স্বাধীন বাংলাদেশ দখলদার পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের লড়াইয়ে যে বিজয় অর্জন করেছিল, সেই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে কেমন বাংলাদেশ নিয়ে উৎসব হওয়ার কথা ছিল, তা আমাদের সবারই জানা। ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে `আমরা কেমন বাংলাদেশ চাই` তার একটি রুপরেখা রুপকল্প ২০২১ ঘোষণা করেছিল। বছর কয়েকের মধ্যে ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের নামও ছিল রুপকল্প ২০২১। কী ছিল সেই রুপকল্প, তা এখন আর জানার কোনো উপায় নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশে ইন্টারনেটে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আর আমাদের সংবাদপত্রগুলোর অনলাইন আর্কাইভেও ২০০৯ সালের আগে যে কোনো সংবাদপত্র ছিল, তা বোঝার উপায় নেই। এখন শুধুই রুপকল্প ২০৪১-এর কথা।
উইকিপিডিয়ায় ওই নির্বাচনী ইশতেহারের রুপকল্প ২০২১- এর কিছু সারাংশ পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা যেখানে,দারিদ্র্য সম্পূর্ণরূপে দূর হবে, গণতন্ত্র ও কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠা হবে, রাজনৈতিক কাঠামোয় ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং জনগণের অংশগ্রহণ বাড়বে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সুশাসন আসবে যাতে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব এড়ানো যাবে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটবে, সমাজ হবে দুর্নীতি মুক্ত , নারীর ক্ষমতায়ন এবং মহিলাদের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত হবে।
২০২১-এর রুপকল্পের লক্ষ্যগুলো পূরণ হয়েছে কিনা, তা নিয়ে সংবাদপত্রের মতামত কলামে বিস্তারিত আলাপের সুযোগ নেই। তাই আমি শুধু ডিসেম্বরের প্রথম ১২ দিনের কয়েকটি প্রধান শিরোনাম তুলে ধরছি। শিরোনামগুলো একই পত্রিকা সমকাল-এর। সারাদেশে সব সময় হাফ পাস দাবি (ডিসেম্বর ১), আওয়ামী লীগের কাঠগড়ায় শতাধিক এমপি-মন্ত্রী ইউপি নির্বাচনে ফল বিপর্যয় (২ ডিসেম্বর), খরচ কম আস্থা বেশি অসুখ হলেই বিদেশ (৩ ডিসেম্বর), তিন চক্রের কবজায় সার (৪ ডিসেম্বর), সড়কে অনিয়মের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের লাল কার্ড (৫ ডিসেম্বরের দ্বিতীয় প্রধান শিরোনাম), বেপরোয়া ছাত্রলীগ ফের আলোচনায় (৬ ডিসেম্বর),নিন্দা ধিক্কারের মুখে মন্ত্রিত্ব গেল মুরাদের (৭ ডিসেম্বর), অস্ত্র ও অর্থের পিছনে কে ওই প্রভাবশালী (৮ ডিসেম্বর), রাজনৈতিক নৃশংসতার করণ পরিণতি /আবরার হত্যাকান্ড (৯ ডিসেম্বর), ক্যাম্পাসে খুনের সাজা হয়না ও চাকরির শর্তে নেই তবুও গাড়িবিলাস (১০ ডিসেম্বরের প্রধান দুই শিরোনাম),বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়ের আগে অনেক অনিয়ম এবং বেনজির, র্যাবপ্রধানসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা ( ১১ ডিসেম্বরের প্রধান দুই শিরোনাম) ও প্রমাণহীন বলছে সরকার ভুল দেখছে যুক্তরাষ্ট্রের (১২ ডিসেম্বর)।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দেশে-বিদেশে অনেক প্রতিষ্ঠান সেমিনার- ওয়েবিনার করেছে যেগুলোর খবর প্রধান শিরোনাম হয়নি, কিন্তু শেষ পৃষ্ঠা বা ভিতরের পাতায় ছাপা হওয়া খবরগুলো কম মন খারাপের নয়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক উন্নয়ন সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, স্বজনতোষী পুঁজিবাদ অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর অনেক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে। বড় অংশের মানুষ দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে বৈষম্য বেড়েছে।
সিপিডির আয়োজিত আরেকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, বঙ্গবন্ধু যে 'স্বাধীনতা' চেয়েছিলেন, তা দেশ স্বাধীনের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে`। কিন্তু ওই একই বক্তৃতায় তিনি বলেন, সমাজের বৈষম্য দূর করা দরকার। এটা করতে হলে আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। পত্রিকার খবরে দেখলাম এই সর্বজনশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক বলেছেন ষাটের দশকে যে বক্তৃতা বা নিবন্ধ লিখতেন এক ঘন্টায়, এখন তা লিখতে তাঁর সময় লাগে সপ্তাহখানেক। কেননা, কী লেখা যাবে আর কী লেখা যাবে না তা ভাবতে হয়।
নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বিশ্বে গণতন্ত্র প্রসারের লক্ষ্যে যে গত ৯ ও ১০ ডিসেম্বর যে গণতন্ত্র সম্মেলন করেছেন, তাতে বাংলাদেশের আমন্ত্রণ না পাওয়া নিয়েও যে জোর বিতর্ক হয়েছে, তা-ও খুব একটা সুখকর নয়। ( বাংলাদেশ আমন্ত্রিত না হলেও বাংলাদেশিরা যে একেবারে বাদ গেছেন, তা নয়। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ আইরিন খান দ্বিতীয় দিন সকালের অধিবেশনে মুক্ত বৈশ্বিক পরিসরে সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ওপর বিস্তারিত আলোচনা করেছেন)। নিজেদের গণতন্ত্রের বিষয়ে আমরা যখন বাইরের কারো মতামত শুনতে রাজি নই, তখন কে আমাদের গণতন্ত্র বলে মানল বা মানল না, তাতে এতো উত্তেজনার কী আছে?
২
র্যাব এবং তার বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তাদের সাতজনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে এখন সরকার ও জনমনে যে সব বিতর্ক চলছে, তা নিয়ে প্রশ্ন অনেক। কিন্তু প্রশ্নগুলোর সহসা জবাব মিলবে বলে মনে হয় না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কল্যাণে আমরা যদিও প্রথম জানলাম যে কূটনীতিতে `ঢং` বলে কিছু একটা আছে, কিন্তু মনে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রেরএই নিষেধাজ্ঞার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ কী, তা নিয়ে একধরণের ধোঁয়াশা ভাব তৈরি করা হচ্ছে। আলোচনায় যেখানে প্রাধান্য পাওয়ার কথা দেশের একটি বিশেষায়িত বাহিনীর পুরোটির ওপর নিষেধাজ্ঞার সম্ভাব্য প্রভাব, সেখানে সাতজন ব্যাক্তির নিষেধাজ্ঞাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস এসোসিয়েশনের যে বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে র্যাবের নাম পর্যন্ত নেই। অথচ, ওই সাতজনের নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র র্যাবে তাঁদের ভুমিকার কথা বলেছে। পুলিশ এসোসিয়েশন কি নিশ্চিত যে বাহিনী হিসাবে র্যাব নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ায় ওই সাতজন ছাড়া বাহিনীটির সাবেক এবং বর্তমান কোনো কর্মকর্তা কোনো ধরনের সমস্যার মুখে পড়বে না? জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার কাজে তাদের অংশগ্রহণ যুক্তরাষ্ট্রের বাধার মুখে পড়বে না তো? এই নিষেধাজ্ঞা দেশটির প্রেসিডেন্টের যে নির্বাহী আদেশের অধীনে আরোপিত হয়েছে, তা মাত্র ২০১৭ সালের আইন। নিষেধাজ্ঞা প্রয়োগের ব্যাপ্তি ও গভীরতা অনেকেরই অজানা। যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম কেনা কিম্বা বিদ্যমান সরঞ্জামের রক্ষ্ণাবেক্ষণসেবার ক্ষেত্রে আগে নিশ্চিত করার প্রশ্ন উঠতে পারে যে সেগুলো র্যাবের হাতে গিয়ে ঠেকবে কি না।
র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত আর্ল মিলারকে ডেকে নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব কী বলেছেন সে সম্পর্কে প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে, বাংলাদেশের বড় আপত্তি এটি একতরফাভাবে করা হয়েছে। পররাষ্ট্রসচিবের কথা অনুযায়ী, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার জন্য দুই দেশের যে ফোরাম আছে তার পটভূমিতে বাংলাদেশের প্রত্যাশা ছিল না জানিয়ে একতরফাভাবে কিছু করা হবে না। তার মানে কি এটাই দাঁড়ায় না, র্যাবের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে কিছু একটা করবে, সেটা তাঁরা জানতেন? শুধু অপেক্ষায় ছিলেন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে তাঁদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে এবং আশা ছিল দেন-দরবার করে তা আটকানো যাবে?
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির সদস্যরা গতবছরের আগস্টে বিদায়ী ট্রাম্প প্রশাসনের ওপরই এ ধরণের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে চাপ দিয়েছিল। এরপর কয়েক মাস আগে কংগ্রেসের টম ল্যান্টোস হিউম্যান রাইটস কমিশন আবারও ওই দাবি জানিয়েছে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি এরপরও দাবি করতে পারে যে হঠাৎ করেই নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মন্ত্রী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতারা যাই বলুন না কেন, এধরণের কঠোর ব্যবস্থার সম্ভাবনা অনুমান করতে না পারার যুক্তি মেনে নেওয়া কঠিন। র্যাবের কার্যপদ্ধতি ও কৌশল নিয়ে আপত্তি শুধু যে যুক্তরাষ্ট্রের, তা তো নয়। ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে গত কয়েক বছরে যত অংশীদারত্ব বৈঠক হয়েছে এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনে বাংলাদেশ বিষয়ক প্রতিটি আলোচনায় ঘুরেফিরে বিষয়টি উঠেছে, বিচারবহির্ভুত হত্যা ও গুম বন্ধ এবং অভিযোগগুলোর বিশ্বাসযোগ্য ও স্বাধীন তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে।
৩
ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকা বিষয়টি নিয়ে যে সংবাদ প্রকাশ করেছে তাতে ভারত সরকারের একজন মুখপাত্রকে উদ্ধৃত করা হয়েছে, যাতে স্পষ্টতই বোঝা যায়, তারা চায় বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় পরিসরেই সীমিত থাকুক। একদিন পর পত্রিকাটি এক সম্পাদকীয়তে বলেছে, এধরণের নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা নাকচ করে দেওয়া, কিম্বা যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যালঘুদের ওপর নিষ্ঠুরতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হচ্ছে মূলত ক্রুদ্ধ প্রতিক্রিয়া। সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, র্যাবের নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় যদি মানবাধিকারের বৃহত্তর কল্যাণ হয়, তাহলে তা অভিনন্দনযোগ্যও হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পর্যালোচনার প্রয়োজনে হলেও আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর অতিউৎসাহী সদস্যদের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা যদি বন্ধ হয়, তাহলে তাকে স্বাগত জানাতেই হয়।
বাংলাদেশের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এই অপ্রীতিকর বিষয়গুলোর মুখোমুখি হওয়া নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর। কিন্তু, এই অস্বস্তি প্রশমনের উপায় নিয়ে ভাবনাটা এখনই দরকার। অভিযোগগুলোর বিচারবিভাগীয় তদন্ত হয়তো জট ছাড়ানোর পথ দেখাতে পারে। অভিযোগ অস্বীকার বা নাকচে সমাধান নেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন