিহারের জন্য সরকারের কাছে অনেক দেন-দরবার করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে আইনমন্ত্রী সম্পাদক পরিষদকে বলেছিলেন, নির্বাচনের পর আইনটি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হবে। সেই পর্যালোচনা হয়নি, পরিবর্তন তো দূরের কথা। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভি জার্মান টিভি ডয়েচে ভেলের সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন ডিজিটাল আইনে কিছু দূর্বলতা রয়ে গেছে। তবে, তা সংশোধনে কী করা হবে, তা বলেন নি।
মুশতাকের মৃত্যুর জন্য রাষ্ট্রকে দায়ী করেছেন অনেকেই। এঁদের মধ্যে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের একজন সাবেক চেয়ারম্যানও আছেন, যিনি নিজেও জাতীয় ওই প্রতিষ্ঠানটির ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত। পুলিশের এজাহারে যেভাবে রাষ্ট্র এবং সরকারকে একাকার করে দেখানো হয়েছে, এই মূল্যায়নও সেরকমই। অনেক কর্তৃত্ববাদী দেশেও মানবাধিকার কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠান জনগণের আস্থা
অর্জনে সচেষ্ট হয়ে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু, হতাশার কথা হলো, আমাদের মানবাধিকার কমিশনকে যেভাবে সরকারের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয়েছে, তাতে হেফাজতে মৃত্যুর দায় তাঁরাও এড়াতে পারেন না।
(২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন