সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

৯৭ সালে জন মেজর মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন খালেদা জিয়াকে



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদে তখনকার বিরোধীদল বিএনপির সংসদ বয়কট ও সরকারবিরোধী আন্দোলনে মধ্যস্থতার কথা বলেছিলেন তৎকালীন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর। ১৯৯৭ সালে ঢাকা সফরের সময়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময়ে জন মেজর তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন কমনওয়েলথ থেকে মধ্যস্থতার উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন আছে কি–না। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অবমুক্ত করা নথিতে এই তথ্য পাওয়া যায়। 

জানুয়ারি ১৯৯৫ থেকে মে ১৯৯৭ পর্যন্ত সময়ের ডাউনিং স্ট্রিটের এসব নথি যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল আর্কাইভ  বেশ আগেই অবমুক্ত করলেও এ তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি। নিয়মিত বিরতিতে সরকারের বিভিন্ন পুরোনো গোপনীয় নথি অবমুক্ত করার রীতির অংশ হিসাবে সর্বসাম্প্রতিক নথি অবমুক্ত করা হয় গত ৩০ ডিসেম্বর। তবে তখন যেসব নথি অবমুক্ত করা হয়, এটি তার অংশ নয়। এগুলো ঠিক তার তার আগের দফায় অবমুক্ত হওয়া নথির অংশ। সর্বসাম্প্রতিক নথিগুলো পর্যালোচনার সময়ে অধিকতর অনুসন্ধানে এই নথিটির দেখা মেলে।  এতে মূলত জন মেজরের ঢাকা সফরের বিস্তারিত বিবরণ এবং সফরের আগে ও পরের কিছু চিঠিপত্র ও কয়েকটি দপ্তরের সারসংক্ষেপ অর্ন্তভুক্ত আছে। 


জন মেজর ঢাকায় পৌঁছান ১৯৯৭ সালের ১০ জানুয়ারি, যে দিনটি ছিল পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লন্ডন থেকে ঢাকায় ফেরার ২৫ বছর পূর্তির দিন। স্বভাবত:ই সফরের বিভিন্ন বক্তৃতা ও আলোচনায় ওই দিবসের ঐতিহাসিক গুরুত্ব, বৃটিশ সরকারের বিশেষ সহায়তা ও বন্ধুত্বের কথা সেদিন আলোচনায় উঠে আসে।  ১২ জানুয়ারি জন মেজর ও তাঁর স্ত্রী নরমা মেজর ঢাকা ছাড়েন।


৩৬ ঘন্টার ওই সফরের সময়ে বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে বৃটিশ কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জির সঙ্গে পেট্রো বাংলার উৎপাদন বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা ক্ষমতাগ্রহণের কয়েকমাসের মধ্যেই জন মেজরের সফরটি অনুষ্ঠিত হয় এবং দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গ্যাস উৎপাদনের চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে সই হয়। ১৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের সফরের ওপর বৃটিশ মন্ত্রীপরিষদের দপ্তরে ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনারের পাঠানো এক চিঠিতে বলা হয় বাণিজ্যমুখী সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে। 

এরপর ওই বছরেই কেয়ার্ন স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় তাদের নতুন সদর দপ্তর উদ্বোধনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানায়। জন মেজরের পর লেবার পার্টি নেতা টনি ব্লেয়ার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কূটনীতির কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশের গ্যাস। সফরকালে আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে জন মেজর ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে চিঠি দেন, তাতেও জ্বালানি খাতে আমেরিকান কোম্পানিগুলোকে যেসব সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, বৃটিশ কোম্পানিগুলোর জন্যও সেই একইরকম সুবিধা দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। 

সফরের সময়ে ১১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান বেগম খালেদা জিয়া। তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিএনপির তখনকার মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান এবং লন্ডনে সাবেক হাইকমিশনার রেজাউল করিম। ১১ জানুয়ারিতেই ফরেন এন্ড কমনওয়েলথ দপ্তরের (এফসিও) ফিওনা মাইলক্রিস্টের কাছে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সজিব জন হোমস চার পাতার এক চিঠিতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনার বিবরণী পাঠান। প্রাথমিক শুভেচ্ছা বিনিময়, নাইজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত পূর্ববর্তী কমনওয়েলথ শীর্ষ বৈঠকে দুজনের সাক্ষাতোর স্মৃতিচারণ ও খালেদা জিয়ার হাঁটুতে সাম্প্রতিক অস্ত্রোপচারের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়ার পর জন মেজর জানতে চান বিরোধীদলেন অব্যাহত সংসদ বয়কটের পরিণতি কী হতে যাচ্ছে? বেগম জিয়া জানান তাঁরা কী কী কী দাবি জানিয়েছেন এবং যা পূরণ হলে তারা সংসদে ফিরবেন। কিন্তু সরকার গঠনমূলক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। ওইসব দাবির মধ্যে ছিল সংসদে বিরোধীদলকে কথা বলার সুযোগ দেওয়া, স্পীকারের নিরপেক্ষতা, সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের নিপীড়ণ–নির্যাতন বন্ধ, হয়রানিমূলক মামলা দায়ের বন্ধের মত বিষয়। তাঁরা জানান, পূর্ববর্তী ছয় মাসে বিএনপির দেড়শোরও বেশি কর্মী নিহত হয়েছেন। 


প্রধানমন্ত্রী জন মেজর সংসদে যোগ দিয়ে এসব বিষয়ে বিতর্ক ও বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপনের মতো পন্থা অনুসরণে সমাধান সম্ভব কি–না তা জানতে চান। একপর্য়ায়ে তিনি জানতে চান, এরকম অচলাবস্থা চলতে থাকলে তা অবসানে কমনওয়েলথ সচিবালয় কোনো ভূমিকা নিতে পারে কি–না? জন মেজরের একান্ত সচিবের চিঠিতে বলা হয়েছে, মোরশেদ খান তখন বলেন যে এর আগের সংকটের সময়ে কমনওয়েলথ মহাসচিব স্যার নিনিয়ান স্টিফেন বাংলাদেশে অনেক চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তখনকার বিরোধীদল (আওয়ামী লীগ) তা গ্রহণে রাজি হয় নি। 


ওই চিঠির শেষ অংশে প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের একান্ত সচিব মন্তব্য হিসাবে লেখেন রাজনৈতিক ফ্রন্টে আলোচনা বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও উৎসাহজনক ছিল না। সরকার থেকে নতুন উদ্যোগ না নেওয়া হলে বিএনপি সংসদে ফিরতে প্রস্তুত – এমন কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। প্রধানমন্ত্রী যখন নৈশভোজে শেখ হাসিনার কাছে বিএনপির উদ্বেগগুলো তুলে ধরেছেন, তখন তিনিও একইরকম অনেকগুলো প্রত্যুত্তর দিয়েছেন। এর ভিত্তিতে মনে হয় বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা অব্যাহত থাকবে। স্পষ্টত:ই বিনিয়োগের কারণে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে বৃটিশ সরকারের উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটে জন মেজরের এসব আলোচনায়।


খালেদা জিয়াকে আগে অনেক নিরাবেগ মনে হলেও সেদিন তিনি যথেষ্ট প্রাণবন্ত ছিলেন বলে ওই চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে। জন মেজরের একান্ত সচিব এরপর লিখেছেন যে খালেদা জিয়া যদিও বাংলায় কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়ছিলেন, যা তাঁর সঙ্গীরা, বিশেষ করে মোরশেদ খান অনুবাদ করে দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর ইংরেজিও পর্যাপ্ত মাত্রায় শুদ্ধ। 


ওই সফরের পর ১৫ জানুয়ারির ফাইনান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত একটি খবরের পাশে জনের স্বাক্ষরিত একটি নোট নথিভুক্ত আছে। খবরটি ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয়জন নতুন মন্ত্রী নিয়োগ করে মন্ত্রীসভায় রদবদল ঘটিয়েছেন। জন হোমস তখন প্রধানমন্ত্রী জন মেজরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নোট দিয়েছিলেন যে আমরা যা শুনেছি, তার পটভূমিতে এটি চমক দেওয়া ও আগ্রহ সৃষ্টিকারী খবর। 



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...