ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিকেরা আসন ভাগাভাগিতে প্রত্যাশা অনোযায়ী তো দূরের কথা, আগের দুই নির্বাচনের তুলনায়ও কমসংখ্যক আসন ভাগে পেয়িছেল। ফলে তারা মনের কষ্ট মনে রেখে নির্বাচনে নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে মরিয়া ছিল।
এসব দলের শীর্ষ নেতারা বিজয় নিশ্চিত করতে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিজেদের জন্য নিশ্চিত করেছিলেন। দলের ছোট মাপের নেতাদের দলীয় প্রতীকে নির্বাচনী লড়াইয়ে নামিয়ে দিয়ে এসব শীর্ষ নেতা নৌকা প্রতীকের বিপরীতে যেন আওয়ামী লীগের কেউ স্বতন্ত্র হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় না থাকেন, সেটা নিশ্চিত করার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশেরই ভরাডুবি হয়েছে। নির্বাচনে জয়–পরাজয় স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষমতাসীন জোট ও দলের নেতারা পরাজয়ের কারণ হিসাবে যা বলেছেন, বা যেসব অভিযোগ করেছেন, তাতে কৌতুহলী মনের প্রশ্ন, জয়–পরাজয় কোথায় নির্ধারণ হয়েছে?
জোটের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেছেন, তিনি জনগণের ভোটে নয়, কারচুপির ভোটে পরাজিত হয়েছেন। তিনি হেরেছেন প্রায় ২৩ হাজার ভোটে। তাঁর অভিযোগ প্রশাসন অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
মজার কথা হলো হাসানুল হক ইনু কিন্তু মনে করছেন, সারাদেশে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। মাত্র ৫ শতাংশের মতো অনিয়ম হয়েছে। ওই ৫ শতাংশের মধ্যে তিনি প্রথম আলোর কাছে জেপি নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর কথাও বলেছেন। সামরিক–বেসামরিক সব আমলেই সংসদীয় রাজনীতিতে সামনের সারিতে থাকা ডানপন্থী নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নিজে কোনো অভিযোগ না করলেও তাঁর মালিকানাধীন পত্রিকায় নির্বাচনের দিনে শেষ এক ঘন্টার ভোটের উচ্চ হার নিয়ে সমালোচনা শীর্ষ প্রতিবেদন হিসাবে ছাপা হয়েছে।
একই রকম অভিযোগ করেছেন ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তিনি আইনজীবীর মাধ্যমে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে অভিযোগ দাখিল করেছেন। আওয়ামী লীগের বৃহত্তর ঐক্যের ফোরাম, মহাজোটের শরিক গত দুই সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিরও কয়েকজন অতি পরিচিত মুখ পরাজিত হয়েছেন। পরাজয়ের পর তাঁরাও ক্ষুব্ধ।
ডেইলি স্টার জানিয়েছে, জাতীয় পার্টির নেতা জিএম কাদের বলেছেন,”নির্বাচন হয়েছে সরকারের নিয়ন্ত্রণে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কে জিতবে, আর কে জিতবে না।” জোটের শরিকেরা আসন ভাগাভাগির হিসাব বুঝে পাননি বলে যে অতিকষ্টে কথাগুলো বলছেন ব্যাপারটা হয়তো সে ভাবে ব্যাখ্যা করা যেত। কিন্তু আওয়ামী লীগ নৌকার বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দেওয়ায় দলের পরাজিত প্রার্থীরাও মুখ খুলেছেন।
অভিযোগ যে দলের মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে উঠেছে,তা–ই নয়। দলের অত্যন্ত প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত ব্যক্তিদের মধ্যে থেকেও উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারীদের একজন ও দলের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনে অলৌকিক শক্তি কাজ করায় ভোটে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। মাদারীপুরে যে আসনে তিনি হেরেছেন, সে আসনে দলটির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য তাহমিনা বেগম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ঈগল মার্কা নিয়ে প্রায় ৩৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন। প্রশাসনকে নিজের লোক দাবি করে আওয়ামী লীগের এই প্রার্থী বলেন, ‘ডিসি, এসপি, ওসি, ইউএনও সব আমাদের লোক, এই সরকারের লোক। এর বাইরে একটি শক্তি কাজ করল।’
সুপরিচিত শিল্পী মমতাজ অভিযোগ করেছেন, কিছু জায়গায় অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। তাঁর কথায়, বিদেশে আছে, মারা গেছে—তাঁদের ভোটও দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যকার লড়াইয়ের কারণে এসব অপ্রিয় তথ্য এখন প্রকাশ হয়ে পড়ছে। একই রকম অভিযোগ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসেছে।
আবার চমক দেখিয়ে বিজয়ী হয়েছেন বিএনপির সাবেক জোটসঙ্গী জেনারেল ইবরাহিম। তাঁর আসনে দুপুরের আগেই বর্তমান সংসদ সদস্য জাফর আলম নানারকম অভিযোগ তুলে রণেভঙ্গ দেওয়ার ঘোষণা দেন। কথিত কিংস পার্টি তিনটির কথা না হয় হিসাবে না–ই ধরলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও জোটের নেতাদের অভিযোগ কি নিছক পরাজয়ের অজুহাত বলে নাকচ করে দেওয়া যাবে? মোবাইল ফোনোর ক্যামেরার কারণে ভোটের যেসব চিত্র পাওয়া গেছে এবং অস্বাভাবিক ভোটের বিশ্লেষণ এখন পাওয়া যাচ্ছে তাতে এগুলো নাকচ করা যায় না।
বিজয়ী ও বিজিতের মধ্যে ভোটের ব্যবধান কেমন ছিল, তার বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ১০৭ টি আসনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জামানত হারিয়েছেন। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২১টি আসনে বিজয়ীরা দুই লাখেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে প্রতিদ্বন্দ্বীকে হারিয়েছেন। এ ধরণের ব্যবধানের অস্বাভাবিকতা তুলে ধরতে গিয়ে জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু যে নজির তুলে ধরেছেন, তা হলো ১টি কেন্দ্রে আমার প্রতিপক্ষ (আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী) পেয়েছেন ২ হাজার ৮০০ ভোট, ওই কেন্দ্রে আমি নৌকা প্রতীকে মাত্র ৮৫ ভোট পেয়েছি।’ এই ভোটের চিত্র দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়, কতটা অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ড হয়েছে।
ভোটের হারে এর চেয়েও বেশি অস্বাভাবিকতার নজির অবশ্য রয়েছে ২০১৮ সালের কথিত অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে। এ অস্বাভাবিকতা নিয়ে বিশদে গবেষণা করেছে বেসরকারি নাগরিক সংগঠন, সুশাসনের জন্য নাগরিক। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজও ভোটিং ইন এ হাইব্রিড রেজিম:এক্সপ্লেনিং দ্য ২০১৮ বাংলাদেশ ইলেকশন বইতেও বিষয়টির ওপর আলোকপাত করেছেন। সম্প্রতি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এ কে এম ওয়ারেসুল করিম তাঁর নতুন প্রকাশনা ’ক্যান পার্টি–লেড গর্ভণমেন্টস ডেলিভার ফ্রি এন্ড ফেয়ার ইলেকশন্স ইন বাংলাদেশ’–এ কেন্দ্রভিত্তিক ভোটের বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন কী অবিশ্বাস্যরকম জালিয়াতি হয়েছিল।
ওয়ারেসুল করিম কেন্দ্রভিত্তিক ফল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ২০১৮ সালে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী ছিল যেসব আসনে, সেগুলোতে মোট ভোটকেন্দ্র ছিল ৩৮ হাজার ১০২টি এবং তার মধ্যে ১৫ হাজার ৩৫২টি কেন্দ্রে তাদের ভোট ছিল ১০০ এর নীচে। শূন্য ভোট ছিল ১ হাজার ১৭৯টি কেন্দ্রে। ১৪৯ টি আসনের ১৪০৬ টি ভোট কেন্দ্রে বিএনপির জোট ঐক্যফ্রন্ট ভোট পেয়েছে মাত্র একটি করে এবং ২১১ টি আসনের ৩ হাজার ৭৪২ টি কেন্দ্রে ১০টি বা তার কম করে। ১০ হাজারের বেশি কেন্দ্রে বিএনপির জোটের ভোটের হার ছিল এক শতাংশের চেয়েও কম (০.৮৫)। কিন্তু বিপরীতে মহাজোটের পাওয়া ভোটের হার ৯৬.৯ শতাংশ। ওই নির্বাচনে ২১৩টি কেন্দ্র শতভাগ এবং ২ হাজার ২০৩ টি কেন্দ্রে ৯৫ থেকে ১০০ শতাংশ ভোট পড়েছে। আর ওই কেন্দ্রগুলোতে মহাজোটের ভোটের অংশ ছিল গড়ে ৮৯ শতাংশ। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত যে নির্বাচনে বিএনপি সবচেয়ে কম আসন পেয়েছিল, সেই ২০০৮ সালে তাদের পাওয়া ভোটের হার ছিল ৩৭.৪৫ শতাংশ।
এসব পরিসংখ্যানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের ’প্রশাসন আমাদের, ডিসি, এসপি ইউএনও, ওসি আমাদের’ এবং জি এম কাদেরের ’সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কে জিতবে, কে জিতবে না’ মন্তব্যগুলো মিলিয়ে দেখুন। ২০১১ সালে একতরফাভাবে সংবিধান সংশোধন করে তত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দিয়ে যে সাংবিধানিকতার ধারা চালু করা হয়েছে, তাতে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী শুধু নয়, তাঁদের অনুমোদিত নয় – এমন কারো নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা স্থায়ীভাবে তিরোহিত হয়েছে।
নির্বাচন যে অর্থবহ হলো না, তার দায় কেউ কেউ এখনো ক্ষমতাসীন দল ছাড়াও বর্জনকারীদের ওপর চাপানোর যুক্তি দিচ্ছেন। ২০১৪ সাল এবং ২০১৮ সালের অভিজ্ঞতার পর শুধু বিএনপি নয়, সরকারের জোটসঙ্গী ছাড়া ডান–বাম–মধ্যপন্থী কোনো দলই নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। নির্বাচনে অংশ নিয়ে নির্বাচনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা বা কারচুপির প্রমাণ আরও ভালোভাবে তুলে ধরা যেত বলে যারা যুক্তি দিতে চান, তাঁরা কার্যত নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য দায়ী দলকে দায়মুক্তি দিচ্ছেন। বর্জনকারীদের কাঁধে দায় চাপানোর অন্য আর কোনো ব্যাখ্যা নেই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন