বাংলাদেশে অনেকদিন আগে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (তখন রেডক্রস বলা হতো) লটারিতে লাখ টাকা পুরষ্কারের ঘোষণা দিয়ে প্রতি বছর কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করত। পরে আরও কিছু প্রতিষ্ঠান তা করলেও সরকার কখনো বাণিজ্যিকভাবে লটারি চালুর অনুমতি দেয়নি। ইউরোপ–আমেরিকায় এটি নিয়মিত হয়। কিছুদিন আগে আমেরিকায় এ রকম এক পুরষ্কারের পরিমাণ শতকোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। গত এপ্রিলে ১৩০ কোটি ডলারের সেই পাওয়ারবল জ্যাকপট বিজয়ী হয়েছেন চেং ‘চার্লি’ সেফানের। আমাদের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তাঁর হঠাৎ করে এত বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার ব্যাখ্যা হিসাবে তিনি বা তাঁর স্ত্রী–কন্যাদের লটারি জেতার কথা হয়তো বলতে পারতেন।
পুলিশের সর্ব্বোচ্চ তিনটি পদে আসীন হওয়ার বিরল সুযোগ পাওয়া বেনজীর আহমেদের সম্পদের যেসব বিবরণ এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলার সূত্রে জানা যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের বিস্ময়ের ঘোর কাটাতে কতদিন লাগবে, কে জানে? অবসরে যাওয়ার পর ছয় মাস না যেতেই তাঁর হাতে এত উপচে পড়া নগদ টাকা যে তিনি একদিনে গুলশানে চারটি ফ্লাট কিনে ফেলেছেন। তাঁদের ৬২১ বিঘা জমির সন্ধান মিলেছে, যার বেশির ভাগই তাঁর স্ত্রীর নামে। ব্যাংকে তাঁদের ৩৩টি অ্যাকাউন্ট আছে। বলা হচ্ছে, বিদেশেও সম্পদ থাকতে পারে এবং তার সন্ধান চলছে।
পুলিশের বিরুদ্ধে কারণে–অকারণে ঘুষ খাওয়ার কথা এত বেশি শোনা যায় যে এই দুর্নামকে অনেকেই পেশাটির সমার্থক করে ফেলেন। কিন্তু সর্ব্বোচ্চ ৩০–৩৫ বছর চাকরি করে কেউ যদি ঘুষখোর হিসাবেও পরিচিতি পান, তার পক্ষেও এতটা সম্পদ অর্জন করা প্রায় অসম্ভব। জবরদস্তি করে বা ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, দখলবাজি, কেনাকাটার কমিশন, অধ:স্তনদের উপরি আয়ে ভাগ বসানো এবং বিভিন্ন অপরাধী চক্রের কাছ থেকে বড় অংকের মাসোহারার মতো অনেকগুলো আয়ের সূত্র ছাড়া এতটা অস্বাভাবিক সম্পদস্ফীতির আর কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হতে পারে না। স্বামী কিম্বা পিতা হিসাবে তাঁর এ ঈর্ষণীয় ধন অর্জনে তাঁর স্ত্রী–কন্যারা নিশ্চয়ই গৌরববোধ করছেন। না হলে তাঁদের সম্মতি ছাড়া তো তাঁদের নামে সম্পদ করা সম্ভব ছিল না।
এ তো গেল ব্যক্তি বা পরিবারের কথা। কিন্তু এতটা গুরুতর অপরাধ সংঘটনের সময়ে রাষ্ট্র এবং সরকারের ভূমিকা কী ছিল? আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ ইস্যুতে সরকার বিব্রত নয়। তিনি দাবি করেছেন, সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে। সরকার তাঁদের অপরাধ অস্বীকার করে পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। সরকার যে বিব্রত নয়, তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বিব্রত হতে হলে যে বোধ বা বিবেচনা থাকতে হয়, তা হলে গণতন্ত্রে আস্থা এবং জনগণের কাছে জবাবদিহি। এত বড় অপরাধ তাঁদের সরকারের অধীনে হয়েছে, অথচ তাঁরা টের পাননি বলে যদি তাঁরা বলতে চান, তাতে প্রমাণিত হয় যে সরকার পরিচালনার যোগ্যতায় তাঁদের ঘাটতি আছে। আর এরকম ঘাটতি বা ব্যর্থতার জন্য যেকোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারকে পদত্যাগ করতে হতো।
সরকারের নিয়ন্ত্রণের অধীন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজ বছরের পর বছর চলতে পারার ব্যাখ্যা যদি মন্ত্রীদের ব্যর্থতা না হয়, তাহলে অন্য যে ব্যাখ্যাটি আসে তা আরও গুরুতর। অর্থাৎ সরকার এ অপরাধের কথা জানত, কিন্তু তা বন্ধের কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। জেনেশুনেও অপরাধ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়ার ব্যাখ্যা তাহলে কী? অপরাধ যারা করছিল, তারা সরকারের জন্য এতটাই অপরিহার্য ছিল যে ওই দুর্নীতি মেনে নেওয়াই শ্রেয় বলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
পুলিশে বেনজীরের ভূমিকা নিয়ে যেসব অভিযোগ পাওয়া যায়, সেগুলোতে অবশ্য ইঙ্গিত মেলে ভিন্নমত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমনে তিনি এতটাই কঠোর ছিলেন যে তাঁকে তখন সরকারের অপরিহার্য মনে হতেই পারে। বিশেষ করে যে শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহি নয়, ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যই প্রধান বিবেচ্য।
বেনজীর আহমেদ র্যাবের প্রধান থাকার সময়ে বিরোধীদের দমনে যে কঠোর নীতি অনুসরণ করেন তার পরিণতিতেই গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ তোলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো। এসব সমালোচনা নাকচ করে দিয়ে তিনি পাল্টা হুংকার দিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আমরা অস্ত্র ব্যবহার করব না তো কি হাডুডু খেলব?’ মাদকবিরোধী অভিযানেও তাঁর নীতি ছিল ফিলিপাইনের সাবেক প্রেসিডেন্ট দুতার্তের মতো। সন্দেহ হলেই নির্মূলের নীতি। আইন শৃঙ্খলার কথা বলে বিচারব্যবস্থা বা আইনের শাসনকে উপেক্ষা করে শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে এসব কাজ পরিচালিত হয়েছে, যা সরকারের সায় না থাকলে কখনোই সম্ভব নয়।
দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন সমালোচনার মুখে সরকার সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ ও পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদকে শুধু সমর্থন ও সুরক্ষা নয়, বরং তাদের ভূমিকায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎসাহ যুগিয়েছে। জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে খুনের দায়ে দন্ডিত ভাইদের অন্যায় সুবিধা দেওয়া ও সামরিক ক্রয়ে দুর্নীতির বিষয়ে আল–জাজিরা টেলিভিশনের অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র প্রচারের পর সরকার সে অভিযোগ আমলে নেয়নি। উপরন্তু, আল–জাজিরা টিভির সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র জেনারেল আজিজের বিরুদ্ধে অ্যন্টি–ক্লেপ্টোক্র্যাসি আইনে যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতেও একই অভিযোগের কথা আছে। এখন সরকারের অতি–গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, দুদক চাইলে সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করতে পারে।
এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বললেন সেনাবাহিনী চাইলে সাবেক সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। অর্থাৎ, এখনো সরকার কোনো ব্যবস্থা নিতে চাইছে না, দায়টা সেনাবাহিনী ও দুদকের ওপর চাপিয়ে পার পাওয়ার চেষ্টা করছে। জেনারেল আজিজ তাঁর ভাইদের জন্য ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন ও দ্বিতীয় আরেকটি পাসপোর্ট পেতে সহায়তা করেছেন। এটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট বিষয়ক আইনে অপরাধ, যার তদন্ত করার কথা পুলিশের এবং বিচারও ওই আইনে হওয়ার কথা।
বেনজীরের বেলায়ও সরকারের ভূমিকা কম প্রশ্নবিদ্ধ নয়। র্যাবের প্রধান হিসেবে তাঁর ভূমিকার জন্য দেশে–বিদেশে সমালোচিত হওয়া সত্ত্বেও সরকার রাজনৈতিক কারণেই তাঁকে পুলিশের মহাপরিদর্শক পদে পদোন্নতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্টে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর দলীয় সমর্থকদের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ‘গুরুত্বহীন’ প্রমাণের উদ্দেশ্যে তাঁকে জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে পাঠানো হয়, যে সম্মেলনে পুলিশপ্রধানের উপস্থিতি আবশ্যক ছিল না। তখন বেনজীর যুক্তরাষ্ট্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের আয়োজিত এক নাগরিক সমাবেশে সরকারবিরোধীদের কড়া সমালোচনা করে রাজনৈতিক বক্তৃতা দেন
দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সমসাময়িক দুই প্রধানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এখন আলোচিত হচ্ছে, তা তাঁরা দায়িত্ব থাকাকালে সম্ভব ছিল না। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় অন্তত: সংসদে জবাবদিহির প্রশ্ন থাকে। শুধু ’হ্যাঁ বলা’য় অভ্যস্ত কার্যত একদলীয় সংসদে সেই অবকাশও নেই। সুতরাং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি কোনোভাবেই নাকচ করা যায় না। এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার প্রবণতা যে ক্ষমতার স্থায়ীত্ব বাড়ানোয় সুবিধাভোগীর কাছ থেকে প্রতিদানের আশায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষয়সাধনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে, তা নিয়ে প্রচুর গবেষণাও রয়েছে।
আর দুদকের তদন্ত ও বিচারের ওপর আস্থা রাখার অবকাশই–বা কই? যুবলীগ নেতা সম্রাটের গ্রেপ্তারের পরও বলা হয়েছিল যে আওয়ামী লীগ যে কাউকে ছাড় দেয় না, এটি তার প্রমাণ। কিন্তু, সেই সম্রাটের বিচার আর এগোয়নি এবং তিনি মুক্ত জীবন যাপন করছেন। এরকম নজিরের তালিকা অনেক দীর্ঘ।
(৩০ মে, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন