দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক গোলাম মনোয়ার কামালকে ধন্যবাদ যে তিনি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানকে বলতে পেরেছেন, রচনা প্রতিযোগিতা আর সচেতনতা তৈরির মত সহজ কাজগুলো কমিশনের প্রধান করণীয় নয়। এগুলো অন্যরা করে দিতে পারবে। গত বৃহস্পতিবার আসকের এক অনলাইন অনুষ্ঠান ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ও মানবাধিকারকর্মীদের সংলাপ’ -এ কমিশন চেয়ারম্যান তাঁদের ভালো কাজের কৃতিত্ব তুলে ধরে যেসব কথা বলেন, তার জবাবে আসকের পরিচালক এসব কথা বলেছেন। তবে কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁদের কথিত যেসব সীমাবদ্ধতার কথা বলেছেন এবং গণমাধ্যমের যে সমালোচনা করেছেন, তা কেউ খন্ডন করেছেন কি না, খবর পড়ে সেটা বোঝা গেল না। সেকারণেই এ লেখার অবতারণা।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেছেন, আইনের কারণে কমিশন সরাসরি কিছু করতে পারছে না। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র্যাবের বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তিনি একথা বলেন। তাঁর কথায় আইন সংশোধন হলে তারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারবেন এবং কমিশনও শক্তিশালী হবে। তাঁর দাবি, যতটুকু আইনি সক্ষমতা আছে, কমিশন ততটুকু নিয়ে সাধ্যমতো কাজ করছে ।
নাছিমা বেগম বলেন, কমিশনের আইনে বড় দুর্বল জায়গা রয়েছে। আইনে কমিশন সরকারি অন্য যেকোনো সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত করতে পারলেও ১৮(২) ধারা অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটলে সে ক্ষেত্রে কমিশন শুধু প্রতিবেদন চাইতে পারবে। নিজেদের তদন্ত করার সুযোগ নেই।
সংবাদমাধ্যমে উদ্ধৃত তাঁর এই বক্তব্য কতটা ঠিক, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মানবাধিকার কমিশন কোনো স্বাধীন অবস্থান নিতে পারবে, এমনটা কেউই আশা করেন না। কিন্তু ১৮(২) ধারার কারণে কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারে না, এ ব্যাখ্যায় গলদ আছে। আইনের ভাষ্যটি হচ্ছেঃ
১৮(১) এই আইনের অন্যান্য বিধানে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, শৃংখলা বাহিনীর বা ইহার সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগের ক্ষেত্রে কমিশন নিজ উদ্যোগে বা কোন দরখাস্তের বিরুদ্ধে সরকারের নিকট হিতে প্রতিবেদন চাহিতে পারিবে।
(২)উপধারা (১) এর অধীনে কোন প্রতিবেদন চাওয়া হইলে সরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কমিশনের নিকট একটি প্রতিবেদন দাখিল করিবে।
(৩) উপধারা(২) এর অধীন প্রতিবেদন প্রাপ্তির পর কমিশন,
ক) সন্তুষ্ট হইলে, এই বিষয়ে আর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করিবে না;
খ) প্রয়োজন মনে করিলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে সরকারের নিকট সুপারিশ পেশ করিতে পারিবে।
স্পষ্টতঃই আইনের এই ভাষ্যে কোথাও তদন্ত নিষিদ্ধ করা হয় নি। মানবাধিকার কমিশন আইনে ১২ ধারায় তাদের যে কার্যাবলী ও তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া আছে, সেই ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ তাদের রয়েছে। ওই ধারার ক উপধারায় `রাষ্ট্রীয় বা সরকারি সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন বা লঙ্ঘনের প্ররোচণার কোন অভিযোগ` স্বতঃপ্রণোদিত বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাক্তির বা তার পক্ষে – দাখিল করা আবেদনের ভিত্তিতে তদন্ত করার কথা বলা আছে। সরকারের কাছে প্রতিবেদন চাইলে যে স্বাধীনভাবে তদন্ত করা যাবে না, এমন কথা সরকার বলতে পারে। কিন্তু এটা কমিশনের অজুহাত হতে পারে না। তদন্ত শুরুর পর আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে সরকারের সঙ্গে বিরোধ হলে তা নিষ্পত্তির জন্য তো সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। আসল সমস্যা হচ্ছে মানবাধিকার কমিশনে এপর্যন্ত যাঁরাই দায়িত্ব পালন করেছেন এবং করছেন, তাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে সরকারের স্বার্থ রক্ষা, রাজনৈতিকভাবে তাকে যাতে বিব্রত হতে না হয় - এসব বিষয়ই কমিশনের কাছে অগ্রাধিকার পেয়ে চলেছে।
কমিশন চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম সম্ভবত সেকারণেই গণমাধ্যমের ওপর ক্ষোভ ঝেড়ে বলতে পেরেছেন, `গণমাধ্যমকর্মীরা একটা জিনিসই মনে করেন, গুম–খুনের বাইরে কমিশনের আর কোনো কাজ নেই।` গুম-খুন, বিশেষ করে অভিযোগ যখন শৃংখলা বাহিনীর কোন সদস্যের বিরদ্ধে, তখন তার চেয়ে গুরুতর মানবাধকার লংঘনের প্রশ্ন আর কী হতে পারে? দেশে যাঁরা গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন, কমিশন চেয়ারম্যানের এই মন্তব্যকে তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের প্রতি একধরণের অবহেলা ও অশ্রদ্ধা ছাড়া আর কী বলা যায়?
আইনে যেখানে বলা আছে তাঁরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো ঘটনা তদন্ত করতে পারেন, সেখানে তাঁরা কী বলতে পারেন কটি গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত তাঁরা করেছেন? শৃংখলা বাইনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত না করার অজুহাত হিসাবে কমিশন চেয়ারম্যান যে ১৮ ধারার কথা বলেছেন সেই আইনেও উপধারা (৪) এ সরকারের প্রতিবেদনের জন্য ছয় মাস সময়ের কথা আছে। ছয় মাস সময়সীমার মধ্যে কতগুলো অভিযোগে প্রতিবেদন পেয়ে কমিশন সন্তুষ্ট হয়েছে? না হলে তারা কী সুপারিশ করেছে? কক্সবাজারে কাউন্সিলর একরামুল হত্যার ঘটনা তো তিন বছর আগের? তারা কি প্রতিবেদন আদৌ চেয়েছিলেন? ছয়মাস পর তারা কী করেছে? কমিশন গঠিত হওয়ার পর আজ পর্যন্ত যতগুলো গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ এসেছে তার কটি তারা আমলে নিয়েছে? গুমের শিকার ব্যাক্তিদের স্বজনদের সংগঠন `মায়ের ডাক` এর সদস্যদের ডেকে নিয়ে তাঁদের অভিযোগগুলো কি কমিশন শুনেছে?
তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নেওয়া হয় যে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তাদের সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণে কমিশন তদন্ত করতে পারছে না, তখন যে তথ্যটি কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে, তা হচ্ছে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর অস্বীকৃতি। আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন কোনো ঘটনায় তাদের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে, তখন গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্তে তো আর কথিত আইনি বাধা থাকে না। সেক্ষেত্রে তো সহস্রাধিক বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ছয় শতাধিক গুমের প্রতিটি ঘটনা কমিশনের তদন্ত করার কথা! বরং, তারা কি তাদের আইনের ১৮(২) ধারা দেখিয়ে নিশ্চিত করছে না যে এগুলোতে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী জড়িত? সন্দেহ নেই, জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর আইনগত দায়িত্ব পালন না করা বাংলাদেশে এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সরকারের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষার চেষ্টাকে যৌক্তিকতা দেওয়ার চেষ্টা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।
(২৫ ডিসেম্বর, ২০২১-`র প্রথম আলো প্ত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন