দেশে যে দ্বাদশ সংসদ গঠিত হয়েছে, তাতে বিরোধী দল কোনটি এবং বিরোধীদলীয় নেতা কে, তা নিয়ে কয়েক দিন ধরে সংবাদপত্রের পাতায় নানারকম জল্পনার কথা ছাপা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সদস্যপদ আছে, কিন্তু দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে দলের প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন, এমন কেউ কেউ বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা নিতে আগ্রহী বলে প্রকাশ্যে অথবা অপ্রকাশ্যে তাঁদের আকাঙ্খার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু বিরোধী নেতা হতে আগ্রহী কেউ স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের নিয়ে আলাদা কোনো দল গঠনেরও উদ্যেগ নেননি। ৬২ জন স্বতন্ত্র সদস্যের ৫৮ জনই আওয়ামী লীগের এবং দলীয় পরিচয় হারাতে রাজি নন। ফলে স্বতন্ত্রদের কোনো গ্রুপ গঠিত হলেও তাকে বিরোধীদল বলার অর্থ হবে জাম গাছের ফলকে আম নামে ডাকা।
তাঁরা আশা করছেন, কোনো এক সময়ে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের স্বতন্ত্র অবস্থান নিতে বলবেন এবং তারপর তাঁরা আলাদা গ্রুপ গঠন করে বিরোধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করবেন। আরেকটি মেয়াদে সবাই বিরোধী দলের ভূমিকায় কিছু ব্যক্তির অভিনয় প্রত্যক্ষ করবেন এবং তার বিনিময়ে ক্ষমতাসীন দলে পাত্তা না পাওয়া অথবা কথিত বঞ্চনার শিকার এসব ব্যক্তি বিরোধীদলের প্রাপ্য সুযোগ–সুবিধা ভোগ করতে পারবেন। সহজভাবে বললে এরা হতে চান ডামি বিরোধী দল। গত দুটি সংসদে বিরোধী দল হিসাবে জাতীয় পার্টির নেতারা যে ভূমিকায় অভিনয় করে দেখিয়েছেন, তাতে এমন ভাবনা অমূলক নয়।
সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী দল কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে সংসদীয় বিরোধী দলের ইতিহাস কেমন, তা অনেকেই আমরা বিস্মৃত হয়েছি। জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ওয়েবসাইটে বিরোধী দলীয় নেতাদের তালিকাটা সবাই একটু দেখে নিলে বিষয়টি অনুধাবন সহজ হতে পারে। ওই তালিকায় প্রথম সংসদে কোনো বিরোধী দলীয় নেতার নাম নেই। কারণ, ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত প্রথম জাতীয় সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না এবং কেউ বিরোধীদলীয় নেতাও ছিলেন না।
সেবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২৯৩টি আসনে জয়ী হয়েছিল এবং বাকি সাতটির মধ্যে পাঁচজন স্বতন্ত্র ও দুজন বিরোধী রাজনীতিক জাতীয় লীগ নেতা প্রবীণ রাজনীতিক আতাউর রহমান খান ও জাসদের আব্দুস সাত্তার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ওই সংসদে চতূর্থ সংশোধনী পাসের মাধ্যমে সব দলের বিলুপ্তি ঘটিয়ে বাকশালের প্রতিষ্ঠা করা হয়। আমাদের জাতীয় সংসদে প্রথম বিরোধী দল আর্বিভূত হয় জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৯৭৯ সালে এবং আওয়ামী লীগ ছিল সেই প্রথম বিরোধী দল। বিরোধীদলীয় নেতা হয়েছিলেন আসাদুজ্জামান খান। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেমন পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নতুন রেকর্ড গড়েছেন, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা হিসাবে সর্ব্বোচ্চ তিনবারের রেকর্ডও তাঁর।
আওয়ামী লীগ প্রধান হিসাবে শেখ হাসিনা যে তিনবার বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করেছেন, তারমধ্যে প্রথমটি সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের আমলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থায় এবং পরের দু’বার সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর। গত দুটি সংসদের কার্যক্রম বিবেচনায় নিলে সংসদীয় ব্যবস্থার যে অধপাত ঘটেছে, তাতে সংসদীয় বিরোধী দল হিসাবে জাতীয় পার্টি এবং তার নেত্রী রওশন এরশাদ ভূমিকাকে কার্যত অভিনয় গণ্য করা ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। কেননা, দুবারই তাঁরা নির্বাচন করেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার ভিত্তিতে এবং প্রথমবারে তাঁরা মন্ত্রীসভায়ও ছিলেন আবার একইসঙ্গে বিরোধী দলের আসনও দখলে রেখেছিলেন।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতায় এবারও কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। এমনিতেই রাজনীতিতে তারা খুব একটা সাধারণ মানুষের কাতারে ছিলেন না। সরকারও যে তাদের প্রতিপক্ষ ভাবে না তার প্রমাণ মেলে গত ১০ বছর সংসদে প্রতিনিধিত্ব না থাকা সত্ত্বেও এবং এখনো ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের সব সমালোচনার লক্ষ্য হচ্ছে বিএনপি ।
ঐতিহাসিকভাবেই জাতীয় পার্টির বিচরণ ক্ষমতার অলিন্দে। ফলে এবারে আওয়ামী লীগ তাদের ২৬টি আসন ছাড়লে তাঁরা সেটাই মানতে বাধ্য হয়েছিলেন। সংসদে বিরোধী দলের স্বীকৃতির জন্য এক দশমাংশ অর্থাৎ ৩০টি আসন প্রয়োজন জেনেও তাঁরা তখন নিরুপায়। শেষ পর্যন্ত তাঁরা রাখতে পরেছেন ১১টি। এখন আওয়ামী লীগকেও তাঁরা বোঝাতে অক্ষম যে তাঁদের ১৫টি আসন খোয়াতে হলো কেন? বিরোধী দলের স্বীকৃতির বিষয়টির জন্য তাঁরা আগেও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের করুণার ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, এখনো তা–ই। তবে এবার করুণা প্রয়োজন অনেক বেশি। বাস্তবে যা একদলীয় সংসদ, তাকে প্রসাধনের মতো প্রলেপ দিয়ে বহুদলীয় দেখানোর চেষ্টা হবে অনৈতিক।
সংসদীয় ইতিহাসের পটভূমিতে কথিত সংসদীয় বিরোধী দল জাতীয় পার্টির এমন করুণ পরিণতি মোটেও অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু যেটা অ্রপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য, তা হচ্ছে দলটির বর্তমান নেতৃত্বের লুকোচুরি খেলা। দলটির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে দলটির চেয়ারম্যান জি এম কাদের শেষ পর্যন্ত যেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা নিয়ে তাঁর দলের অসন্তোষের নানা রকম ব্যাখ্যা থাকতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে তিনি তাঁর অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরির কোনো ব্যাখ্যা দেন নি।
নির্বাচনে বিপর্যয়ের পর দলের মধ্যে যখন কঠোর সমালোচনা ও বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছেন, তখনও তিনি খোলাসা করে কিছুই বলছেন না। সরকারের কাছ থেকে টাকা নেওয়া এবং স্ত্রীর মনোনয়ন নিশ্চিত করার বিষয়ে যেসব অভিযোগ দলের নেতারা করেছেন, তার জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেছেন, ’টাকা যে পাইছি, এর সাক্ষী–প্রমাণ কী?’ বিষয়টি যেন এমন যে রাজনীতিকেরা তাঁদের এবং দলের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে সবসময়েই স্বচ্ছ্বতার নীতি অনুসরণ করেন। রাজনীতির কেনাবেচায় সাক্ষী থাকে নাকি? জড়িত পক্ষগুলোর কেউ সংক্ষুব্ধ হলেই সত্য বেরিয়ে পড়ে।
এরপর সমকালকে দেওয়া আরেকটি সাক্ষাৎকারে জি এম কাদের আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতার পর্যায়টি যেভাবে তুলে ধরেছেন, তা খুবই রহস্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবহ। তিনি ওই দেনদরবারে মধ্যস্থতাকারীদের ’তারা’ বলে উল্লেখ করে এক অদৃশ্য প্রভাবকের কথা বলেছেন। অথচ ’তারা’ কারা প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছেন, ”এটা এখন বলতে পারব না। এগুলো নিয়ে কথা বলব না। তবে এমন একটা পরিবেশ ছিল, জাতীয় পার্টির নেতারাও নির্বাচনের পক্ষে ছিলেন। নইলে দলের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিতে পারে। অনেক সমস্যা হতে পারে। দলের রাজনীতি ও দল টিকিয়ে রাখতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছিল বেস্ট চয়েজ। অন্য কিছু আমাদের জন্য খারাপ হতে পারে।”
তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরাসরি দরকষাকষির কথা বলেন নি – একটি তৃতীয়পক্ষ ’ তারা’–এর কথা বলেছেন। এই তারা কেন ও কীভাবে এত ক্ষমতাশালী যে তাঁর দলের অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করতে সক্ষম? তাদের পরিচয় জানার অধিকার প্রতিটা নাগরিকের রয়েছে। কিন্তু তিনি তা গোপন করছেন।
লুকোচুরি প্রসঙ্গে গত আগস্টে তাঁর প্রতিবেশী দেশ ভারত সফরের কথা উল্লেখ করাও জরুরি। তিন দিনের ভারত সফর শেষে গত বছরের ২৩ আগস্ট দেশে ফিরে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনার কথা জানান। ভারত সরকারের আমন্ত্রণে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন জানালেও সেখানে কার সঙ্গে আলাপ হয়েছে এবং কী বিষয়ে হয়েছে, সেটি তিনি বলতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি বলেন, ”তারা যদি প্রকাশ করতে চান, করবেন। কিন্তু তাদের অনুমতি ছাড়া আমি কিছু বলতে পারব না।”
বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হিসাবে ভিন্ন একটি দেশ সফর করে কার কার সঙ্গে আলোচনা হলো সেটাও গোপন করতে চাওয়া সম্ভবত শুধু বাংলাদেশেই সম্ভব। সরকারের আনুকূল্য বা সম্মতি ছাড়া এমন গোপনীয়তা বা অস্বচ্ছ্বতার আশ্রয় নেওয়া কি সম্ভব ছিল? আর এ রকম অস্বচ্ছ্বতার রাজনীতিকে মানুষ বিশ্বাস করবে, সেটা তাঁরা কীভাবে আশা করেন? যারা প্রকৃত ডামি বিরোধী দলের আত্মহনন প্রত্যক্ষ করতে চান, তাঁরা সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে নিরাশ হবেন না।
(১৮ জানুয়ারি, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন