সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বিদেশে চিকিৎসায় বাধা আইনি, না রাজনৈতিক?

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত চিকিৎসার প্রশ্ন নিয়ে একটি অনাকাঙ্খিত ও অশোভনীয় বিতর্ক অযৌক্তিকভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার পরিবার গত এক বছরের বেশি সময় ধরে তাঁকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে উপূর্যপুরি অনুরোধ, আবেদন ও দাবি জানিয়ে আসছেন। সত্তরোর্ধ্ব একজন নারীর অসুস্থতা যখন বাড়াবাড়ি রূপ নেয়, তখন তাঁর পরিবার এবং দল উৎকন্ঠা ও আবেগের কারণে উন্নত চিকিৎসার সুযোগের জন্য আবেদন-নিবেদন করবে, সেটাই স্বাভাবিক। সরকারও সেই দাবি পূরণ করে নিজেদের মানবিক ও উদার হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ নিতে পারে; বিশেষ করে দেশে-বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে যখন নিষ্ঠুরভাবে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করা ও সমালোচকদের কন্ঠরোধের অভিযোগ আছে। তবে সরকার যে সেপথে হাঁটতে রাজি নয়, তা তারা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। 


ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলছি একারণে যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে একাধিকবার আবেদন গেলেও তিনি সরাসরি তা নাকচ করেন নি। তিনি জানান যে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তা যথাযথ জায়গায় তিনি পাঠিয়ে দেবেন। আবেদন অনুমোদনের সুযোগ আইনে না থাকলে, অথবা আইনের পরিপন্থী হলে এবং সেটি নজিরবিহীন হলে আবেদনকারিকে তাঁর সেকথা সরাসরি জানিয়ে দেওয়ার কথা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অভি্যোগ করেছেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয় নিয়ে বিএনপি রাজনীতি করছে। তিনি হায়াত-মউত  আল্লাহর হাতে উল্লেখ করে প্রশ্ন তুলেছেন কারও মৃত্যুর জন্য সরকার কেন দায়ী হবে? দলটির কয়েকজন নেতা বলেছেন দেশে চিকিৎসার সুবিধা থাকতেও কেন তাঁকে বিদেশে পাঠাতে হবে? খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে সংসদে প্রশ্নোত্তর এবং সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসার জবাবে আইনমন্ত্রী যেসব কথা বলেছেন, তা অবশ্য বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। 


৩০ জুন বাজেট আলোচনায় ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর বক্তৃতায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, , ‘বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে হবে। আইন অনুযায়ী, খালেদা জিয়ার বিদেশে যাওয়ার আর কোনো পথ খোলা নেই।’ তখন তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার জন্য যে আবেদন করা হয়েছিল তাতে কোনো আইনের উল্লেখ ছিল না। ওই আবেদন বিবেচনায় দুটো শর্তে সরকার তাঁর দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে মুক্তি দিয়েছিল। শর্ত দুটো হচ্ছে, তিনি বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন ও দেশে থেকেই চিকিৎসা নেবেন। নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া আবেদন আর পুনর্বিবেচনার সুযোগ নেই বলেও তিনি  সে বক্তব্যে উল্লেখ করেছিলেন। দুই মাস পরে, ২৮ আগস্ট তিনি ল রিপোর্টাস ফোরামের এক কর্মশালায় বলেন, বিদেশে যেতে চাইলে সাজা স্থগিতের পর শর্ত সাপেক্ষে মুক্ত খালেদা জিয়াকে জেলে গিয়ে নতুন করে আবার আবেদন করতে হবে (দেশ রুপান্তর, ২৯ আগস্ট, ২০২১)। ২৩ নভেম্বর বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে আইনমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিলে তিনি সেটি পরীক্ষা করে দেখার জন্য তাদের কাছে সময় চেয়েছেন (মানবকন্ঠ, ২৩ নভেম্বর, ২০২১)। তবে, একাধিকবার তিনি বলেছেন ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার অধীনে সরকার তাঁর আবেদন নিষ্পত্তি করে সাজা স্থগিত রেখেছে এবং সরকার আইনের বাইরে কিছুই করবে না। 


বাজেট আলোচনা ও ল রিপোর্টারদের সভার বক্তব্য দুটিতে বোঝা যায়, সরকার চাইলে একটা না একটা উপায় বের করা সম্ভব।  তবে সরকার চায়, হয় তিনি জেলে ফেরত যান এবং তারপর নতুন করে আবেদন করুন, নয়তো দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চান। আইনে যদি সুযোগ না থাকে, তাহলে জেলে ফেরত যাওয়ার শর্ত দেওয়া কেন? নাকি, জেলে ফেরত যাওয়া কিম্বা ক্ষমা চাওয়ার শর্তগুলোর উদ্দেশ্যই হচ্ছে জীবন বিপন্ন হওয়া রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেয় হতে বাধ্য করা, যিনি কথিত অপরাধ স্বীকার করেননি এবং যে মামলার আপিলের সব সুযোগ এখনো শেষ হয়নি? 


প্যারোল অনুমোদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য দেশে কোনো আইন নেই এবং তা যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইচ্ছাধীন ও পরিবর্তনশীল নীতিমালায় অনুশীলন করা হয়, তার নজির তো ভুরি ভুরি। জেলে গিয়ে আবেদন করার শর্ত হত্যা মামলার আসামী হারিসের বড় ভাই আনিসের ক্ষেত্রে কি অনুসরণ করা হয়েছিল? দন্ডিত অপরাধীর কথা বাদ দিলেও রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও দৃষ্টান্তের অভাব নেই। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা আসম রব, আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান - এরা সবাই সরকারের বিশেষ বিবেচনায় অনুমতি নিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন। 


প্যারোল ছাড়াও সাজা মওকুফ বা আগাম মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। প্রায় সোয়া শ বছরের পুরোনো দ্য প্রিজন্স অ্যাক্টের অন্তত তিনটি ধারায় সরকারকে বন্দীদের সাজা কমানো ও আগাম মুক্তির বিষয়ে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এই ক্ষমতা যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যবহার করা হয় না, তা নয়। প্রিজন্স অ্যাক্টের ৫৯ ধারার ৫,৭ এবং ৯ উপধারায় বন্দীদের আচরণের ভিত্তিতে মূল্যায়ন এবং সাজা কমানো, বন্দীর মৃত্যুঝুঁকি বিবেচনায় মুক্তিদান এবং দণ্ডের সময় এবং শ্রেণি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা পুরোপুরি সরকারের। 


মৃত্যুঝূঁকি বিবেচনার মানবিক বিধান থাকার পর এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক একেবারেই অপ্রয়োজনীয়; বরং এই বিতর্ক দেশে রাজনৈতিক বিভাজনের প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিগুলোর মধ্যে তিক্ততা বাড়াচ্ছে। মৃত্যুঝুঁকি বিবেচনায়ই করোনা মহামারির সময়ে প্রাণঘাতি কোভিড ১৯ এর সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে প্রায় তিন হাজার সাজাপ্রাপ্ত আসামীকে সরকার মুক্তি দিয়েছে (২৮৮৪ বন্দী মুক্তি পাচ্ছেন, আজ পেয়েছেন ৩৮৫ জন, ১৯ মে ২০২০, প্রথম আলো)। যদিও বলা হয়েছে, স্বল্পমেয়াদী দন্ডে দন্ডিত অপরাধীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে, তবুও সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জেনেছি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামী দুই দশকের বেশি জেলখাটা আসামীও এই সুবিধা পেয়েছেন।  বিকাশের মতো দুধর্ষ অপরাধী সাজার মেয়াদ শেষের আগেই কীভাবে সরকারের কৃপায় মুক্তি পেয়েছেন, তা অবশ্য সরকার আজও প্রকাশ করেনি। 


আইন এবং অতীতের নজির থেকে সরকারের যে ক্ষমতার প্রমাণ মেলে, তার আলোকে এটি স্পষ্ট যে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই হচ্ছে মূল কথা। আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেই পরোক্ষে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে বিএনপি ক্ষমতা থাকার সময়ে যতটা নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে, তাতে তাদের মানবিক আচরণ প্রাপ্য নয়। এক্ষেত্রে একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা এবং হামলার তদন্ত ও বিচারকে নস্যা করার চেষ্টার মত গুরুতর অভিযোগও আছে। এমন কথাও বলা হয়েছে  তিনি বিদেশে গেলে আর ফিরবেন না, যাতে ইঙ্গিত মেলে বিদেশে সুস্থ হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে তাঁদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। অন্যরা সমর্থন না করলেও ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তই যেহেতু শেষ কথা , সেহেতু বিষয়টি নিয়ে অশোভন বিতর্ক পরিহার করা প্রয়োজন। ওবায়দুল কাদেরের কথায় বিএনপির যখন রাস্তায় মিছিল করার ক্ষমতা নেই, তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত স্পষ্ট করেই বলা উচিত।  


(২৯ নভেম্বর, ২০২১-`র প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

Bangladesh is vexed by and wary of Modi’s unstinting support to Sheikh Hasina

In the run-up to Bangladesh’s general election in January 2014, New Delhi took the unusual step of sending a top diplomat from its external affairs ministry to Dhaka to persuade General Hussain Muhammaed Ershad, the country’s former military ruler, to participate in the polls. Big questions had been raised over the fairness of the election. The incumbent government was led by Sheikh Hasina’s Awami League, and the leader of the opposition Bangladesh Nationalist Party (BNP) had been placed under virtual house arrest, with police and roadblocks around her house in Dhaka. The BNP and other opposition parties were threatening to boycott the election. Ershad, the head of the Jatiya Party, was perceived as a potential kingmaker, able to bring to power whichever of Bangladesh’s two main parties he supported, but he was also threatening to withdraw from the election.  After a decade of Modi’s reign in India, people in Bangladesh are angry at their government cosying up to a Hindutva regime ...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...