খেলার মাঠে পাকিস্তানের পতাকার আবির্ভাব নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে যথেষ্ট উত্তেজনা ছড়িয়েছে। মাঠ ও মাঠের বাইরে এই বিতর্কে আবেগই সবচেয়ে বড় উপাদান। বাংলাদেশের মাঠে যখন বাংলাদেশ খেলছে, তখন তার প্রতিপক্ষকে কোনো বাংলাদেশি সমর্থন করতে পারে, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। বিষয়টি নিন্দনীয়। তবে পাকিস্তানি নাগরিক কেউ যদি কাজটি করেন, সেটা নিয়ে উত্তেজিত হওয়া অযৌক্তিক।
আন্তর্জাতিক খেলাধুলার বেলায় অতিথি দলের সমর্থকদের কিছু স্বীকৃত অধিকার আছে এবং সেগুলো না মানার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এর আগেও বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক হিসেবে বেশ কিছু ম্যাচের আয়োজন করেছিল, যেসব খেলার সময় প্রতিযোগী দেশের নাগরিকেরা এসে তাদের নিজ নিজ দেশের পতাকা উড়িয়ে তাদের দলকে সমর্থন করে গেছে। দ্বিপক্ষীয় সফরেও এমনটিই হয়েছে। কিন্তু কখনো বিতর্ক এতটা ব্যাপকতা পায়নি।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই পতাকা বিতর্কের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রিকেট বোর্ডের বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল তুঙ্গে। মূল সমালোচনা ছিল পাকিস্তান কি দারাজের বিরুদ্ধে খেলছে? নাকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে? কারণ হচ্ছে, সেই মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনের মতো জার্সিতে দেশ ঢেকে যায় স্পনসরের নামে। ক্রিকেট বোর্ডের যে টাকা দরকার, সে কথা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু তাদের অনুপাতবোধ যে লোপ পেয়েছে, অথবা যাদের আদতে তা ছিল না, তারাই যে বোর্ডের কর্তৃত্ব দখল করে বসে আছে, সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। তুলনার জন্য পাকিস্তানিদের জার্সি পাশাপাশি দেখলে লজ্জাই পেতে হয়।
পাকিস্তান দলের সফর নিয়ে অনেক কথাই উঠেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে খেলার সূচি কেন ঠিক করা হলো—এমন কথাও অনেকে তুলেছেন। যদিও আন্তর্জাতিক সফরসূচি ঠিক হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল, আইসিসির সভায়, তবু স্বাগতিক দেশের সুবিধা-অসুবিধা যে বিবেচিত হয় না, তা নয়। সব মিলিয়ে আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ দর্শক ও সমর্থকদের মধ্যে প্রশ্ন ও ক্ষোভ অনেক।
সমর্থকদের ক্ষোভের চেয়ে ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতির ক্ষোভ কোনো অংশেই কম নয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান ছিলেন যিনি, যাঁর সময় টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ, সেই সাবের হোসেন চৌধুরী টি টোয়েন্টির পর টুইট করে বলেছিলেন, ‘এটা দুঃখজনক যে আমাদের একটা নির্লজ্জ ক্রিকেট বোর্ড আছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘জনাব পাপনের (নাজমুল হাসান) অধীনে বাংলাদেশ এই নিয়ে ৪টি বিশ্বকাপ খেলে ফেলল। পারফরম্যান্স খারাপ থেকে সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। অন্যের ওপর দোষ চাপাতে চাপাতে তিনি (নাজমুল হাসান) আমাদের ক্রিকেটকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন।’
সাধারণ সমর্থকদের ক্ষোভের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বোর্ডের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজে লাগানো। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রচারে ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ এবং ওডিআই টিমের সাবেক অধিনায়কের বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি থাকা (চাকরিরত) অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন নেওয়া ও নির্বাচন করায় জনমনে ধারণা জন্মায়, ক্রিকেটকে দলীয়করণ করা হচ্ছে। ক্রিকেট বোর্ডের সাম্প্রতিক নির্বাচন সেই ধারণাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে নানা ধরনের অনিয়ম ও শৃঙ্খলায় ঘাটতির বিষয়গুলোও দৃষ্টিকটুভাবে ক্রিকেটকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঘরোয়া লিগে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগের মতো ইস্যুতে ক্রিকেটের কর্তাদের জবাবদিহির কোনো আলামত মেলেনি। সময়ে সময়ে ক্রিকেটারদের বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যাতে ইঙ্গিত মেলে বোর্ড কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্রিকেটারদের হুমকি-ধমকি দিয়ে নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও পেশাদারত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এগুলো যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
২
ক্ষমতার অপব্যবহার এবং হুমকি-ধমকির মতো আচার যে এ ধরনের পেশাদার খেলাধুলার কতটা ক্ষতি করে, তার সর্বসাম্প্রতিক নজির হচ্ছে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট। দেশটিতে ক্রিকেট নিয়ে যে তোলপাড় চলছে, তা নজিরবিহীন। প্রায় দুই দশক আগে যখন ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম ক্রিকেটার নাসের হুসেইন, তখন কেউ কল্পনাও করেননি যে ক্রিকেটে বর্ণবাদ ও বৈষম্য কী ধরনের সুপ্ত ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে মন্টি পানেসার, রবি বোপারা, মঈন আলী ও আদিল রশিদের মতো দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত ক্রিকেটাররা ইংল্যান্ডের হয়ে যখন তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, তখন তাঁরাও কেউ বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলেননি। কিন্তু ক্রিকেটার আজিম রফিক তাঁর ভোগান্তি ও অপমানের কথা প্রকাশ করার পর থেকে বর্ণবাদের বিষয়টি পুরো ব্রিটিশ সমাজের বর্ণবাদ, ইসলামভীতি ও বিভাজনের প্রশ্নে অনেক বড় বিতর্কের সূচনা করেছে। আজিম রফিক যে জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, তা যে একটি অমানবিক উপহাস, সে কথা এখন সবাই স্বীকার করছেন।ইয়র্কশায়ার কাউন্টি ক্লাবে আজিম রফিক তাঁর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার পরও ক্লাব কর্মকর্তারা প্রথমে তা গায়ে মাখেননি। পরে একটা তদন্ত করালেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গণমাধ্যমে এ অভিযোগ প্রকাশ পাওয়ার পর রাজনীতিকেরা বিষয়টি আর উপেক্ষা করতে পারেননি। ১৬ নভেম্বর পার্লামেন্টের ডিজিটাল, সংস্কৃতি, মিডিয়া ও খেলাধুলাবিষয়ক স্থায়ী কমিটি এক শুনানি গ্রহণ করে, যেখানে আজিম রফিক অভিযোগ করেন যে পুরো ইংলিশ ক্রিকেটই ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্ণবাদী’। ইয়র্কশায়ার ক্লাবের তদন্তে ইংল্যান্ড ও ওয়েলশ ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পরিণতিতেই বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ সামনে চলে আসে।
ইসিবি অবশেষে স্বীকার করে নেয় যে বর্ণবাদ ও বৈষম্য তাদের খেলার জন্য একটি কলঙ্কের বিষয় হয়ে আছে এবং তারা নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চেয়েছে। জরুরি এক বৈঠকের পরে একটি বিবৃতিতে তারা বলেছে, আজিম রফিক আমাদের খেলার যেদিক তুলে ধরেছেন, তা তাদের সবাইকে হতবাক, লজ্জিত ও দুঃখিত করেছে।
ক্রিকেটে বর্ণবাদ কেলেঙ্কারির পটভূমিতে ৯ নভেম্বর ইন্ডিপেনডেন্ট কমিশন ফর ইকুইটি ইন ক্রিকেট, আইসিইসি বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের সম্ভাব্য শিকার ভুক্তভোগীদের প্রমাণসহ এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়। ব্রিটিশ গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায় যে মাত্র দিন দশেকের মধ্যেই এক হাজারেরও বেশি লোক কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এ ছাড়া কিছু ভয়াবহ পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। যাতে দেখা যাচ্ছে, ইংল্যান্ডে, তৃণমূল পর্যায়ে ক্রিকেটে ব্রিটিশ-এশীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের হার হচ্ছে ৩০ শতাংশ। অথচ পেশাদার স্তরে তাদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৪ শতাংশ। আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, শীর্ষ স্তরের ক্রিকেটারদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সাবেক ক্রিকেটারদের পরিবারের সদস্য, যা সমালোচকদের মতে প্রতিভার পরিবর্তে খেলায় অভিজাত গোষ্ঠীর প্রাধান্য বজায় রাখার প্রমাণ। নাসের হুসেইন এখন বলছেন যে বর্ণবাদের সমস্যাটি ইয়র্কশায়ারের চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। ডেইলি মেইল পত্রিকায় অতীতের নীরবতার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, ‘এটি করা হয়নি, কারণ তা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর মতে, ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়েছে এটা মানতে যে এগুলোর সঙ্গে তাদের মানিয়ে নিতে হবে এবং মেনে চলতে হবে।
৩
বর্ণবাদ নিয়ে ইংলিশ ক্রিকেটে চলমান ঝড়ে প্রমাণিত হয়েছে ক্রিকেটাররা নিগৃহীত হলেও তাঁদের অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা এবং জায়গা ছিল না। ক্রিকেটের ক্ষমতাধর কর্তাদের জবাবদিহির অভাব ছিল প্রকট। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের দেশে বর্ণবাদের লেশমাত্র নেই। কিন্তু ক্রিকেট কর্তাদের যে কোনো জবাবদিহি নেই, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ক্রিকেটারদের প্রকাশ্যে হেয় করা এবং রাজনৈতিক দলীয়করণের অভিযোগ কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। নতুন ক্রিকেটার তৈরিতে ব্যর্থতারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরাও কি ইংল্যান্ডের মতো বড় কোনো ঝড়ের জন্য অপেক্ষায় থাকব?
আন্তর্জাতিক খেলাধুলার বেলায় অতিথি দলের সমর্থকদের কিছু স্বীকৃত অধিকার আছে এবং সেগুলো না মানার কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশ এর আগেও বিশ্বকাপের সহ-আয়োজক হিসেবে বেশ কিছু ম্যাচের আয়োজন করেছিল, যেসব খেলার সময় প্রতিযোগী দেশের নাগরিকেরা এসে তাদের নিজ নিজ দেশের পতাকা উড়িয়ে তাদের দলকে সমর্থন করে গেছে। দ্বিপক্ষীয় সফরেও এমনটিই হয়েছে। কিন্তু কখনো বিতর্ক এতটা ব্যাপকতা পায়নি।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, এই পতাকা বিতর্কের আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রিকেট বোর্ডের বিরুদ্ধে সমালোচনা ছিল তুঙ্গে। মূল সমালোচনা ছিল পাকিস্তান কি দারাজের বিরুদ্ধে খেলছে? নাকি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে? কারণ হচ্ছে, সেই মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনের মতো জার্সিতে দেশ ঢেকে যায় স্পনসরের নামে। ক্রিকেট বোর্ডের যে টাকা দরকার, সে কথা কেউ অস্বীকার করছে না। কিন্তু তাদের অনুপাতবোধ যে লোপ পেয়েছে, অথবা যাদের আদতে তা ছিল না, তারাই যে বোর্ডের কর্তৃত্ব দখল করে বসে আছে, সেটা মেনে নেওয়া কঠিন। তুলনার জন্য পাকিস্তানিদের জার্সি পাশাপাশি দেখলে লজ্জাই পেতে হয়।
পাকিস্তান দলের সফর নিয়ে অনেক কথাই উঠেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে খেলার সূচি কেন ঠিক করা হলো—এমন কথাও অনেকে তুলেছেন। যদিও আন্তর্জাতিক সফরসূচি ঠিক হয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল, আইসিসির সভায়, তবু স্বাগতিক দেশের সুবিধা-অসুবিধা যে বিবেচিত হয় না, তা নয়। সব মিলিয়ে আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের ভূমিকা নিয়ে সাধারণ দর্শক ও সমর্থকদের মধ্যে প্রশ্ন ও ক্ষোভ অনেক।
সমর্থকদের ক্ষোভের চেয়ে ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক সভাপতির ক্ষোভ কোনো অংশেই কম নয়। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান ছিলেন যিনি, যাঁর সময় টেস্ট মর্যাদা পেয়েছে বাংলাদেশ, সেই সাবের হোসেন চৌধুরী টি টোয়েন্টির পর টুইট করে বলেছিলেন, ‘এটা দুঃখজনক যে আমাদের একটা নির্লজ্জ ক্রিকেট বোর্ড আছে।’ তিনি লিখেছেন, ‘জনাব পাপনের (নাজমুল হাসান) অধীনে বাংলাদেশ এই নিয়ে ৪টি বিশ্বকাপ খেলে ফেলল। পারফরম্যান্স খারাপ থেকে সবচেয়ে খারাপ হয়েছে। অন্যের ওপর দোষ চাপাতে চাপাতে তিনি (নাজমুল হাসান) আমাদের ক্রিকেটকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন।’
সাধারণ সমর্থকদের ক্ষোভের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বোর্ডের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কাজে লাগানো। ক্ষমতাসীন দলের নির্বাচনী প্রচারে ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ এবং ওডিআই টিমের সাবেক অধিনায়কের বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি থাকা (চাকরিরত) অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন নেওয়া ও নির্বাচন করায় জনমনে ধারণা জন্মায়, ক্রিকেটকে দলীয়করণ করা হচ্ছে। ক্রিকেট বোর্ডের সাম্প্রতিক নির্বাচন সেই ধারণাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। ঘরোয়া ক্রিকেটে নানা ধরনের অনিয়ম ও শৃঙ্খলায় ঘাটতির বিষয়গুলোও দৃষ্টিকটুভাবে ক্রিকেটকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ঘরোয়া লিগে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগের মতো ইস্যুতে ক্রিকেটের কর্তাদের জবাবদিহির কোনো আলামত মেলেনি। সময়ে সময়ে ক্রিকেটারদের বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ক্ষোভেরও বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যাতে ইঙ্গিত মেলে বোর্ড কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্রিকেটারদের হুমকি-ধমকি দিয়ে নিয়ন্ত্রণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ও পেশাদারত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এগুলো যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই।
২
ক্ষমতার অপব্যবহার এবং হুমকি-ধমকির মতো আচার যে এ ধরনের পেশাদার খেলাধুলার কতটা ক্ষতি করে, তার সর্বসাম্প্রতিক নজির হচ্ছে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট। দেশটিতে ক্রিকেট নিয়ে যে তোলপাড় চলছে, তা নজিরবিহীন। প্রায় দুই দশক আগে যখন ইংল্যান্ড দলের অধিনায়ক ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত মুসলিম ক্রিকেটার নাসের হুসেইন, তখন কেউ কল্পনাও করেননি যে ক্রিকেটে বর্ণবাদ ও বৈষম্য কী ধরনের সুপ্ত ক্ষোভের জন্ম দিচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে মন্টি পানেসার, রবি বোপারা, মঈন আলী ও আদিল রশিদের মতো দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত ক্রিকেটাররা ইংল্যান্ডের হয়ে যখন তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন, তখন তাঁরাও কেউ বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলেননি। কিন্তু ক্রিকেটার আজিম রফিক তাঁর ভোগান্তি ও অপমানের কথা প্রকাশ করার পর থেকে বর্ণবাদের বিষয়টি পুরো ব্রিটিশ সমাজের বর্ণবাদ, ইসলামভীতি ও বিভাজনের প্রশ্নে অনেক বড় বিতর্কের সূচনা করেছে। আজিম রফিক যে জাতিগত নিগ্রহের শিকার হয়েছেন, তা যে একটি অমানবিক উপহাস, সে কথা এখন সবাই স্বীকার করছেন।ইয়র্কশায়ার কাউন্টি ক্লাবে আজিম রফিক তাঁর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা প্রকাশ করার পরও ক্লাব কর্মকর্তারা প্রথমে তা গায়ে মাখেননি। পরে একটা তদন্ত করালেও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু গণমাধ্যমে এ অভিযোগ প্রকাশ পাওয়ার পর রাজনীতিকেরা বিষয়টি আর উপেক্ষা করতে পারেননি। ১৬ নভেম্বর পার্লামেন্টের ডিজিটাল, সংস্কৃতি, মিডিয়া ও খেলাধুলাবিষয়ক স্থায়ী কমিটি এক শুনানি গ্রহণ করে, যেখানে আজিম রফিক অভিযোগ করেন যে পুরো ইংলিশ ক্রিকেটই ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বর্ণবাদী’। ইয়র্কশায়ার ক্লাবের তদন্তে ইংল্যান্ড ও ওয়েলশ ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানানোর পরিণতিতেই বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ সামনে চলে আসে।
ইসিবি অবশেষে স্বীকার করে নেয় যে বর্ণবাদ ও বৈষম্য তাদের খেলার জন্য একটি কলঙ্কের বিষয় হয়ে আছে এবং তারা নিঃশর্তভাবে ক্ষমা চেয়েছে। জরুরি এক বৈঠকের পরে একটি বিবৃতিতে তারা বলেছে, আজিম রফিক আমাদের খেলার যেদিক তুলে ধরেছেন, তা তাদের সবাইকে হতবাক, লজ্জিত ও দুঃখিত করেছে।
ক্রিকেটে বর্ণবাদ কেলেঙ্কারির পটভূমিতে ৯ নভেম্বর ইন্ডিপেনডেন্ট কমিশন ফর ইকুইটি ইন ক্রিকেট, আইসিইসি বর্ণবাদ এবং বৈষম্যের সম্ভাব্য শিকার ভুক্তভোগীদের প্রমাণসহ এগিয়ে আসার আহ্বান জানায়। ব্রিটিশ গণমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায় যে মাত্র দিন দশেকের মধ্যেই এক হাজারেরও বেশি লোক কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এ ছাড়া কিছু ভয়াবহ পরিসংখ্যান সামনে এসেছে। যাতে দেখা যাচ্ছে, ইংল্যান্ডে, তৃণমূল পর্যায়ে ক্রিকেটে ব্রিটিশ-এশীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণের হার হচ্ছে ৩০ শতাংশ। অথচ পেশাদার স্তরে তাদের প্রতিনিধিত্ব মাত্র ৪ শতাংশ। আরেকটি পরিসংখ্যান বলছে, শীর্ষ স্তরের ক্রিকেটারদের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সাবেক ক্রিকেটারদের পরিবারের সদস্য, যা সমালোচকদের মতে প্রতিভার পরিবর্তে খেলায় অভিজাত গোষ্ঠীর প্রাধান্য বজায় রাখার প্রমাণ। নাসের হুসেইন এখন বলছেন যে বর্ণবাদের সমস্যাটি ইয়র্কশায়ারের চেয়েও অনেক বেশি বিস্তৃত। ডেইলি মেইল পত্রিকায় অতীতের নীরবতার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি লিখেছেন, ‘এটি করা হয়নি, কারণ তা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর মতে, ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয়েছে এটা মানতে যে এগুলোর সঙ্গে তাদের মানিয়ে নিতে হবে এবং মেনে চলতে হবে।
৩
বর্ণবাদ নিয়ে ইংলিশ ক্রিকেটে চলমান ঝড়ে প্রমাণিত হয়েছে ক্রিকেটাররা নিগৃহীত হলেও তাঁদের অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা এবং জায়গা ছিল না। ক্রিকেটের ক্ষমতাধর কর্তাদের জবাবদিহির অভাব ছিল প্রকট। আমরা গর্ব করে বলতে পারি, আমাদের দেশে বর্ণবাদের লেশমাত্র নেই। কিন্তু ক্রিকেট কর্তাদের যে কোনো জবাবদিহি নেই, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ক্রিকেটারদের প্রকাশ্যে হেয় করা এবং রাজনৈতিক দলীয়করণের অভিযোগ কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। নতুন ক্রিকেটার তৈরিতে ব্যর্থতারও কোনো ব্যাখ্যা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরাও কি ইংল্যান্ডের মতো বড় কোনো ঝড়ের জন্য অপেক্ষায় থাকব?
(২৫ নভেম্বর, ২০২১ প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন