জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে যখন ঢাকা বিভাগের কলেজগুলো স্নাতক
ও স্নাতকোত্তর কোর্সগুলো পড়াতো সেগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানেই পরিচালিত
হোত। সুতরাং, এখন মাত্র সাতটি কলেজকে ফিরিয়ে নিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান শিক্ষা
কার্য্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন ধারণা অযৌক্তিক। কিন্তু, কোন দাবি অযৌক্তিক হলেই যাঁরা
সেই দাবিতে শ্লোগান তুলছেন, প্রতিবাদ করছেন তাদেরকে হেনস্থা করতে হবে এ কেমন কৌশল?
সোমবার ১৫ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে তা কিসের লক্ষণ? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের
এটি কোনধরণের সমঝোতা যে ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাধীনভাবে কিছুই করতে পারবে না?
ছাত্রলীগ দিয়ে আন্দোলন ঠেকাল ঢাবি
প্রশাসন শিরোনামে ১৬ জানুয়ারির দৈনিক ইত্তেফাকে বলা হয়েছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল দাবিতে ক্লাসবর্জনসহ
দিনভর আন্দোলন করেছে ঢাবি শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আন্দোলন দমন করতে ছাত্রলীগকে
ডেকে আনেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রলীগ আন্দোলনরত ছাত্রদের মারধর ও ছাত্রীদের উত্যক্ত
এবং অন্যভাবে শ্লীলতহানি করে আন্দোলন প্রতিহত করে। ঘটনাস্থলে খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া
কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকেও লাঞ্ছিত করে ছাত্রলীগ। গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রশাসনিক ভবনে এসব ঘটনা ঘটে।‘
একই দিনের কালের
কন্ঠ পত্রিকায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা‘ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘সরেজমিনে
দেখা যায়, উপাচার্য অফিসের সামনে ছাত্ররা দাঁড়িয়ে ও ছাত্রীরা বৃত্তাকারে বসে আন্দোলনের
পক্ষে স্লোগান দিচ্ছিল। একপর্যায়ে সেখানে একদল তরুণ-তরুণী এসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের
চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তারা মেয়েদের উদ্দেশ করে নোংরা কথা বলে এবং শারীরিকভাবে হেনস্তা
করতে থাকে। তাদের এই আচরণে মেয়েরা টিকতে না পেরে একে একে চলে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে
আন্দোলনকারীদের সংখ্যা কমতে থাকলে হামলাকারীরা আরো কাছে এসে তাদের ঘিরে ধরে ছেলেদেরও
মারধরের হুমকি দিতে থাকে। একপর্যায়ে হামলাকারী তরুণীরা মেয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও
হয়। সাংবাদিকরা এই দৃশ্যের ছবি নিতে গেলে অন্যরা সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করে। তাঁদের
ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে ভাঙচুর করে। এর আগে এই আন্দোলনের সমন্বয়ক মশিউর রহমান সাদিককে মুখ
চেপে ধরে মারতে মারতে উপাচার্যের অফিসে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। সেখানে তাঁকে মারধরের
হুমকি দিয়ে তাঁর সঙ্গে থাকা মোবাইল, মানিব্যাগ কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর থেকে সাদিককে আর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।‘
অনলাইন পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর জানিয়েছিল
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী সেই রাতে তাঁদেরকে বলেছিলেন, “তাকে (মশিউর) জিজ্ঞাসাবাদের
জন্য শাহবাগ থানায় দেওয়া হয়েছে।” পুলিশ তখন স্বীকার না করলেও চব্বিশ ঘন্টা পর মঙ্গলবার
নিশ্চিত করেছে যে শাহবাগ থানায় তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক রাখা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রক্টর আন্দোলনকারী ছাত্রকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার এরকম রেকর্ড আর কাছে বলে আমার
অন্তত জানা নেই। এরকম প্রক্টর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকলে সম্ভবত সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে
পুলিশের আর প্রয়োজন হবে না।
সংবাদপত্রের এসব বিবরণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ছাত্রলীগের
একধরণের বোঝাপোড়ার চিত্রটি স্পষ্ট। অন্যান্য পত্রিকার বিবরণে জানা যায় উপাচার্যের কার্য্যালয়ে মশিউরকে যখন মারধর করা হয় তখন প্রক্টর
সেখানে একপাশে বসা ছিলেন এবং তিনি মশিউরকে লাঞ্চনা থেকে রক্ষায় এগিয়ে আসেন নি।এর
আগে অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক যখন উপাচার্য
ছিলেন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ ( ডাকসু) নির্বাচনের দাবিতে বামপন্থী ছাত্র
সংগঠনগুলো যখন আন্দোলন করেছিল সেই সময়েও ছাত্রলীগের এই একই আচরণ দেখা গেছে। উপাচার্য বদল হয়েছে, কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রশাসন পরিচালনার ধরণ বদল হয় নি।
মাত্র একদিন আগে ঢাকার রাজপথের আরেকটি চিত্র
সংবাদপত্রের পাতায় বড় করে ছাপা হয়েছিল যাতে দেখা যায় আওয়ামী লীগের একজন সাবেক সংসদ
সদস্য মকবুল হোসেন শমরিতা মেডিকেল কলেজের আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের শাসাচ্ছেন। তাঁর
ওই হুমকি প্রদর্শনের ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়েছে। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের খুলি উড়িয়ে
দেওয়ার কথা বলেছেন, ছাত্রীরা ছাত্রীনিবাসে ফিরলে দেখে নেওয়ার কথা বলেছেন। তার চেয়েও
বড় যে কথাটি বলেছেন তাহোল সরকার তাঁর সঙ্গে আছে। রাজনীতিতে পেশিশক্তি প্রদর্শনের জন্য
যাঁদের পরিচিতি আছে মকবুল হোসেন তাঁদের প্রথম সারির একজন। ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সালের মেয়াদে
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির মিছিলে গুলিবর্ষণের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে।
২০০৭ এর সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলায় তাঁর কারাদন্ড
হলেও পরে হাইকোর্টে মামলার পদ্ধতিগত সমস্যার প্রশ্নে খালাস পান। তবে, একইধরণের পদ্ধতিগত
ত্রুটির প্রশ্ন তুলে খালাস পাওয়া ব্যাক্তিদের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগ নতুন করে বিচার পরিচালনার
নির্দেশ দেওয়ায় অনেকেই পুর্নবিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। এঁদের মধ্যে সাবেক বিএনপি নেতা
নাজমুল হুদার বিরুদ্ধে পুর্নবিচারে দন্ড বহাল আছে। তবে, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিকদের
বিরুদ্ধে মামলা পুনরুজ্জীবন বা পুর্নবিচার কার্য্যত থেমে আছে।
এই দুই ঘটনার খবরগুলো পড়ার পর যদি কেউ প্রশ্ন
করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মকবুলের পর্যায়ে নেমে গেছেন কিনা তার জবাব আমার
জানা নেই। তবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদাকে যে মারাত্মকভাবে
ক্ষুণ্ণ করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়কে শান্ত রাখার নামে তাঁরা একেদিকে
ছাত্রলীগকে যা খুশি তাই করার স্বাধীনতা দিয়েছেন, আর বিপরীতে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের
জীবনকে কারাগারের জীবনের সমতুল্য করে তুলেছেন।
সাম্প্রতিককালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রতিবাদটি
বিনাবাধায় এবং শান্তির্পূণভাবে হতে পেরেছে সেটি হলে ওয়ালিদ আশরাফ নামের একজন ছাত্রের
একক অনশন। ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে গত নভেম্বরে তিনি একটানা যে নয়দিন অনশন করেছেন তখন
তাঁকে কোনধরণের হুমকি বা লাঞ্চনার শিকার হতে হয়নি। হতে পারে তিনি একা বলে বিশ্ববিদ্যালয়
প্রশাসন, ছাত্রলীগ, পুলিশ এবং সরকার কেউই তাঁকে শান্তিবিনাশে সক্ষম এমন কোন হুমকি বলে
বিবেচনা করে নি। ওয়ালিদ আশরাফের অনশনে সংহতি জানানোর পালা যখন কিছুটা গতি পেতে শুরু
করেছিল তখনই উপাচার্য তাঁকে আশ্বস্ত করে তাঁর অনশন ভাঙ্গিয়েছেন।
কিন্তু, উপাচার্য তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সামান্যতম
এগিয়েছেন বলেও মনে হয় না। অন্তত সেরকম কোনো আলামত দেখা যায় না। এখন হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের কারণে নির্বাচন করতে হলে তাতে প্রতিষ্ঠানটির গৌরব বাড়বে কিনা সেই প্রশ্নও করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়কে এখন
যে অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেখান থেকে মুক্ত করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন ক্যাম্পাসেও
একদলীয় আধিপত্যের অবসান ঘটনো। বিশ্ববিদ্যালয় হবে গণতন্ত্রের তীর্থস্থান। যুক্তি, পাল্টা
যুক্তি, বিতর্কের মধ্য দিয়েই মুক্তবুদ্ধির চর্চা বিকশিত হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের তাই এখন
উচিত হবে গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুনরুজ্জীবনে ডাকসু নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হওয়া। কেননা,
আগে চাই কথা বলার স্বাধীনতা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন