সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

সরকারকে তুষ্ট করার আরও একটি নির্বাচন

 স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা যদিও একটি ক্ষমতাকাঠামোয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার অংশ, তবুও তার নির্বাচন হচ্ছে অরাজনৈতিক ভিত্তিতে। গতকাল যে এক–তৃতীয়াংশ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে  দলের প্রতীক বা পরিচয় ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় নেতা–কর্মীরা সেই পরিচয় বা প্রতীক ব্যবহার করতে পারেননি। 


অন্য দলগুলোর মধ্যে যাদের সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া আছে, অর্থাৎ জোটসঙ্গী বা অনুগত বিরোধী দল তারা জানে যে অদৃশ্য ভাগ–বাঁটোয়ারার বাইরে যেহেতু কিছুই হবে না, তাই তারা হয় প্রার্থী দেয়নি, নয়তো প্রতীকী অংশগ্রহণ করছে। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় বিকল্পের প্রতিশ্রুতি নিয়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিংস পার্টিগুলোও জিভ পুড়িয়ে ঘরে ঢুকে গেছে। অন্য সব বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করছে।


নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলোর তালিকা একটু দীর্ঘই হবে। বিএনপি ছাড়াও তাদের জোটসঙ্গী ডজনখানেক দল, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন ও সিপিবির মতো দলগুলো নির্বাচন অর্থবহ হবে না জানিয়ে এতে অংশ নেওয়া থেকে বিরত আছে। নির্বাচন নির্দলীয় হওয়ায় বিএনপির শতাধিক নেতাকর্মী প্রার্থী হয়ে দলীয় সদস্যপদ হারিয়েছেন এবং মাঠে তাঁরা প্রায় একাকী হয়ে পড়েছেন বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। তাঁদের অনেকে উপজেলা পরিষদে বিভিন্ন পদে আগে নির্বাচিত হওয়ায় একধরনের সামাজিক–মানসিক চাপ থেকেও দলের বর্জনের আহ্বান অমান্য করে প্রার্থী হয়েছেন। 


উপজেলা নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলের এই নৈরাশ্যজনক চিত্রের পটভূমি আমাদের সবারই জানা। ঠিক চার মাস আগে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন হচ্ছে ভোট বিষয়ে এ হতাশার উৎস। ওই নির্বাচনের মাত্র ১১ দিন পর ১৮ জানুয়ারি প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল স্বীকার করে নেন যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। তিনি অবশ্য কথাটা এভাবে ঘুরিয়ে বলেছিলেন, ‘”নির্বাচন খুব যে অংশগ্রহণমূলক হয়েছে তা নয়। সার্বিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে গ্রহণযোগ্য না হলে একটা রাজনৈতিক সংকট থেকে যায়।” 


ওই একই বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘‌নির্বাচন পদ্ধতির ওপর থেকে জনগণের আস্থা কমে গেছে। ফলে নির্বাচন কমিশন নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। নির্বাচনপদ্ধতিতে আরও বেশি সংস্কার, স্বচ্ছতা ও নির্ভরযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা হলে আগামী নির্বাচন আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।’ নির্বাচন পদ্ধতিতে জনগণের আস্থা ফেরানোর জন্য তিনি যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন, তা কিন্তু নয়। বরং ক্ষমতাসীন দলের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের ইচ্ছা পূরণ করেছেন।  তিনি উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ছাড়া নির্বাচন করা এবং স্বতন্ত্র প্রার্থিতার জন্য ১ শতাংশ ভোটারের স্বাক্ষর জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার মতো কিছু বিধি সংশোধন করেছেন। 


দলীয় মনোনয়ন ও প্রতীকে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকলে আওয়ামী লীগকে যে আবারও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো ’ডামি প্রার্থী’ দিতে হতো অথবা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সব ফয়সালা হয়ে যেত, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। ডামি নির্বাচন ’বা ’বিনাভোটের নির্বাচন’ বিশেষণগুলো এড়াতেই এসব সংশোধনীর প্রয়োজন হয়েছে, যার উদ্দেশ্য হচ্ছে যেকোনোভাবে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানো। 


আর দলীয় প্রতীকের বিষয়টি না থাকায় বিএনপির নেতাকর্মীরা বেশি সংখ্যায় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন–  এমন একটা আশাও যে কাজ করেছে, তা বেশ ভালোই বোঝা যায়। তবে বিএনপি তার শত বিপদের মধ্যেও শতাধিক নেতা–কর্মীকে অবাধ্যতার জন্য বহিষ্কার করে উপজেলা নির্বাচনকে প্রত্যাখ্যানের অবস্থান নিয়েছে। 


বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলের বর্জন সত্ত্বেও প্রথম ধাপে  যে নির্বাচন হলো, তাতে ভোটারদের অনুপস্থিতি ছাড়াও যে সব বিষয় পরিষ্কার হয়েছে, তার মধ্যে দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, কমিশন ও সরকার নির্বাচনকে যতটা সম্ভব ভালো ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর চেষ্টা করছে। নির্বাচন কমিশন মন্ত্রী–এমপিদের এই নির্বাচনে নিষ্ক্রিয় করতে স্পিকারকে চিঠি পর্যন্ত দিয়েছে, যা সিটি কর্পোরেশনের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। অর্থাৎ কমিশন নিজেই প্রমাণ করল যে ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধে তাদের সামনে পথ থাকলেও তারা তা সবসময়ে কাজে লাগায় না। 


এখন ক্ষমতাসীন দলের ইচ্ছা পূরণের জন্যই মন্ত্রী–এমপিদের প্রভাব কমাতে তারা স্পিকারের সহায়তা চেয়েছে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে স্পিকারের কার্যকর কোনো ক্ষমতা আদৌ আছে কিনা, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে মন্ত্রী–এমপিদের স্বজনদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ আসার পরই নির্বাচন কমিশন মন্ত্রী–এমপিদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ দেওয়া হবে না বলে হুংকার দিয়েছে। 


দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি দেখা গেল, তা হচ্ছে দলীয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় কোনো হুমকিতেই কাজ হচ্ছে না। মন্ত্রী–এমপিদের স্বজনদের প্রার্থিতা প্রত্যাহিরের নির্দেশনা অমান্যকারীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত বলে খবর দিয়েছে প্রথম আলো। ক্ষমতার প্রয়োজনে দলীয় গঠনতন্ত্র লঙ্ঘন করে ডামি প্রার্থী প্রদানের কৌশলের যে একটা মূল্য আছে, তা এখন একেবারে খোলাসা হয়ে গেছে। নেতার নির্দেশ অলঙ্ঘনীয় বা শিরোধার্য বলে যে জনশ্রুতি (মিথ) রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল, তা অনেকটাই ভেঙ্গে গেছে। রাজনীতিতে এটিকে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা বলেও কেউ গণ্য করতে চাইলে তা একেবারে নাকচ করে দেওয়া যাবে না। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া আর যা–ই হোক, তা গণতান্ত্রিক নয়।  


দলীয় শৃঙ্খলায় অবাধ্যতার যে প্রশ্ন উঠেছে, তার পেছনে দলের ভেতরেই দ্বৈতনীতি অনুসরণের ভূমিকাও অস্বীকার করা যায় না। সমকাল গত ৩ মে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ভাই, সাবেক রাষ্ট্রপতির বোনও প্রার্থী হয়েছেন। শীর্ষ নেতাদের পরিবারের সদস্যরা যদি দলের ভেতরে নিজস্ব অবস্থানের কারণে প্রার্থী হতে পারেন, তাহলে অন্য মন্ত্রী–এমপিরাও যে তাদের পরিবারের সদস্যদের বেলায় একই অধিকার চাইবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান তাঁর ছেলের প্রার্থিতার বিষয়ে প্রকাশ্যে সেকথাই বলেছেন বলে একই পত্রিকায় খবর ছাপা হয়েছে। 


আরেকটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছে বণিক বার্তা। গত  ২০ এপ্রিল তারা জানায় যে মন্ত্রী–এমপিদের স্বজন কারা, সেই সংজ্ঞায়নে দলটির মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে। তা ছাড়াও প্রশ্ন হচ্ছে, স্বজন হলে রাজনীতিতে তার অধিকার খর্ব করার নীতি কোনো রাজনৈতিক দল আদৌ কি নিতে পারে? মূল সমস্যা তো মন্ত্রী–এমপিদের ক্ষমতা ও প্রভাবকে বেআইনিভাবে কাজে লাগানো বন্ধে প্রশাসনের অক্ষমতা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনিচ্ছা; আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনৈতিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যোগসাজশ। 


ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে উপদলীয় রেষারেষির প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক জায়গায়ই প্রকট আকার ধারণ করে সংঘাতের রুপ নিয়েছে। এটি প্রত্যাশিত। কিন্তু গত তিনটি সংসদ নির্বাচনের মতোই ভোটারদের সামনে বেছে নেওয়ার মতো বিকল্প অনুপস্থিত। ফলে সংবাদমাধ্যমে যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মধ্যে তেমন কোনো উৎসাহ–আগ্রহ তৈরি হয়নি। ভোটারদের আস্থা অর্জনের চেষ্টার বদলে সরকারকে তুষ্ট করার আয়োজনই যখন নির্বাচন কমিশনের কাজ তখন এর থেকে আলাদা কিছু হবে কীভাবে? 


(৯ মে, ২০২৪–এর প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত।)



মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

How to Describe the Awami League Accurately?

In an article titled ‘How Not to Describe the Awami League’ , published in this paper, British journalist David Bergman rightly underscores the importance of accuracy in labeling a political party—particularly when such labels carry potential legal consequences. Those familiar with Bergman’s work over the years know that he has consistently taken on politically sensitive and controversial subjects, often at significant personal and professional cost. His courage and commitment to journalistic integrity deserve recognition. Bergman is correct in asserting that “while serious criticisms of the Awami League are both valid and necessary, they must be proportionate and grounded in fact.” His analysis focuses primarily on the legal validity and appropriateness of labeling the Awami League as “fascist” or “Nazi.” He argues that comparing the party to the Nazi regime trivialises the scale of Nazi atrocities and misrepresents the complexities of Bangladeshi politics. Indeed, any historical comp...

স্বৈরতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার নিকৃষ্ট পরিণতি

ছাত্র–জনতার অভ্যূত্থানের মুখে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পদত্যাগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কথিত মন্তব্যে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। গত ৫ আগস্ট রাতে জাতির উদ্দেশ্য দেওয়া ভাষণ এবং সম্প্রতি মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় পরস্পরবিরোধী মন্তব্য – এই দুইয়ের একটি যে অসত্য, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিতর্ক শুরু হওয়ার পর তাঁর দপ্তর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা–ও অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি সর্বশেষ বিবৃতিতেও মতিউর রহমান চৌধুরীকে অসত্য কথা বলার বিষয়টি স্বীকার যেমন করেন নি, তেমনি এমন দাবিও করেননি যে তাঁকে ভূলভাবে উদ্ধৃত করা হয়েছে।  ৫ আগস্ট যদি তিনি পদত্যাগপত্র গ্রহণের প্রশ্নে অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তা খুবই গুরুতর হিসাবে বিবেচিত হতে বাধ্য। কেননা তা ছিল জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণের তথ্য। আবার যদি তিনি মানবজমিন সম্পাদকের কাছে আলাপচারিতায় অসত্য বলে থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে যে দেশবাসী প্রশ্নের জবাব চাইতে পারে, তা হলো অর্ন্তবর্তী সরকার যখন সবকিছু গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছে, দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চেষ্টা চলছে, তখন তিনি কেন এমন বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে চাইছেন? তাঁর উদ্দ...