সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ব্লেয়ার কি বাংলাদেশ সরকারের পরামর্শকের ভূমিকা নিচ্ছেন?

সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার প্রায় অঘোষিত এক সফরে গত সপ্তাহান্তে ঢাকা ঘুরে গেছেন। আগে থেকে এই সফরের কথা বাংলাদেশ সরকার কিম্বা তাঁর ইনিস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জ থেকেও ঘোষণা করা হয় নি। সফরের সময়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। তাঁর এই সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কেও বাংলাদেশ সরকার কিম্বা তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকেও কিছু জানানো হয়নি। তবে ইনিস্টিটিউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জের ওয়েব সাইটে তাঁদের কাজের যে বর্ণনা  দেওয়া আছে তাতে বলা আছে, ’’তাঁরা বিশ্ব জুড়ে রাজনৈতিক নেতাদের নীতি, কৌশল এবং তা বাস্তবায়নের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন এবং তাঁরা এ কাজে প্রযুক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক হিসাবে বিবেচনা করে থাকেন”। 


তাঁর এই বেসরকারি সফর সম্পর্কে বাংলাদেশের সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস জানিয়েছে, টনি ব্লেয়ার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক ও ইংল্যান্ড দলের বাংলাদেশ সফরসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরও পরিদর্শন করেছেন। তবে এসব আনুষ্ঠানিকতার বাইরে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য সম্পর্কে  কোনো তরফেই কিছু বলা হয়নি। বাংলাদেশে মি ব্লেয়ারের এনজিও’র তেমন একটা কার্যক্রমের কথা জানা যায় না। তাঁর স্ত্রী শেরি ব্লেয়ার চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এর আচার্য। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অনুষ্ঠান বা স্ত্রীকে সঙ্গ দেওয়া যে এ সফরের উদ্দেশ্য নয়, তার সাক্ষ্য মেলে প্রধানমন্ত্রীর প্রাত:রাশ বৈঠকে শেরি ব্লেয়ারের অনুপস্থিতিতে। শেরি ব্লেয়ারের অনুপস্থিতির অর্থ সম্ভবত মি ব্লেয়ার একাই এ সফরে এসেছিলেন। 


টনি ব্লেয়ার নানারকম ব্যবসার পক্ষে লবিংয়ের জন্য আলোচিত। তিনি সউদি রাজপরিবারের কোম্পানি পেট্রোসউদির হয়ে চীনে ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য কাজ করেছিলেন বলে দ্য গার্ডিয়ানে ২০১৬ সালের ২৮ এপ্রিল এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাতের  শান্তি আলোচনায় বিশেষ দূত হিসাবে কাজ করার সময়ে সউদি তেল কোম্পানির জন্য কাজ করায় তিনি সমালোচনার মুখে পড়েন। 


২০০৭ সালে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার পর থেকেই তাঁর বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজে যুক্ত হওয়ার কথা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে। বির্তকের মুখে ২০১৬ সালে তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি সব রকম বাণিজ্যিক কার্যক্রম গুটিয়ে নিচ্ছেন। যে কোম্পানিগুলো তিনি গুটিয়ে নেন, সেগুলো হলো টনি ব্লেয়ার অ্যান্ড এসোসিয়েটস, উইন্ডরাশ এবং ফায়াররাশ। সে সময়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয় তিনি বৃহৎ বিনিয়োগ ব্যাংক জোপি মরগানের কাছ থেকে আয় করেছেন বছরে কুড়ি লাখ ডলার। তবে এসব প্রতিবেদনে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ আনা হয় নি। 


ম্প্রতি অবমুক্ত হওয়া বৃটিশ সরকারের নথিপত্রে প্রকাশ পায় যে তিনি বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে বৃটিশ জ্বালানি কোম্পানির স্বার্থে তিনি বেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। সে সময়েই প্রথম মেয়াদে সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বৃটেন সফর করেন।


২০১৪ সালেই খবর বেরোয়, টনি ব্লেয়ার কাজাখ সরকারের পরামর্শক হিসাবে কাজ করেছেন। ২০১১ সালে কাজাখাস্তানে কর্তৃত্ববাদী শাসক নুর সুলতান নজরবায়েভের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে পুলিশের গুলিবর্ষণে ১৫ জন বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা আর্ন্তজাতিক পরিসরে সামাল দেওয়ার জন্য মি ব্লেয়ার কাজাখ সরকারের পরামর্শকের কাজ করেন। ২০১৪ সালে ২৪ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করে দ্য গার্ডিয়ান। মি ব্লেয়ার কাজাখস্তান ছাড়াও কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমীরাত এবং কলাম্বিয়ার সরকারগুলো এবং বিভিন্ন বেসরকারি কোম্পানির পরামর্শক হিসাবেও কাজ করেছেন। কোভিড ১৯ মহামারির সময়ে যে সব দেশের যাত্রীদের যুক্তরাজ্যে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে লাল তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল, সেই তালিকা থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বাদ দেওয়ার জন্যও মি ব্লেয়ার তখনকার স্বাস্থ্যমন্ত্রী ম্যাট হ্যানকককে অনুরোধ জানিয়েছিলেন বলে ডেইলি মেইলে খবর বেরিয়েছিল। 


বাংলাদেশে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার যখন মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকার হরণের অভিযোগে পাশ্চাত্যে বিশেষভাবে সমালোচিত হচ্ছে, তখন তাঁর সফর ঘিরে তাই কৌতুহল তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। টনি ব্লেয়ারের ঢাকা সফরের উদ্দশ্য কী ছিল, তিনি বাংলাদেশ সরকারের অতিথি ছিলেন কিনা এবং তাঁর প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শক সেবা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে কিনা – এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর চেয়ে ইনিস্টিটউট ফর গ্লোবাল চেঞ্জের সঙ্গে ইমেইলে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো উত্তর মেলেনি। টনি ব্লেয়ারের পরামর্শক সেবা গ্রহণ করার বিষয়ে আলোচনা বা চুক্তির জন্য যদি এ সফর হয়ে থাকে, তাহলে তা কার সঙ্গে হবে – সরকার, নাকি আওয়ামী লীগ, সে প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। 


ইরাক যুদ্ধের কারণে বিপুলভাবে নিন্দিত সাবেক এই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীকে যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন বিশ্বের শান্তিবাদী অনেকেই, যাঁদের মধ্যে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার বিশপ টুটুও ছিলেন। ইরাক বডি কাউন্টের হিসাবে ওই যুদ্ধে এক লাখ ১০ হাজারেরও বেশী মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। জনমত জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইউগভ এর ২০১৭ সালের ৩১ জুলাই এক জরিপে দেখা গেছে বৃটেনেও প্রতি তিনজনে একজন যুদ্ধাপরাধের জন্য মি ব্লেয়ারের বিচার দেখতে চেয়েছিল। ওই দিনেই বৃটিশ হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল যে ইংলিশ আইনে আগ্রাসনকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নত করা হয় নি বলে তাঁর বিচার বৃিটেনে সম্ভব নয়। বাংলাদেশেও ইরাক যুদ্ধের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে সাধারণভাবে দায়ী করা হয়। 


এই পটভূমিতে তাঁর ঢাকা সফরের ব্যবস্থাপনায় গোপনীয়তা বজায় রাখা হয় বলে ধারণা করা যায়। সফরকালে তিনি যাতে কোনোধরণের বিক্ষোভ–প্রতিবাদের সম্মুখীন না হন সরকারের দিক থেকে সে রকম চেষ্টা থাকা এবং উচ্চপর্যায়ের বৈঠকগুলোর কারণে এই রাজনৈতিক সেবা গ্রহণের সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। 


মন্তব্যসমূহ

  1. টনি ব্লেয়ারের ট্র্যাক রেকর্ড, অতীতে যে ধরনের সরকারগুলোর সঙ্গে তিনি কাজ করেছেন তা বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশ সরকার তার আইডিয়েল ক্লায়েন্ট হতে পারে।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...