সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সুষ্ঠু ভোটের অক্ষমতা থেকেই কি দেখানোর আয়োজন

 


বছরের শুরুতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের মুখে শোনা গেল, নির্বাচন শুধু সুষ্ঠু হলে চলবে না, নির্বাচন যে সুষ্ঠু হয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে৷ তিনি আরো বলেছেন, ”ইনকারেক্ট পারসেপশন (ভুল ধারণা) হতে দেওয়া যাবে না৷ আমাদের দায় জনগণ ও আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর প্রতি৷ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীকে খাটো করে দেখা যাবে না, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক কমিউনিটির অংশ"। এর একদিন পর কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্র নিজেই ব্যর্থ হয়ে যাবে। 


মনে হচ্ছে, আমাদের নির্বাচন কমিশন হঠাৎ যেন জেগে উঠে বুঝতে পেরেছে যে নির্বাচন নামক একটু অতি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক অনুশীলনের যথাযথ ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তাঁদের কাঁধে এসে পড়েছে। অথচ গত ৬ ডিসেম্বর কমিশনারদের একজন মো. আলমগীর বলেছেন, সংসদ নির্বাচন নিয়ে  কমিশনের ওপর বিদেশিদের কোনো চাপ নেই এবং চাপ দেওয়ার কোনো অধিকারও তাঁদের নেই। প্রশ্ন হচ্ছে, গত সপ্তাহ চারেক সময়ে কী ঘটেছে এবং কী তাঁরা আশা করেছিলেন যে নিরুদ্বেগ ভাব ছেড়ে এখন তাঁরা এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন?  


অতিরঞ্জন, আংশিক সত্য কিম্বা তথ্য বিকৃতির সঙ্গে রাজনীতির এক ধরণের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে। তাঁদের কথায় সবসময়ে ধারাবাহিকতাও থাকে না। আজ যা বলেন, কাল তার উল্টোটাও বলতে পারেন। শাহজাহান ওমরের কথাই ধরুন – জেলে যাওয়ার আগে তিনি গণতন্ত্রের ত্রাণকর্তা হিসাবে পিটার হাসকে দেবদূত বলতেও দ্বিধা করেননি। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়নসূত্রে তাঁর কথার সুর পুরোই বদলে গেছে। তবে তিনিও বলছেন, ৬– থেকে ৭০ শতাংশ ভোট না দেখাতে পারলে স্যাংশন আসবে। একই রকম সুর এখন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান – বিশেষ করে সাংবিধানিক দায়িত্বপ্রাপ্তদের কন্ঠে শোনা গেলে তো সেটা ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।  প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনারদের সর্বসাম্প্রতিক বক্তব্যে তাই কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি। 


এ ক্ষেত্রে সবার আগে জিজ্ঞাস্য হচ্ছে, ’নির্বাচন সুষ্ঠু হলে চলবে না, তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে’ কথাগুলো নির্বাচন ক্ষমতাসীন দলের হাতের মুঠোয় চলে যাওয়ার পর কেন বলা হচ্ছে? ৩০০ আসনের মধ্যে কমিশন কি ৩০টি আসনও দেখাতে পারে যেখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে অন্য আরেকটি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হবে? 


প্রায় প্রতিটি আসনে প্রার্থীদের মুখে আমরা শুনছি, ’এখানে ঈগল মার্কাই নৌকা মার্কা, কিম্বা ’এখানে ট্রাক মার্কাই নৌকা মার্কা’। এমনকি বর্তমান সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর লাঙ্গল মার্কা পোষ্টারেও লেখা ’আওয়ামী লীগ সমর্থিত’। অর্থাৎ, ভোট যাকেই দেওয়া হোক, তা হবে নৌকা প্রতীকের। ফলে আওয়ামী লীগের টানা চতূর্থ মেয়াদ শুধু নিশ্চিত না, দেখা যাবে শেষ বিচারে প্রায় শতভাগ আসনই তাদের। এটি অনুমান নয়, এটি নিশ্চিত। এর অন্যথা হওয়ার পথ নেই। 


এই ’পূর্ব নির্ধারিত ফলাফল’কে ’সুষ্ঠূ নির্বাচন’ হিসাবে ’বিশ্বাসযোগ্যতা’ দেওয়ার জন্য সিইসির যে ব্যকুলতা, তাকে অসহায়ত্ব বলে হয়তো তাঁর প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখানো যেত, কিন্তু তিনি যখন নির্দিষ্ট করে বলেন আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে ’ ইনকারেক্ট পারসেপশন’ হতে দেওয়া যাবে না, তখন আর যা–ই হোক সৎ উদ্দেশ্যের প্রতিফলন ঘটে না। যে নির্বাচন ইতিমধ্যেই একটি দলের হাতের মুঠোয়, সেই নির্বাচনে গোষ্ঠীগত বা গোত্রগত দখলদারির লড়াইয়ে সাধারণ ভোটারদের আর কী স্বার্থ বা আগ্রহের অবকাশ থাকে? এখন যেসব অর্ন্তদলীয় রক্তারক্তি ঘটছে ও সহিংসতা হচ্ছে, তার দায় প্রধানত সরকারের হলেও নির্বাচন কমিশন কোনোভাবেই দায়মুক্ত হয় না। 


ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ’আমি’ আর ’ডামির মধ্যে সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ বন্ধে কমিশন কী করতে পারত, তার কিছুটা উত্তর আইনের মধ্যেই রয়েছে। মনোনয়নপত্রের বাছাইপর্বেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে দলীয় গঠনতন্ত্রের বিধি ভেঙ্গে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় দায়িত্বে থাকা সদস্যদের প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দিয়েছে। এতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে নৌকা প্রতীকে নির্বাচিত ২৮ জন সংসদ সদস্য এখন নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে ঈগল বা ট্রাকের মতো প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হয়েছেন। 


সংসদে দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিলে সংবিধানের ৭০ ধারায় যে সংসদ সদস্য তাঁর পদ হারাতেন, সেই সংসদ সদস্য এখন দলের প্রার্থী ও প্রতীকের বিরুদ্ধে মানুষের ভোট চাইছেন। কমিশন কীভাবে এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনুমোদন করতে পারে? দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ ছাড়া দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থিতা বাতিলের পদক্ষেপ নেওয়াই যে যৌক্তিক হতো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কমিশন একটু কঠোর হলে ক্ষমতাসীন দল এভাবে নির্বাচনকে নিজেদের ইচ্ছামত সাজানোর সুযোগ পেত ন। এমনকি বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালেও কমিশন অন্তত নির্বাচনের নামে জোট শরিকদের আসন ভাগাভাগির অনুশীলনে সহযোগীর ভূমিকা থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারত।  


আমাদের নির্বাচন কমিশন আইনগতভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর তদারকি বা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ কিছু ক্ষমতার অধিকারী। রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন আইনে কমিশন এসব ক্ষমতা পেয়েছে, যার ভিত্তিতে তারা রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন দেয় এবং তা বাতিলও করতে পারে। এ আইনে প্রত্যেকটি দলের অনুদান নেওয়া, অঙ্গ সংগঠন রাখতে পারা না পারার মত বিষয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এ আইনের ৯ এর খ অনুসারে দলের মনোনীত প্রার্থী প্রতীক বরাদ্দ পান, সেহেতু  দলীয় শৃঙ্খলার ক্ষেত্রেও কমিশনের ভূমিকা গ্রহণের অবকাশ আছে। স্পষ্টতই: কমিশন সে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে। 


রাজনৈতিক দল বিধি মেনে চলায় রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধ্য করার প্রশ্নে কমিশন যে আগ্রহী নয়, তা এর আগেও দেখা গেছে। এ আইনে বিদেশিদের  কাছ থেকে অনুদান বা উপহার নেওয়া নিষিদ্ধ হলেও কোভিডের সময়ে চীন সরকারের চিকিৎসাসামগ্রী উপহার হিসাবে গ্রহণ করার কারণে কোনো রাজনৈতিক দলের কাছে কমিশন ব্যাখ্যা চেয়েছে বলেও শোনা যায় নি। 


’নৌকায় ভোট দিলেও নৌকা, ঈগলে ভোট দিলেও নৌকা, আমরা সবাই নৌকা’ স্বীকারোক্তিটি বহুল নিন্দিত সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের মুখে (ভিডিওতে) শোনা । এরকম সাজানো আয়োজন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে বলে অন্তিম মুহুর্তে সিইসি ও সহযোগী কমিশনারদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা এখন একটু বেশিই মনে হচ্ছে। প্রার্থিতা বাতিল, আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য মামলা কিম্বা পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষপাত মূলক আচরণের জন্য দু–একজনকে বদলি,  সবাই এখন এগুলো লোকদেখানো বলেই বলছেন। 


ভোটের দিন পর্যন্ত এগুলো হয়তো আরো বাড়বে। কমিশন সুষ্ঠূ ও স্বচ্ছতার সার্টিফিকেট নেওয়ার ব্যবস্থাও সম্পন্ন করে ফেলেছে। চীন, রাশিয়া এবং ভারতসহ ১১টি দেশ থেকে বিশেষভাবে আমন্ত্রিতসহ মোট  ৮০ জন পর্যবেক্ষক আসছেন। ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসন ভয় দেখানো থেকে শুরু করে নানারকম উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়েছে। 


রাষ্ট্রীয় সুযোগ–সুবিধাকে হাতিয়ার করার কারণে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়ানো হয়তো খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু এগুলোর কোনো কিছুই যেহেতু ভোটারদের কাছে ক্ষমতাসীন দলের বিকল্প বেছে নেওয়ার সুযোগ দেবে না, সেহেতু একে বিশ্বাসযোগ্য করার আর কোনো অবকাশ নেই। কমিশন বরং এখন ভাবতে পারে যে কীভাবে তারা ব্যর্থতা স্বীকার করে নিতে পারে।  


(৪ জানুয়ারি, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...