কয়েকদিন ধরে সামাজিক গণমাধ্যম এবং মূল ধারার মাধ্যমে অনেককেই দেখা যাচ্ছে, তাঁরা প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন এটা প্রমাণ করার, আমরা প্রধানমন্ত্রীর লোক। কেউ করছেন ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিতে একটি ফ্রেম ব্যবহার করে যাতে লেখা আছে ‘উই আর প্রাইম মিনিস্টারস মেন‘। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বিভিন্ন পেশার লোক এভাবে ঘোষণা দিয়ে প্রমাণ করতে চাইছেন যে তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর লোক। দলীয়ভাবে ঘোষিত কোনো কর্মসূচির অংশ হিসাবে যে এমনটি করা হচ্ছে, তা নয়। আল-জাজিরার বিতর্কিত তথ্যচিত্র ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন‘ এর জবাবে যে এটি করা হচ্ছে, তা বুঝতে কষ্ট হয় না।
বিষয়টা
শুধু ব্যাক্তিগত পর্যায়ে থেমে নেই। আওয়ামী লীগ কিম্বা সরকার না বললেও দলটির সমর্থক
পেশাজীবি সংগঠনগুলোও স্বতর্স্ফূতভাবে নিজেদের আনুগত্য প্রমাণে উৎসাহী হয়ে উঠেছে।
বিস্ময়করভাবে সাংবাদিকদের একটি সংগঠন বৈশ্বিক একটি সংবাদমাধ্যমকে নিষিদ্ধ করার
দাবিও জানিয়েছে। অন্যান্য পেশার সংগঠন ও সুপরিচিত নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা একইরকম
দাবি বা নিন্দা জানিয়েছেন, তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা আমার উদ্দেশ্য নয়।
বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা আল-জাজিরার তথ্যচিত্রটির ভালো-মন্দ কিম্বা সাংবাদিকতার
দোষত্রুটি অথবা গুণমান বিশ্লেষণও আমার লক্ষ্য নয়। সরকার যদি মামলা করে, তাহলে
আদালতে কোনপক্ষ কী কী নথিপত্র ও স্বাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করে, তা থেকে অনেক কিছুই
বোঝা যাবে। যদিও তথ্যচিত্রটি সম্প্রচারের আগে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ উপেক্ষার
কারণে প্রতিকার পাওয়া কঠিন। এধরণের মামলা তো আর্ন্তজাতিক আদালতের বিষয নয়, এর জায়গা
হচ্ছে আল-জাজিরা যেখানে কাজ করে সেখানকার এখতিয়ারসম্পন্ন আদালতের। সুতরাং ধারণা
করি, হয় দোহা, নয়তো লন্ডনের আদালতেই আইনী লড়াই হবে। ওই দুই শহরেই তাদের মূল
কার্যালয় বলে ওয়েবসাইটে বলা আছে।
বিস্ময়ের
বিষয় বরং আল-জাজিরাকে নিষিদ্ধ করার দাবি। কেননা, দাবিটি এসেছে কয়েকজন সাংবাদিক
নেতার পক্ষ থেকে। সরকার যে তথ্যচিত্রের সম্প্রচার বন্ধ করে নি এবং বন্ধ করলে তা
ভুল হতো বলে যখন মোটামুটি একটা ঐকমত্য দেখা গেল, তখন এধরণের দাবি তুলে সাংবাদিক নেতারা
কী নজির তৈরি করলেন? সাংবাদিকতার কোন নীতিমালায় কন্ঠরোধ সমর্থন করে? বিতর্কিত বা
ভূল তথ্য প্রকাশ কিম্বা কথিত অপপ্রচার অথবা ভাবমূর্তি নষ্টের অভিযোগ বা অজুহাত -
এসবের কোনকিছুই সংবাদমাধ্যমের কন্ঠরোধের কারণ হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
ভুল
তথ্যের জবাব হচ্ছে সঠিক তথ্য প্রকাশ। আর, অপপ্রচার থেকে বাঁচা বা ভাবমূর্তি
পুনরুদ্ধারের উপায়ও আসল সত্য তুলে ধরা। ভিন্নমতের জবাবও পাল্টা যুক্তিতে। সরকারকে
সেই সুপরামর্শ না দিয়ে যে পথটি
অনুসরণে উৎসাহিত করা হলো, তা কার্যত ফ্যাসিবাদের পথে পরিচালিত করার শামিল। সবার
কথা বলার অধিকার ততক্ষণ, যতক্ষণ তা আমার পছন্দ হবে - এমন মানসিকতা শুধু গণতন্ত্রের
পরিপন্থী নয়, বরং তা স্বৈরতান্ত্রিক।
সরকারের
পক্ষ থেকে এই তথ্যচিত্রের বিষয়ে একসপ্তাহেও কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা আসে নি।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক তত্ত্ব ছাড়া
আর কিছু ছিল না। পরে, অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন ‘বিশ্বাসযোগ্য তথ্যগুলো‘ তদন্ত করে দেখা হবে এবং
সরকার মামলা করবে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাদের একজন, গওহর রিজভি, যিনি বছর কয়েক
আগে আল-জাজিরার ‘হেড টু হেড‘ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন,
তিনিও বলেছেন, ‘তদন্ত হতে হবে। তাহলেই
জানা যাবে, কী হয়েছে‘।
তিনি অবশ্য একথাও বলেছেন, ‘কোনো তথ্যপ্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এই প্রতিবেদন করা হয়নি। এটা করা
হয়েছে সমালোচনা করার জন্য, হেয় করার জন্য। প্রতিবেদনটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর ওপর
আক্রমণ‘। কূটনীতি ও আর্ন্তজাতিক রীতিনীতির বিষয়ে অভিজ্ঞ রাজনীতিকরা যখন
তথ্যচিত্রটির তথ্যগুলো নাকচ করার পরও তদন্তের কথা বলছেন, তখন সবারই উচিত হবে তদন্তটিকে
কিভাবে সুষ্ঠূ ও স্বচ্ছ্ব করে তোলা যায়, যাতে তা বিশ্বাসযোগ্যতা পায়, সেদিকে
মনোযোগী হওয়া। স্পর্শকাতরতার অজুহাতে এধরণের গুরুতর অভিযোগের তদন্তে যে কোনোধরণের
অস্বচ্ছ্বতা বরং বিতর্ক বাড়াবে।
টেলিভিশন এবং অনলাইনের কল্যাণে কোটি কোটি মানুষ তথ্যচিত্রটি
দেখেছেন এবং এর কোনো তথ্যই আর গোপন নেই। উপরন্তু তথ্যচিত্রটিকে কেন্দ্র করে যেসব
বিতর্কের জন্ম হয়েছে, তার দুটো খন্ডিত ব্যাখ্যা এসেছে পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের একটি
বিবৃতি এবং সেনা সদরের পক্ষ থেকে আইএসপিআরের ব্যাখ্যায়। এই পটভূমিতে বিতর্কিত
বিষয়গুলো নিয়ে কিছুটা আলোচনা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। পুলিশ অ্যাসেসিয়েশন
পুলিশবাহিনীতে নিয়োগ, বদলি ও পদায়নের বিষয়ে বাইরের প্রভাব খাটানো ও দূর্নীতির
অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক, কমিশনার ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাফাই
দিয়েছে। এসব অভিযোগ যে দন্ডিত ও পলাতক আসামীর সূত্রে তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে, ওই একই
ব্যক্তির মুখে আরও অনেক গুরুতর অভিযোগের কথা শোনা গেছে। কিন্তু, পুলিশ
অ্যাসোসিয়শনের খন্ডিত বক্তব্যে সব প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। মিথ্যা পরিচয়ে পাসপোর্ট ইস্যু, ইমিগ্রেশনের
বেড়া গলিয়ে দন্ডিত পলাতক আসামীদের দেশে ঢোকার মত অভিযোগের কোনো জবাব এতে নেই। অপরাধজগতের
প্রতিদ্বন্দীর টেলিফোনের অবস্থান অনুসন্ধান করে তাঁকে গ্রেফতার করানোর কৃতিত্ব
দাবির বিষয়টি মোটেও উপেক্ষণীয় নয়।
আইএসপিআরের বিবৃতিতে অবশ্য ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র ও প্রযুক্তি কেনার
ব্যাখ্যার চেষ্টা ছিল। কিন্তু, জাতিসংঘের মুখপাত্রের ব্যাখ্যায় যে নতুন প্রশ্নের
জন্ম হয়েছে, সেবিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা মিলছে না। বাংলাদেশি সেনাদলের জাতিসংঘের
শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ওইধরণের সরঞ্জাম ব্যবহারের সুযোগ কোনো চুক্তিতে ছিল না বলে
যে তথ্য জাতিসংঘ মুখপাত্র দিয়েছেন, তার কোনো ব্যাতিক্রম ঘটে থাকলে তা-ও স্পষ্ট করা
হবে বলে আশা করা হচ্ছিলো। কিন্তু, গণমাধ্যমে শুধু জাতিসংঘের মুখপাত্রের বক্তব্য
এবং তার প্রতিক্রিয়ায় পাওয়া গেল অর্ধডজন
মানবাধিকার সংগঠনের বিবৃতি, যাতে তারা জাতিসংঘের তদন্ত ও পর্যালোচনা দাবি করেছে।
অবাধ তথ্যপ্রবাহে অঘোষিত ও অদৃশ্য বাধার বিষয়টি নিয়ে অনেক আলোচনাই হয়েছে। বিশেষত: ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার দেশে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে যে ভয়ের আবহ তৈরি করেছে, তার কারণে। পরিসংখ্যান বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দেশে কম করে হলেও অর্ধশতাধিক সাংবাদিকের নামে মামলা আছে। মারধোর এবং হামলা তো প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। গুম হওয়ার ঘটনাও আছে এবং জীবিত ফিরে আসার পর হয়রানির উদ্দেশ্যে জেলে আটক রাখার নজিরগুলো খুবই পীড়াদায়ক। এরকম প্রতিকূল পরিবেশের কারণেই বিপুলসংখ্যক মানুষ তথ্যচিত্রটি দেখলেও আলোচনা হচ্ছে তার মূল বিষয়বস্তু উহ্য রেখে খন্ডিত তথ্য অথবা প্রান্তিক বিষয় নিয়ে। এরকম গুরুতর অভিযোগকে কেন্দ্র করে রাজনীতি হবে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সুবিধা নিতে চাইবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, বিরোধী রাজনীতির বর্তমানে যে দীনতা, তাতে সেরকম কিছু ঘটছে না। কিন্তু, তারপরও প্রাধান্য পাচ্ছে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আলোচনা।
দমবন্ধ
হওয়ার উপক্রম হলে মানুষ মুক্ত বাতাস সন্ধান করে, কপাট বন্ধ করে না। পেশাদার
সাংবাদিকদের তাই বিধিনিষেধ প্রত্যাহারের কথা বলা দরকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নিবর্তনমূলক
বিধানগুলো বিলোপের জন্য সোচ্চার হওয়া প্রয়োজন। আর, প্রয়োজন সম্পাদকীয় স্বাধীনতার
কথা বলা। শুক্রবার সরকারের ঘনিষ্ঠ একাত্তর টিভির টকশোয় যেমনটি বলেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের
প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী। তাঁর কথার সারমর্ম ছিল, সংবাদমাদ্যমের
বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হওয়া এবং মতপ্রকাশে মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমমুখী
হওয়ার মূল কারণ ‘টেলিভিশন মালিকরা
সম্পাদকীয় দায়িত্বে থাকলে এমনই হবে‘ ( বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরে খবরের
শিরোনাম থেকে নেওয়া)। কেননা, তাঁর কথায় এঁরা ৯৫ ভাগ সময় কাটান প্রধানমন্ত্রীর
দপ্তরে, কিংবা সচিবালয়ে বা অন্য কোনো অফিসে নিজেদের ব্যবসার তদবিরে।
(১০
ফেব্রুয়ারি, ২০২১-র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন