মানবাধিকার কী, তা বোঝার বিষয়ে আমাদের বড়ধরণের সমস্যা রয়ে গেছে বলে মনে হয়। সমস্যাটা অবশ্য সাধারণ মানুষের নয়, সরকার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেই এটি প্রকটভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। গেল সপ্তাহখানেকের কয়েকটি ঘটনার কারণেই এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে। একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে, আর অন্যটি আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের কথা ও কাজ সম্পর্কে।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার পরিষদের নির্বাচিত সদস্য। ৪৭ সদস্যের এই পরিষদ ইথিওপিয়ার চলমান গৃহযুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের যেসব গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, সেগুলো তদন্তের জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠনের প্রস্তাব আলোচনার উদ্দেশ্যে ১৭ ডিসেম্বর একটি বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হয়েছিল। ইরিত্রিয়ার সঙ্গে দুই দশক ধরে চলা যুদ্ধ অবসানের জন্য শান্তিচুক্তি করে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ এখন নিজদেশেই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। গত বছরের আগস্টে নির্ধারিত নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সাংবিধানিক সংকট থেকেই দেশটির একটি বড় অংশ টিগ্রে অঞ্চলে সশস্ত্র সংঘাতের সূচনা। গতবছরের নভেম্বরে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, বাস্তুচ্যূত হয়েছেন প্রায় ২০ লাখ মানুষ, যা ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ এখন দূর্ভিক্ষের কবলে। ইরিত্রিয়াও এই যুদ্ধে টিগ্রের বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে।
মানবাধিকার পরিষদের এই ৩৩তম বিশেষ অধিবেশনের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ মোট ১৭টি সদস্যরাষ্ট্র। প্রস্তাবের ওপর আলোচনার বিবরণীতে বাংলাদেশের কোনো বক্তব্য যে খুঁজে পাওয়া গেল না, তাতে কোনো বিস্ময় নেই। বিস্ময় হচ্ছে বাংলাদেশ এই প্রস্তাবটি সমর্থন করে নি, ভোটদানে বিরত থেকেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশ এবারে নির্বাচিত হওয়ার পর এর আগেও একইধরণের তদন্ত সমর্থন করেনি, ভোটদানে বিরত থেকেছে। গত ২৫ মার্চ শ্রীলংকার গৃহযুদ্ধে গণহত্যার তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের জন্য বাজেটের প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোট দিয়েছিল বিপক্ষে।
একটি ভয়াবহ গণহত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম। অথচ, সেই গণহত্যার ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার দিনটিতে বাংলাদেশ অন্য একটি দেশের গণহত্যার অভিযোগ তদন্তের বিরোধিতা করেছিল। আবার যে দেশের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই শ্রীলংকা বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার পর পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম আনার জন্য তার আকাশসীমা ও বন্দর ব্যবহার করতে দিয়েছিল। শ্রীলংকাকে যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে বাঁচানোর চেষ্টায় বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে এককাতারে দাঁড়িয়েছে।
ইথিওপিয়াকে বাঁচানোর চেষ্টায় বাংলাদেশ এবার যে ভোটদানে বিরত থেকেছে, সেই দিনটিও বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ের বিজয়ের ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার ঠিক পরের দিন। কোন বিবেচনায় বাংলাদেশ ইথিওপিয়ায় মানবাধিকার লংঘনের তদন্ত সমর্থন দেয়নি, তা জানার জন্য জেনেভায় জাতিসংঘ দপ্তরে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দপ্তরে ই-মেইল করে দুই দিনেও তার কোনো জবাব মেলেনি। ইথিওপিয়া যে আমাদের উন্নয়নের অত্যাবশকীয় অংশীদার অথবা আমাদের রপ্তানির বড় বাজার, কিম্বা বিনিয়োগকারী, তা নয়। তাহলে কোন স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মানবাধিকারের প্রশ্নে একটি নৈতিক অবস্থান আমরা নিতে পারলাম না?
শুধু বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেই যে মানবাধিকারের ধারণায় আমাদের গলদ আছে, তা নয়; দুদিন আগে দেশে মানবাধিকারের আইনি তদারককারী প্রতিষ্ঠান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্থায়ী সদস্যকে উদ্ধৃত করে যে সব বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে, তাকে হতাশাজনক বললেও কম বলা হয়। এরপর একটি টিভি চ্যানেলেও কমিশনের স্থায়ী সদস্য কামাল উদ্দিন আহমেদের সাক্ষাতকার শুনলাম, যাতে মনে হচ্ছিলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের বক্তব্য শুনছি, যাঁর কাজ হচ্ছে নিরাপত্তাবাহিনীর সাফাই দেওয়া। তিনি আগে ওই দায়িত্ব পালন করলেও এখন যে তাঁর কাজ সেটি নয়, তা সম্ভবত অভ্যাসগত কারণে তিনি ভুলে গেছেন।
দেশে মানবাধিকারের গুরুতর লংঘনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র র্যাব এবং র্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাতজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেই বিষয়ের ওপর বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে তিনি যা বলেছেন, তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তের পিছনে রাজনীতি থাকতে পারে, তাদের দেশে অসংখ্য মানবাধিকার লংঘনের গুরুতর অভিযোগ আছে এবং বাংলাদেশে যেসব ঘটনার কথা বলা হয়েছে, তা তুলনামূলকভাবে নগণ্য। দেশের নাগরিকদের মানবাধিকার সুরক্ষার দায়িত্বের কথা তাঁর মনে থাকলে তাঁর বলার কথা ছিল অভিযোগগুলো যেহেতু গুরুতর, সেহেতু এগুলো তদন্ত করা প্রয়োজন। আর সেটুকূ বলতে না পারলে তিনি অন্তত বলতে পারতেন, তাঁরা অভিযোগগুলো বিস্তারিত জানার অপেক্ষায় আছেন। কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে কক্সবাজারে কাউন্সিলর একরামুল হত্যার তদন্তের বিষয়েও তাঁরা নিঃসংকোচে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে যে সরকারের প্রিয়ভাজন আমলা্দের অবসরোত্তর পুনর্বাসন কেন্দ্রে রুপান্তরিত করা হয়েছে, তা নিয়ে হতাশার কথা আগেও লিখেছি। কিন্তু এখন বোঝা যাচ্ছে, এই কমিশন জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং জা্তীয় মানবাধিকার কমিশন আইনও আত্মস্থ করার চেষ্টা করে নি। সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৩০টি ধারা যদি তাঁদের পক্ষে মনে রাখা কঠিন হয়, তাহলেও অন্তত ১, ২,৩, ৫,৬,৭, ৯, ১০, ১৮ ও ১৯ তাঁদের বারবার পড়া দরকার। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনের তৃতীয় অধ্যায়ে ১২ নম্বর ধারার উপধারাগুলোয় তাঁদের যে কার্যাবলী ও তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া আছে, সেগুলোর আলোকে দায়িত্বপালনে অসহায়ত্ব প্রকাশের কি আদৌ কোনো সুযোগ আছে? তাঁদের কাছে কোনো অভিযোগ আসার জন্য তো অপেক্ষার প্রয়োজন নেই; তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো ঘটনা তদন্ত করতে পারেন। বর্তমান কমিশন কটি গুম , বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত করেছে? আদালতে বিচারাধীন মামলা তাঁরা তদন্ত করতে পারেন না, একথা ঠিক। কিন্তু গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার কোনো ঘটনাই তো আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। তাহলেদ সেগুলোর বিষয়ে তাঁদের কি কোনো দায়িত্ব নেই? গুমের শিকার ব্যাক্তিদের স্বজনদের সংগঠন `মায়ের ডাক` এর অভিযোগগুলোর বিষয়ে কমিশনের দায়িত্বপালনে বাধা কোথায়?
উপরের দুটো দৃষ্টান্তই শেষ নয়, এরকম আরও কিছু অস্বস্তিকর নজির আমাদের সামনেই রয়েছে। কিন্তু সেগুলো নিয়ে কেউ খুব একটা কথা বলতে আগ্রহী নন। সংসদে রাজনীতিকদের অনেকেই ধর্ষণ ও মাদকের মত অপরাধের ক্ষেত্রে খোলামেলাভাবে ক্রসফায়ারকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহারের কথা বলেছেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও কেউ কেউ এধরণের গুরুতর লংঘনের ঘটনাকে যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। `গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিন্দনীয়` বলে তারপরই `তবে` যুক্ত করে তাঁরা বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আর তো কোনো উপায় নেই। মানবাধিকারের গুরুতর লংঘনকে সমাজে বৈধতা দেওয়ার এই অপচেষ্টার ধারাবাহিকতা যে রাজনীতিতেও বিস্তৃত হয়েছে এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে চলেছে, সেই অভিযোগ নাকচ করা যাবে না। সেজন্যেই এখন সবার প্রয়োজন মানবাধিকারের ধারণাকে ঝালাই করে নেওয়া, যাতে ঘাটতিগুলো ধরা যায়।
(২৩ ডিসেম্বর, ২০২১-এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন