আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত কয়েক মাসে বহুবার একটি জরিপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ৭০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন আছে, তিনি আবার নির্বাচিত হবেন। ওই জরিপ গত আগস্টে প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। বহুল আলোচিত সেই জনমত জরিপে রেকর্ড ৯২ শতাংশ ভোটার জানিয়েছিলেন তাঁরা ভোট দিতে চান।
যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের উল্লেখ করা ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোটকে সঠিক বলে গণ্য করা হয়, তাহলেও ভোট দিতে আগ্রহী অন্তত ৫০ শতাংশ ভোটার ভোট দিতে যান নি। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন আছে অনেক। কেননা, ভোট শেষ হওয়ার ঘন্টাখানেক আগে যেখ্নে ভোটের হার ছিল ২৬ শতাংশ, সেখানে এক ঘন্টায় আগের সাত ঘন্টার অর্ধেকেরও বেশি ভোট পড়া শুধু অস্বাভাবিক নয়, সম্ভব কিনা – সেটাও প্রশ্ন।
এই যে বিপুলসংখ্যক মানুষের ভোট দিতে না যাওয়া, তার কারণ যে বিরোধী দল বিএনপিসহ অন্যান্য নির্বাচন বর্জনকারীদের হরতাল কর্মসূচি, এমন দাবি কেউই করেননি, করবেনও না। কারণ, হরতাল আহ্বানকারীরা কেউ হরতাল কার্যকর করার কোনো চেষ্টাই করেনি। তা সে মাঠে মিছিল–পিকেটিংয়ের মাধ্যমে হোক, অথবা বোমাবাজি বা আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমেই হোক।
এবারের বর্জনপীড়িত একতরফা নির্বাচনের মতো নির্বাচন এর আগে আরো দুবার হয়েছে – ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। প্রথমটি করেছিল বিএনপির সরকার, যখন জামায়াতে ইসলামী তাদের সঙ্গী ছিল না, তারা ছিল অন্যতম বিরোধীদল। তখন প্রধান বিরোধীদল ছিল আওয়ামী লীগ। আর ২০১৪ সালে যখন আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচন করে, তখন বিরোধী শিবিরে বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী।
ওই দুই নির্বাচন কেমন হয়েছিল, তার ইতিহাসটা একটু ঝালিয়ে নিলে এবারের নির্বাচনের সঙ্গে মিল–অমিলগুলো সহজেই বোঝা যাবে। ১৯৯৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির ইত্তেফাক– এর খবর বলছে, ভোটের দিনে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এবং আলাদাভাবে জামায়াতে ইসলামী দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট পালন করেছিল। তারা ওই ধর্মঘটকে ’গণকারফিউ’ নাম দিয়েছিল। সেদিন সারা দেশে সংঘর্ষে ১০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হন। ২৮০০ ভোট কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করতে বাধ্য হয়েছিল নির্বাচন কমিশন। ভোটের হার ছিল ২৬ শতাংশ।
২০১৪ সালে অন্যদের বর্জনের কারণে ১৫৩ আসনে ভোটের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় আওয়ামী লীগের বিজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। তবুও ভোটের দিন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮–দলীয় জোট দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করেছিল। ৬ জানুয়ারির সমকাল পত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে, সেদিন ব্যাপক মাত্রায় সহিংসতা হয় এবং ২২ জন প্রাণ হারায়। ১৪৬ আসনে ভোটের হার দেখানো হয় ৪০ শতাংশ।
এবারে নির্বাচনের দিন যত সহিংসতা হয়েছে, তাতে নির্বাচন বর্জনকারী কোনো দলের ভূমিকার কথা কেউ বলেননি। বিএনপি, জামাত কিম্বা বামপন্থীরা কেউ কোনো সহিংসতার আশ্রয় নেননি। যতটা সহিংসতা হয়েছে, তার সবই আওয়ামী লীগের নিজেদের উপদলীয় সংঘাত। এবারও মৃত্যু ঘটেছে, কেউ কেউ আহত হয়েছেন। কিন্তু এসবই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর জন্য আওয়ামী লীগ দলীয় শৃঙ্খলার অর্গল খুলে দেওয়ার পরিণতি।
নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর চেষ্টায় ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করার চেষ্টাও কম হয়নি। ভোট দিতে না গেলে নানা রকম রাষ্ট্রীয় সুবিধা, বিভিন্ন ভাতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার হুমকির কথা বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনায় ছিল। ভোটের দিন বিভিন্ন জায়গায় ভোটারদের আনতে নানাধরণের প্রণোদনা দেওয়ার কথাও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। বিদেশি পত্রিকা ফিনান্সিয়াল টাইমস–এর সংবাদদাতা লিখেছেন, ঢাকাতেই একটি বস্তির কাছের ভোটকেন্দ্রে তিনি অনেক ভিড় দেখেছেন, যারা তাঁকে বলেছেন, তাঁরা প্রতিশ্রুত বিরিয়ানির প্যাকেটের জন্য অপেক্ষা করছেন। কয়েকটি জায়গায় নগদ টাকা বিতরণের ভিডিও –ছবিও প্রকাশিত হয়েছে।
এত সব প্রণোদনার পরও ভোটের হার এত কম হলো কেন? তারও একটা উত্তর মেলে আইআরআইয়ের জরিপে। ৬৯ শতাংশ মানুষ বলেছিল, তারা কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সমর্থন করে না। তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে সমর্থন ছিল ৪৪ শতাংশ, আর সর্বদলীয় সরকারের অধীনে ২৫ শতাংশ। ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে যত বিতর্ক ও অভিযোগ আছে, স্পষ্টতই: সেগুলোর একটা প্রভাব দেশের বেশিরভাগ মানুষের ওপর পড়েছে। বর্জনপীড়িত একতরফা নির্বাচন এবং সব দলের অংশগ্রহণের পরও নির্বাচনকে দলীয় সরকার কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, তার তিক্ত অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তিতে কে অংশ নিতে চায়?
নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হওয়ার অন্যতম কারণ নিশ্চয়ই বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোর নির্বাচন বর্জন, কেননা ভোটারদের সামনে বিকল্প অনুপস্থিত। তবে, সেটাই একমাত্র কারণ নয়। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের আসন ভাগাভাগি ও নিজেদের ডামি প্রার্থী দাঁড় করিয়ে নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে মানুষের ভোটকে কার্যত মূল্যহীন করে দেওয়া হয়েছে। এই বিষয়টি কারোরই ভালো লাগার কথা নয়। নির্বাচনের যে ফলাফল সবার জানা, সেই ফলাফলকে বৈধতা দেওয়ার দায় তাঁরা কেন নেবেন? আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের প্রতি অনাস্থা তো দুই–তৃতীয়াংশ মানুষের রয়েছেই।
কোনো বিচারেই এ নির্বাচন তাই প্রতিনিধিত্বশীল বা অংশগ্রহণমূলক হিসাবে বিবেচনা করা যায় না। ব্যালটে যদি পাশ্চাত্যের কিছু দেশের মতো কোনো প্রার্থীই পছন্দ নয় লেখা ঘরে টিক চিহ্ন দেওয়ার বিধান থাকত, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি হতো। আওয়ামী লীগ সর্বশেষ ২০০৮ সালে যে প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ নির্বাচনে জয়ী হয়েছিল, তাতে ভোটের হার ছিল ৮৭ শতাংশ। আইআরআইয়ের জরিপের আরও দুটো তথ্য এখানে স্মরণ করা ভালো। একটি হচ্ছে বিরোধীদলের প্রতি সমর্থন বেড়ে ৬৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল এবং ৫৩ শতাংশ মানুষ বলেছিলেন তাঁরা মনে করছেন দেশ ভুল পথে চলেছে।
সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা পূরণ করতে গিয়ে একতরফা নির্বাচন যে আমাদের নতুন রাজনৈতিক সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সংকটের প্রকৃতি এখনই প্রকট না–ও হতে পারে, কিন্তু অনূভূত হতে বেশি সময় লাগবে না। বিরোধী দল বলে সংসদে কিছুই ছিল না গত ১০ বছর, যে দলটি ওই ভূমিকায় অভিনয় করত, তারও এবার প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে। যাঁরা স্বতন্ত্র হিসাবে বিজয়ী হয়েছেন, তাঁদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের সদস্য। সুতরাং, দ্বাদশ সংসদ যে একদলীয় হবে, তা নিয়ে আর কোনো প্রশ্নের অবকাশ নেই।
দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পরপর তৃতীয়বারের মতো ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ায় তাদের মধ্যে যে হতাশার সৃষ্টি হয়েছে, তা শিগগিরই নিরাময় হবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে ভালো করে জানা উচিত যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর দমন-পীড়ন তাদের সরকার বিরোধিতা থেকে নিরুৎসাহিত করে না, বরং তাদের সংকল্পকে শক্তিশালী করে এবং সাংগঠনিক ঐক্যকে দৃঢ় করে। বিএনপি ও তার সহযোগীরা ভোটাধিকার পুনরুদ্ধারের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার দাবিও ছাড়ার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।
ক্ষমতাসীন দল টানা চতূর্থবারের মতো সরকার গঠনের মাধ্যমে হয়তো কিছুটা আত্মতৃপ্ত বোধ করতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ কখনোই সুখকর হয় না। ১৯৯৬ সালে র (১৫ ফেব্রুয়ারি) একতরফা নির্বাচন যে সংকটের জন্ম দিয়েছিল, তা থেকে মুক্তি পেতে রাজনৈতিক আপসরফা এবং দ্রুতই আরেকটি নির্বাচনের প্রয়োজন হয়েছিল। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর সংকট সমাধানের যে প্রয়োজন ছিল, তা পূরণ হয়নি বলেই সংকট ধীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে। এখন সে সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করলো ৭ জানুয়ারির নির্বাচন। সংকট সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে এখন অন্তত উচিত হবে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে আলোচনা শুরু করা।
(৯ জানুয়ারি, ২০২৩–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন