সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ভুঁয়া খবর , ফেসবুক, টুইটার ও নির্বাচন

যে বছর বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন সেবছরই ফেক নিউজ কথাটি জোরেশোরে শোনা গেল। বাংলায় এর প্রতিশব্দ ভুঁয়া বা বানোয়াট খবর। ২০১৬ সালে অক্সর্ফোড ডিকশনারির বিবেচনায় বছরের সবচেয়ে আলোচিত শব্দ ছিল ফেক নি্উজ। ২০১৭ তেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কল্যাণে শব্দটি শীর্ষ আলোচিত শব্দাবলীর তালিকায় ছিল। তবে, পরিহাসের বিষয় হলো যেসব খবরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বা তাঁর পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের কেলেংকারির কথা প্রকাশিত হয় সেগুলোকেই তিনি বানোয়াট খবর বলে উড়িয়ে দেন। বিপরীতে তাঁর অনুসারী কট্টর ডানপন্থী কিছু গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অজস্র বানোয়াট তথ্য ব্যবহার করে অপপ্রচার চালায়।আর, সেই বানোয়াট খবরের সফল প্রচারই তাঁর নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম কারণ।

ভূঁয়া খবর ছড়িয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা কিভাবে সম্ভব এটি এখন আর কোনো প্রশ্ন নয়। বরং, প্রশ্ন হচ্ছে এটি কেন মোকাবেলা করা সম্ভব হয় নি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স এবং জার্মানিতে ফেসবুক, টইটার এবং গুগুলকে এখন সেজন্যে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। এমনকি, তাদের বিরুদ্ধে ওই অপপ্রচারে সচেতন বা অচেতনভাবে সহায়তা করারও অভিযোগ উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের নির্বাচনগুলোতে রাশিয়া থেকে সোৎসাহে এই অপপ্রচারের কাজটি করা হয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ আছে এবং সেধরণের আলামতও মিলছে। ট্রাম্পের প্রচার দলের কোন যোগসাজশ ছিল কিনা তা নিয়ে তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু বলা না গেলেও হিলারির বিরুদ্ধে রাশিয়ার ভিতর থেকে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্য তথ্য দিয়ে অপপ্রচার চালানোর বিষয়টি প্রযুক্তিজগতে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত সত্য। সামাজিক মাধ্যমে কারো বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানোর কাজটি যে বা যাঁরা করেন তাঁদেরকে ট্রল বলে অভিহিত করা হয়। এরকম অজস্র ট্রলের উৎস যে রাশিয়া এবং তার ঘনিষ্ঠ সর্বিয়া সেবিষয়ে অসংখ্য নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিটেনে ইউরোপের সঙ্গে বিচ্ছেদ বিষয়ক ব্রেক্সিট গণভোটের ক্ষেত্রেও একই আলামতের কথা বলেছে ব্রিটিশ এমপিদের অনেকেই। অবশ্য, তাতে নির্বাচনের ফল পাল্টে গেছে এমনটি কেউ দাবি করেনি। এধরণের অপচেষ্টার বিপদকে তাই গুরুত্বের সঙ্গেই বিবেচনা করা প্রয়োজন। 

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম সাধারণ ভোটার - বিশেষ করে তরুণ এবং সহস্রাব্দের প্রজন্মের ( মিলেনিয়াল) কাছে পৌঁছানোর জন্য যে এক অভূতর্পূব মাধ্যম এটি রাজনীতিক এবং রাজনৈতিক দলের চিন্তকরা বুঝতে পেরেছেন। ফলে, দলের নেতৃত্বের ভাবমূর্তি গড়ায় এই মাধ্যমটিতে তাঁরা নজর দিয়েছেন। ট্রাম্পের আগে এই সুবিধা পেয়ে আলোচিত হয়েছেন যে রাজনীতিক তিনি হলেন নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগেই টুইটারে সর্বাধিক সংখ্যক অনুসারী ছিল তাঁর। এখনও ফেসবুক এবং টুইটারে তাঁর অনুসারী প্রায় দশ কোটি।

তবে, পরে জানা গেছে টুইটারে তাঁর ভক্তদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বেশি হওয়ার পিছনে একটা রহস্য আছে। বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে ২০১৪র মে মাসে ভারতের নির্বাচনের সময়ে। ওই বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ১২ মে নির্বাচনের দিন পর্যন্ত পাঁচ কোটি ষাট লাখ টুইট ছিল নির্বাচন বিষয়ক। ওই চার মাসে মি মোদির অনুসারী আটাশ শতাংশ বেড়ে প্রায় চল্লিশ লাখে পৌঁছায়। ভুঁয়া অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করতে সক্ষম এরকম এক সফটওয়্যারের উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠান সোশালবেকারস তখন জানায় যে তাঁর সমর্থকদের অর্ধেকই সন্দেহজনক। ২০১৩ সালে টাইম সাময়িকী বছরের আলোচিত চরিত্র নির্বাচনের জন্য মি মোদির টুইটার অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করে। সেসময়ে তাঁরা দেখতে পান আমি মনে কার নরেন্দ্র মোদির টাইমের বর্ষমানব হওয়া উচিতএমন মন্তব্যের হাজার হাজার টুইট আসছে নিয়মিত বিরতিতে। ২৪ ঘন্টাই একই ভাবে তা আসতে থাকে। শিগগিরই তার পাল্টা টুইটও শুরু হয়। ( সূত্র: হোয়াই ফেক টুইটার অ্যাকাউন্টস আর এ পলিটিক্যাল প্রবলেম, নিউ স্টেটসম্যান, ২৮ মে ২০১৪ )।  ইন্টারনেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম কিছু সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেছে প্রযুক্তিবিদরা যা বট নামে পরিচিত।এসব বটই ভুঁয়া সমর্থকের কাজ করে। টুইটার ২০১৪ সালেই স্বীকার করেছিল যে তাদের প্লাটফর্ম ব্যবহারকারীদের পাঁচ শতাংশের মত অ্যাকাউন্ট ভুঁয়া।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি প্রকাশিত খবরেও বলা হচ্ছে টুইটারে রাজনীতিকদের অনুসারীদের অ্যাকাউন্ট নিরীক্ষা করে দেখা গেছে এঁদের বেশিরভাগই ভুঁয়া। টুইটারঅডিট নামের একটি ডাটা-আ্যানালিটিকস বলছে যে অরবিন্দ কেজরিওয়াল, নরেন্দ্র মোদি এবং রাহুল গান্ধী এঁদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছে। কেজরিওয়ালের এক কোটি চব্বিশ লাখ অনুসারীর পঁয়ষট্টি ভাগ ও মি মোদির দুটি অ্যাকাউন্টের চার কোটি আশি লাখ অনুসারীর তেষট্টি শতাংশই সন্দেহজনক। টুইটারে নতুন রাহুল গান্ধীর ক্ষেত্রে আসল অনুসারী প্রায় একান্ন শতাংশ। (মেজরিটি অব টপ পলিটিশিয়ান্সটুইটার ফলোয়ারস ফেক: অডিট, ডেকান হেরাল্ড, ২৪ অক্টোবর, ২০১৭)। সামাজিক মাধ্যমে অনুসারীর সংখ্যা সবসময় যে জনপ্রিয়তার যর্থাথ প্রতিফলন নয় তা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু, জনপ্রিয়তার প্রতিযোগীতায় বিভ্রান্তি সৃষ্টির জন্য তার গুরুত্ব তো মানতেই হবে।

বাংলাদেশে ভুঁয়া খবর বা বানোয়াট খবরের বিষয়টি একেবারে নতুন নয়। সাংবাদিকতা পেশায় যাঁরা কয়েক দশক ধরে আছেন তাঁদের কাছে এই বানোয়াট খবরের একটি নজির খুবই পরিচিত। নব্বুইয়ের দশকে ঢাকার নতুন প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু সাড়া জাগানো এক দৈনিকে দেশের প্রধান একটি দলের একজন নেত্রীর একটি সাক্ষাৎকার ছাপানো হয়, যেটি পুরোটাই ছিল ওই সাংবাদিকের মনগড়া। যে নেত্রীর সঙ্গে যে স্থানে সাক্ষাৎকারটি নেওয়ার কথা বলা হয়েছিল সেখানে সেই নেত্রী সেদিন যান নি এবং সেই সাংবাদিকের সঙ্গেও তাঁর সেদিন দেখা হয় নি। তবে, মজার ব্যাপর হচ্ছে সেদিন সেই কথিত সাক্ষাৎকারের বিষয়ে ওই নেত্রীর পক্ষ থেকে বা তাঁর দল থেকেও কোনো প্রতিবাদ হয় নি। সেই সাংবাদিক এখনও এই পেশায় আছেন।

সাম্প্রতিক এরকম একটি ভুঁয়া খবর ছিল নোবেল কমিটি শান্তি পুরষ্কারের জন্য আগের রাতেই ফোন করে নাকি সম্ভাব্য প্রাপককে পরের দিন সকালে টেলিফোনের পাশে থাকতে অনুরোধ জানিয়েছে। অথচ, যাঁরা কিছুটা খোঁজ-খবর রাখেন তাঁরা জানেন যে পুরস্কার ঘোষণার আগ পর্যন্ত সেটা গোপন থাকে এবং ঘোষণার সামান্য আগে বিজয়ীকে তা জানানো হয়। সম্প্রতি এমন অনেক খবরই অনলাইনের ভুঁইফোড় পোর্টাল এবং সামাজিক মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যেগুলোর সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে মূলধারার কাগজগুলোর সাংবাদিকরা রীতিমত গলদঘর্ম হয়েও সেগুলোর কোন হদিস করতে পারেন নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দেশের সম্পদ পাচার করে সউদি আরবে বিপণীবিতান কিনে থাকলে অবশ্যই সেই সম্পদ উদ্ধার এবং কথিত দূর্নীতির বিচার হওয়া উচিত। কিন্তু, বিএনপি বলছে যেসব বিদেশী সংবাদমাধ্যমের খবর বলে তা প্রচার করা হয়েছে সেগুলো হয় অস্তিত্বহীন, নয়তো তারা কখনোই এধরণের কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ভারতসহ বিভ্ন্নি দেশের রাজনীতিকরা কয়েকবছর ধরেই যে সমস্যা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছেন, সেই সমস্যা এখন বাংলাদেশেও আছর করেছে। 

এখানে অবশ্য আরো একটি কথা বলে রাখা ভালো যে, আমাদের রাজনীতিকরাও তাঁদের সম্পর্কে বিব্রতকর কোনো তথ্য বা অভিযোগ প্রকাশিত হলে সেগুলোকে বানোয়াট বলে উড়িয়ে দেওয়ায় অভ্যস্ত। আর, আমাদের বিচারব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রতা এবং অনিয়ম-দূর্র্নীতির কারণে শেষপর্য্যন্ত এধরণের অভিযোগ আদালতে খুব একটা নিষ্পত্তিও হয় না। ফলে, অনেকসময় সত্য হলেও তা আইনী মারপ্যাঁচে শেষপর্য্যন্ত বানোয়াটই থেকে যায়। আমার আজকের আলোচ্য অবশ্য অতীত নিয়ে নয়, বরং নির্বাচনের বছরে বানোয়াট তথ্য কিভাবে আমাদেরকে বিভ্রান্ত করতে পারে সেই বিপদ সম্পর্কে আলোচনার সূত্রপাত করা।

দলীয় বক্তব্য প্রচার এবং নেতা-নেত্রীদের ভাবমূর্তি গঠনে সামাজিক মাধ্যমকে কাজে লাগানোর দিকটিতে বড় দলগুলো যে নজর দিয়েছে সেটা মোটামুটি সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু, তা কতটা কার্য্যকর বলা মুশকিল। এখানেও সরকারবিরোধীরা যে কিছুটা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়বেন সন্দেহ নেই। কেননা, বিদ্যমান ৫৭ ধারা অথবা প্রস্তাবিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিধানগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে পুলিশ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দলনিরপেক্ষতার বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্বর্পূণ। বিরোধী নেতানেত্রীদের সম্ভাব্য চরিত্রহননকারী ভূঁয়া তথ্য বা অভিযোগের বিরুদ্ধে মামলা করতে গেলে তাঁরা কতটা প্রতিকার পাবেন তা এখনও পরীক্ষিত নয়। কিন্তু, সরকারী দলের নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমালোচনার ক্ষেত্রেও ৫৭ ধারা ব্যবহারের নজির অনেক।

রাজনীতি ও নির্বাচনকে প্রভাবিত করায় ফেসবুক ও টুইটারের ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু অনুসন্ধানমূলক গবেষণা হয়েছে। ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এবিষয়ে যে বিশেষ শাখা কার্য্যক্রম পরিচালনা করে তার কিছু বিবরণ তুলে ধরেছেন সাংবাদিক স্বাতী চর্তূবেদি তাঁর বই আই অ্যাম এ ট্রল: ইনসাইড দ্য সিক্রেট ওর্য়াল্ড অব দ্য বিজেপিস ডিজিটাল আর্মি। অভিনেতা আমির খান ভারতে সহিষ্ণুতা কমে যাওয়ার বিষয়ে মন্তব্য করার পর তাঁর মডেলিং চুক্তি বাতিলের জন্য স্ন্যাপডিল ( অনলইন মার্কেটিং প্লাটফর্ম ) কোম্পানির বিরুদ্ধে এই গোষ্ঠী টুইটারে কিধরণের হয়রানি করেছিল তার বিবরণ রয়েছে এই বইতে। অনলাইনে এই বিশেষ ধরণের হয়রানিকে প্যাট্রিয়টিক ট্রল (দেশপ্রেমিক হয়রানি) বলে অভিহিত করা হচ্ছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডম হাউজ বলছে প্যাট্রিয়টিক ট্রলের উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারী ভাষ্যের বাইরে অন্য কোনো ভাষ্য বা ভিন্নমত দমন করা।

ফেসবুক এক্ষেত্রে কতটা তৎপর তার একটা ভয়াবহ চিত্র সম্প্রতি তুলে এনেছে ব্লুমবার্গ  ( হাউ ফেসবুকস পলিটিকাল ইউনিট  এনাবেলস দ্য র্ডাক আর্ট অব ডিজিটাল প্রোপাগান্ডা , ২১ ডিসেম্বর, ২০১৭)। ফেসবুকের বৈশ্বিক রাজনীতি ও সরকার ইউনিট বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিকদের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রচারকৌশলের বিষয়ে কাজ করে থাকে। ভারত ছাড়াও ফিলিপাইন এবং জার্মানির নির্বাচনে ফেসবুকের সম্ভাব্য ভূমিকার বিষয়ে এই প্রতিবেদনে তুলে ধরে বলা হয়েছে যে এসব বিষয়ে কোনোধরণের স্বচ্ছ্বতা নেই। ফেসবুক তাদের কার্য্যক্রমে স্বচ্ছ্বতার দাবি নানাভাবে এড়িয়ে এবং প্রতিহত করে চলেছে।  

বাংলাদেশে নির্বাচনের বছরে অনলাইনে রাজনৈতিক প্রচার বাড়বে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু, গণতন্ত্রের যে নাজুক দশা সামাজিক মাধ্যমও তার ব্যাতিক্রম নয়। বরং, এক্ষেত্রে বাড়তি ঝুঁকি হচ্ছে প্রযুক্তির বিষয়ে আমাদের সীমিত জ্ঞান, সামর্থ্যের ঘাটতি এবং নীতিমালা প্রশ্নে বিতর্ক ও সমঝোতার অভাব। এক্ষেত্রেও রাজনৈতিক দল, বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক গোষ্ঠীগুলোর দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন যাতে ডিজিটাল জগতটি গণতান্ত্রিক এবং সমসুবিধার নিশ্চয়তা দেয়।
(১৫ জানুয়ারি ২০১৮ প্রথম আলোয় বিশ্বায়নের কাল কলামে প্রকাশিত।)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বে স্বৈরশাসকের ফেরা সহজ

  গণতন্ত্রে উত্তরণে ব্যর্থতা ও স্বৈরতন্ত্রের নিকৃষ্টতম রুপ প্রত্যক্ষ করার পর অর্ন্তবর্তী সরকারের মেয়াদকালে যে সব বিষয়ে সংস্কারের আলোপ চলছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা। এরশাদের সামরিক স্বৈরাচারের পতনের পর নির্বাচনকে গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যম হিসাবে যেভাবে প্রতিষ্ঠার কথা ছিল, তা থেকে প্রধান দুই দলই বিচ্যূত হয়েছিল। পরিণতিতে নির্বাচন শুধু ক্ষমতা দখলের হিংসাত্মক খেলায় পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার হরণ করে নির্বাচনকে নানা রকম প্রহসনে পরিণত করে।  এই সমস্যার এক অতি সরলীকৃত সমাধান হিসাবে বলা হচ্ছে, দ্বিদলীয় রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে দেশে সত্যিকার বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আর বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনব্যবস্থায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ধারণাকে একমাত্র বা চূড়ান্ত সমাধান হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে।  সংখ্যানুপাতিক বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির নির্বাচনে একটি দল যত শতাংশ ভোট পাবে, সে অনুপাতে তারা সংসদের আসন পাবে। এ আনুপাতিক পদ্ধতিতে প্রার্থীদের নাম দল আগাম ঘোষণা করতেও পারে, আবার না–ও পারে। নাম প্রকাশ করা হলে সেটা হব...

অরাজনৈতিক আন্দোলনের করুণ রাজনৈতিক মূল্য

কোটা সংস্কারের দাবিতে সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীদের আন্দোলনে  কদিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তা যেমন বেদনাদায়ক, তেমনই নিন্দনীয় ও ক্ষোভের কারণ। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিতে ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর হাতে একইদিনে দেশের তিন জায়গায় ছয়জনের প্রাণহানির ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশে বিরল।  এবার আরও যেসব ঘটনা আমাদের স্তম্ভিত করেছে, অভিভাবকদের চোখ অশ্রুসিক্ত করেছে, এসব মৃত্যুর পরও সরকারের রাজনৈতিক দম্ভ বজায় রাখার চেষ্টা, যা আরও প্রাণহানির কারণ হয়েছে। ছয়জন তরুণের প্রাণ বিসর্জনের পরও কোটা সংস্কারের দাবিতে সরকার ”নীতিগতভাবে একমত” – একথাটি বলে  আলোচনায় না ডেকে সময়ক্ষেপণ করেছে। আইনমন্ত্রী কথাটি যখন বললেন, তার আগেই আরও জীবন গেল, শত শত মানুষ আহত হলো, দেশের সম্পদ নষ্ট হলো। রাজনৈতিক গরিমা ছাড়া এর আর কোনো কারণ আছে কি? ছাত্রলীগ পরিচয়ে অন্ত্রধারীদের তান্ডব, পুলিশের চরম নিষ্ঠুরতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের গড়পরতা মারধর ও লাঞ্চিত করার যে দৃশ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে, তা কোনো অভিভাবকের পক্ষেই ভোলা সম্ভব নয়। এসব ঘটনার বিবরণ উদ্ধৃত না করে শুধু নিষ্ঠুর ...

সংবিধান সংস্কারে জাতীয় সমঝোতা কি অসম্ভব কিছু

সংবিধান সংস্কার কমিশন সংবিধান নিয়ে যে জনমত সংগ্রহ ও জাতীয়ভিত্তিক সংলাপগুলো করছে, তাতে বেশ ভালোই সাড়া মিলছে বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, বিদ্বজ্জনেরা কেমন সংবিধান দেখতে চান, তা নিয়ে বিতর্ক ও মতবিনিময় করছেন। দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নির্ধারণের মৌলিক ভিত্তি তথা রাষ্ট্রকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে নাগরিকদের এতটা উৎসাহ সম্ভবত: এর আগে আর দেখা যায়নি। সংস্কার কমিশনের সূত্র থেকে জেনেছি, অনলাইনে তাঁরা অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছেন এবং মতামত দেওয়ার জন্য সপ্তাহখানেক সময় বাকি থাকতেই ৩০ হাজারেরও বেশি পরামর্শ তাঁদের কাছে জমা পড়েছে। নাগরিকদের এ আগ্রহ থেকে যে বার্তাটি স্পষ্ট হয়, তা হচ্ছে তাঁরা চান তাঁদের মতামত যেন গুরুত্ব পায়। দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতাধরদের কিছু বলার বা তাঁদের প্রশ্ন করার কোনো অধিকার সাধারণ মানুষের ছিল না। প্রতি পাঁচ বছরে একবার ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচনের যে অধিকার, সেটুকুও তাঁরা হারিয়েছিলেন। এই পটভূমিতে নাগরিকদের প্রথম চাওয়া হচ্ছে, তাঁদের হারানো অধিকার ফিরে পাওয়া। ভোট দেওয়ার অধিকার, কথা বলার অধিকার, প্রশ্ন করার অধিকার, সংগঠন করার...