দেশের রাজনীতিতে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছে এবং সংঘাতপূর্ণ হয়ে ওঠার আশঙ্কায় যত উদ্বেগই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রহীন ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে দখলদার রাষ্ট্র ইসরায়েলিদের বিপুল বিধ্বংসী ও প্রাণঘাতী সংঘাতকে উপেক্ষা করা অসম্ভব। এই লেখা আপনি যখন পড়ছেন, তখন ইসরায়েলে হামাসের অতর্কিত ও সবচেয়ে বড় হামলা এবং তার পাল্টা প্রতিশোধের অভিযানে ১২ দিনে নিহত মানুষের সংখ্যা ৫ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি গাজার হাসপাতালও রেহাই পায়নি, যেখানে অন্তত ৫০০ জন নিহত হয়েছেন।
সামগ্রিকভাবে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা সর্বাধিক। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতি তিনজনে একজনই শিশু। আহত মানুষের সংখ্যাও অস্বাভাবিক রকম বেশি। ডাক্তার, জাতিসংঘের কর্মী, সাংবাদিক—কেউই হতাহতের তালিকা থেকে বাদ যাননি।
ইসরায়েলের দাবি, তাদের ওপর হামাস যে হামলা চালিয়েছে, তাতে নিহতের সংখ্যা হিটলারের ইহুদি নিধনযজ্ঞের পর এবারই সবচেয়ে বেশি। আর এখন যা ঘটছে, সময়ের দৈর্ঘ্য বিচার ও একক অভিযান হিসাবে এতে প্রাণহানির সংখ্যাও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসন ও দখলদারির পর সব রেকর্ড এখনো ছাড়িয়ে গিয়ে না থাকলেও দ্রুতই তা ছাড়িয়ে যাবে।
আয়তনে ঢাকা শহরের (৩০৬ বর্গকিলোমিটার) প্রায় সমান অবরুদ্ধ গাজায় (৩৬৪ বর্গকিলোমিটার) বিমান থেকে ছয় হাজারেরও বেশি বোমাবর্ষণের পরও বলা হচ্ছে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর স্থল অভিযান এখনো শুরু হয়নি। অভিযানের জন্য খণ্ডকালীন সেনা বা রিজার্ভিস্টদেরও জড়ো করা হয়েছে এবং গাজার কথিত সীমান্তে তারা অস্ত্রভান্ডার নিয়ে এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় আছে।
ইতিমধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সব ধরনের জরুরি পণ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানি সরবরাহ। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত ও অন্য রোগীদের ওষুধ যেমন শেষ হয়ে এসেছে, তেমনি খাবার পানিও তাঁদের দেওয়া যাচ্ছে না। মঙ্গলবার সকালে বিবিসি রেডিওর খবরে বলা হয়েছে, রোগীপ্রতি দৈনিক পানির বরাদ্দ ৩০০ মিলিলিটার, অর্থাৎ মাত্র এক গ্লাসে নেমে এসেছে। জাতিসংঘের যে ত্রাণ সংস্থা ফিলিস্তিনিদের জন্য কাজ করে, সেই ইউএনআরএডব্লিউর ভাষায়, গাজার পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ের সীমা ছাড়িয়েছে।
যুদ্ধ বা সংঘাতের সময়ে প্রথম বলি হয় ‘সত্য’, এমন একটি কথা বহুদিন ধরেই চালু আছে। ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলের অসম লড়াইয়ে তা অতীতে বহুবার প্রমাণিত হলেও এবারের মতো এতটা প্রকটভাবে আর কখনো অনুভূত হয়েছে বলে মনে হয় না। এটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছেছে। এসব মাধ্যমে অপ বা ভুয়া তথ্যের সমর্থনে পুরোনো ছবি, ভিডিও গেমসের ক্লিপ ইত্যাদির ছড়াছড়ি। মূলধারার মাধ্যমও এই প্রবণতা থেকে বাদ পড়ছে না। তা ছাড়া গাজায় তাদের অনুপস্থিতি, অথবা সীমিত উপস্থিতির কারণেও সংঘাতের উভয় দিকের ছবি যথাযথভাবে উঠে আসছে না।
দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রায় চার দশকের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে অবশ্য এ কথাও জোরের সঙ্গে বলতে পারি যে এখন অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ও দ্রুত ভুয়া বা অপতথ্য এবং অপপ্রচার ধরা পড়ে যাচ্ছে। প্রথম সারির আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে ভুল স্বীকার করতে হচ্ছে এবং তার প্রতিক্রিয়ায় অতি ক্ষমতাধর রাজনীতিকেরাও তাঁদের বয়ান বা ভাষ্য বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। মূলধারার সংবাদমাধ্যম দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি সহজে এড়াতে পারছে না।
দু-একটি উদাহরণ এখানে উল্লেখ করা যায়। ৭ অক্টোবরের হামলার ৩ দিন পর ১০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন যে হামাস জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের মতো মানুষ কতল (মাথা কেটে ফেলা) করেছে। এর আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তা কাবুৎযে নারী-শিশুদের কতল করে পুড়িয়ে ফেলার কথা বলেন। সিএনএন তা সম্প্রচার করে এবং প্রেসিডেন্ট বাইডেনও তাঁর বক্তৃতায় শিশু কতলের কথা বলেন। কিন্তু তথ্য যাচাইয়ে আরব সংবাদমাধ্যমগুলো দাবিটি ভিত্তিহীন বলে জানায়।
১২ অক্টোবর সিএনএন একটি ব্যাখ্যা দিয়ে বলে হামাসের হাতে শিশু বা নারী কতলের তথ্য নিশ্চিত করা যায়নি। একই দিনে হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র এক ব্যাখ্যায় বলেন যে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ছিন্নমস্তকের কোনো ছবি দেখেননি এবং স্বাধীনভাবে তথ্যটি যাচাই করা হয়নি। খবরটি প্রচার ও পরবর্তী ব্যাখ্যার মধ্যবর্তী দুই দিনে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম অসংখ্যবার খবরটি প্রচার হয় এবং জনমানসে তা কী ধরনের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, এটি সহজেই অনুমেয়।
এবার আমার ১৫ বছরের কর্মস্থল বিবিসির কথা বলি। নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার জন্য বিবিসি মোটামুটি বিশ্বব্যাপী পরিচিত। চলতি দফা সংঘাতের শুরুর দিকে তারা খবরে হামাসের হামলায় ইসরায়েলিরা ‘নিহত’ লেখে, কিন্তু ইসরায়েলি অভিযানে যাঁরা প্রাণ হারিয়েছেন, তাঁদের বেলায় লেখে ‘মৃত্যু’।
দর্শকদের প্রতিক্রিয়ার মুখে শেষ পর্যন্ত তারা ভুল স্বীকার করে বলে যে, শব্দ চয়নে অসাবধানতাবশত ভুল হয়েছে। এরপর, গাজায় বেসামরিক প্রাণহানি বন্ধ ও যুদ্ধবিরতির দাবিতে গত শনিবার লন্ডন ও যুক্তরাজ্যের অন্যান্য শহরে যে বিক্ষোভ হয়েছে, তার খবরে তারা বলে যে এসব প্রতিবাদে হামাসের সমর্থনে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। পরে তারা আয়োজকদের প্রতিবাদের মুখে তথ্যটি অসত্য ছিল বলে স্বীকার করে দুঃখ প্রকাশ করে।
তবে যে কথা না বললেই নয়, তা হলো, যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ ও বিরোধী দল লেবার পার্টির প্রকাশ্য চাপের মুখেও বিবিসি তার সম্পাদকীয় নীতিতে অটল থেকে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলছে না। ব্রিটিশ সরকার হামাসকে ২০২১ সালে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে এবং সে কারণে দেশের আইন অনুযায়ী তা বলার জন্য বিবিসির প্রতি প্রকাশ্যে আহ্বান জানালে বিবিসি তার ব্যাখ্যায় বলেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা কোনো পক্ষ নিতে পারে না। তথ্য হিসেবে তারা যুক্তরাজ্য সরকার কর্তৃক হামাস যে নিষিদ্ধ, সেটুকু উল্লেখ করে।
প্রসঙ্গত, আরও একটি বিষয় স্মরণ করা জরুরি যে একসময়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের গৃহীত প্রস্তাবের আলোকে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে যেকোনো ইসরায়েলি সেনা অভিযানের বর্ণনায় সংবাদমাধ্যমগুলো ‘দখলদার বাহিনী’ বিশেষণটি ব্যবহার করত। কালক্রমে অবশ্য এই বিশেষণ হারিয়ে গেছে। অথচ এই বিশেষণ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, যা সংঘাতটি অনুধাবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ভুল তথ্য ছড়ানো বা অপপ্রচার কখনো উদ্দেশ্যহীন হয় না। এগুলো হয় প্রধানত জনসম্মতি আদায় ও প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যে। চলমান সংকটেও ব্যতিক্রম ঘটার কোনো কারণ নেই। বিশ্বজনমত ও কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করলে তা অনুভূত হয়।
সন্দেহ নেই, হামাসের হামলা বিশ্বের নানা প্রান্তে মানুষকে স্তম্ভিত করেছে এবং তারা নিন্দিত হয়েছে। কিন্তু গাজার অভিযানের নিষ্ঠুরতা ও ব্যাপকতা সাধারণ মানুষকে এখন আরও বেশি বিচলিত করছে, ক্ষুব্ধ করছে।
একটি সশস্ত্র যোদ্ধা গোষ্ঠীকে নির্মূলের দুঃসাধ্য লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে গাজার পুরো ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীকে খাদ্য, পানীয়, জ্বালানি ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা এবং নির্বিচার বোমা ফেলে শায়েস্তা করার নীতি যে যুদ্ধাপরাধ ছাড়া কিছু নয়, সে কথা এখন শুধু মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, তা নয়; বরং বিবেকবান সাধারণ নাগরিকেরাই সোচ্চার হয়েছেন।
ইউরোপের শহরগুলোয় ইরাক যুদ্ধের সময়ের সঙ্গে তুলনীয় প্রতিবাদ-বিক্ষোভ হচ্ছে এবং তা অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে। ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রেই খোদ হোয়াইট হাউসের সামনে যুদ্ধবিরোধী ইহুদিরা বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। কূটনীতিতেও এর প্রভাব কতটা পড়বে, তা বলা মুশকিল।
তবে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে বলে তার সামরিক অভিযানের প্রতি পাশ্চাত্যের দেশগুলো যে শর্তহীন সমর্থন দিচ্ছিল, তাতে এখন কিছুটা হলেও সুর বদলেছে। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন মেনে চলার কথা বলা হচ্ছে, জরুরি সরবরাহ যাতে যেতে দেওয়া হয়, সে জন্য সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
আরব প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সফল না হওয়ায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিঙ্কেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর পূর্বনির্ধারিত দুই দিনের জায়গায় প্রায় এক সপ্তাহে গিয়ে ঠেকেছে।
নিউইয়র্ক টাইমস স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে ১৯৭৩ সালে কিসিঞ্জার টানা ৩৩ দিন ওই অঞ্চলে কূটনৈতিক মিশনে ছিলেন। এবার অবশ্য ব্লিঙ্কেনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট বাইডেনও সশরীর হাজির হয়েছেন। কিন্তু তাতেও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় সত্য-মিথ্যার ফারাক কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নতুন করে বলার অবকাশ আছে কি?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন